• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

বিরোধ মীমাংসায় গুণগত রূপান্তর আমাদের রাজনীতিতে অত্যন্ত জরুরি

প্রকাশ:  ২৬ জুলাই ২০১৮, ২২:০৮ | আপডেট : ২৬ জুলাই ২০১৮, ২২:১৪
মইনুদ্দিন লিটন ভূঁইয়া
প্রিন্ট


একটি অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচনের দিকে এগুচ্ছে দেশের রাজনীতি। সরকারও চাইছে এবারের জাতীয় নির্বাচনটি গ্রহণযোগ্য ও অর্থবহ হোক। নির্বাচন পর্যবেক্ষণকারী দেশী-বিদেশী সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি সরকারের সাথে মিত্র সম্পর্কযুক্ত রাষ্ট্রগুলোও এমনটাই চাইছে। তারই পূর্বাভাস এখন সিটি নির্বাচনে। প্রায় সবকটি সিটি মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগসহ সংসদের বিরোধী দল  এবং বৃহত্তর দল বিএনপি ও জামাত অংশ নিচ্ছে। খুব বেশি দূরে নয় ১১তম জাতীয় নির্বাচন। আর এই নির্বাচনকে অনেক বেশি অর্থবহ করে তুলতে চায় সরকার। কারণ এর উপরেই ভবিষ্যতের জন্য বাংলাদেশের নির্বাচনকালীন সরকার এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি একটা চূড়ান্ত পর্যায়ে নিষ্পত্তির দিকে এগুবে।
অনেক বিরোধীতাপূর্ণ মতামত থাকার পরেও এবারের আওয়ামী লীগের শাসন আমলে দেশে স্মরণাতীতকালের উল্লেখ করার মতো দৃষ্টান্তমূলক উন্নয়ন ঘটেছে, এটা অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। সেই উন্নয়নের হাওয়া কতোটা আমাদের চাঁদপুরে লেগেছে তা বলা মুশকিল কিনা জানি না। তবে কিছুদিন আগে আমি আমার এক সাংবাদিক ভাইয়ের সাথে বৃহত্তর চাঁদপুরের নদীভাঙ্গন এলাকা হাইমচর থেকে মতলব বরদিয়া আড়ং পর্যন্ত নদী তীরবর্তী এলাকাগুলো সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করেছি। সেখানে নদী ভাঙ্গন এলাকায় ভাঙ্গন প্রতিরোধের জন্য স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা তাৎক্ষণিক পদক্ষেপগুলোও দেখেছি। আর তা নিয়ে স্থানীয় জনগণের মধ্যে বেশ আস্থাও লক্ষ্য করেছি। একদম নদী তীরবর্তী কিছু কিছু জায়গাতে আগে ভাঙ্গন ঘটলেও এখন আর ভাঙ্গে না, এমনই মন্তব্য করেছেন স্থানীয় লোকেরা। চাঁদপুর সদরের বাইরে কিছু কিছু জায়গা ছাড়া হাইমচর ও মতলবে বিশেষ করে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা যথেষ্ট ভালো দেখেছি। স্থানীয় পর্যায়ে বাজার এলাকার অবকাঠামোগত উন্নয়নও চোখে পড়েছে।
চাঁদপুরের ৫টি আসনের মধ্যে ১৪টি ইউনিয়ন, ২টি উপজেলা ও ১টি পৌরসভা নিয়ে চাঁদপুর সদর-৩ আসনটিতে গত ৯ম জাতীয় নির্বাচনে বেশ হাড্ডাহাড্ডি নির্বাচনী লড়াই হয়েছিল। সেবার এমপি জি.এম. ফজলুল হককে টপকিয়ে প্রায় ১৮ হাজার ভোটের ব্যবধানে ডাঃ দীপু মনি এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু এবার আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে চাঁদপুর-৩ আসনটি নিয়ে এখনো রাজনৈতিক ঘোলাটে অবস্থা বিরাজমান। এই নির্বাচনী এলাকার প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। এই উভয় দলেই দীর্ঘদিন ধরে আভ্যন্তরীণ বিভাজন রয়েছে। দলীয় পদ-পদবী ও স্থানীয় পর্যায়ে পূর্ববর্তী কিছু নির্বাচনে প্রার্থিতা নিয়ে এসব বিভাজন এখনও বেশ প্রকট হয়ে আছে। আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে সদস্য পদ হারানোর জ¦ালা এবং বিএনপিতে বহিষ্কার ও বহিষ্কার প্রত্যাহারের পাল্টাপাল্টি লড়াই চলছে। এমন বহুমুখী দ্বন্দ্ব সামনের জাতীয় নির্বাচনে চাঁদপুরের এই আসনটিতে কতোটা প্রভাব ফেলবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। 
এবার আওয়ামী লীগ সরকার তার উন্নয়ন কর্মকা-ের সাফল্য নিয়ে যথেষ্ট আত্মবিশ^াসী। যাতে দেশের সর্বত্র তার উন্নয়নের দিকগুলো আরো ফলাও করে তুলে ধরা হয় এ ব্যাপারে স্থানীয় প্রতিনিধিদের কাছে দলীয় নির্দেশনাও রয়েছে। আপাতভাবে মনে হচ্ছে আওয়ামী লীগ তার সরকারের উন্নয়নের প্রচারণাকে সামনে এনে এবারের নির্বাচনে একটা নতুনমাত্রা সৃষ্টি করতে চায়। রাজনৈতিক অনেক বিশ্লেষক ও সর্মথকদের মতো আমারও অভিমত তাই। তবে আমি মনে করি এর পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে দলের আভ্যন্তরীণ অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়েও ভাবনা থাকতে হবে। আর সেগুলো মীমাংসাও করতে হবে। এছাড়া এই মীমাংসার একটা গুণগত রূপান্তর আমাদের রাজনীতিতে অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। আমাদের অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, যখনই কোনো নির্বাচন সামনে আসে তখন দলের শীর্ষ ও প্রভাবশালী নেতারা দলের অভ্যন্তরে বিভক্ত বা বিচ্ছিন্ন নেতা-কর্মীদেরকে নিয়ে একধরনের আপোষ-মীমাংসায় বসেন। তারপর এমন অদ্ভুত মীমাংসার পরে তিনি তার দুইপাশে দুই বিরোধী পক্ষের নেতার হাত উপরে শূন্যে তুলে ধরে এই বয়ান দেন যে এখন থেকে আমাদের মধ্যে কোন বিরোধ নাই, আর আমরা একযোগে এই নির্বাচনে কাজ করবো। এমন দৃশ্য দেখে একাংশ মানুষ উল্লাস করলেও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীতে এর সুদূর প্রসারী প্রতিফল যে কী ভয়াবহ হতে পারে তা আর মূল্যায়ন করা হয় না। সাধারণ মানুষের কাছে এখন এটা অনেকটা  খেলা-খেলার মত। কারণ সাধারণ মানুষ নির্বাচনের পরে এসব বিভক্তি আরো বহুগুণে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেখেছে। তারা মনে করেন, যিনি বা যাদের কারণে স্থানীয় পর্যায়ে দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে তাদেরকে নিয়ে এভাবে মীমাংসায় গেলে আবারো আরো বেশি করে তাদেরকেই প্রশ্রয় দেয়া হয়। এরই ফলে সেই সকল নেতারা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। তাছাড়া দলের ভবিষ্যত রাজনীতির জন্যও এটা কঠিন অন্তরায় হয়ে থেকে যায়। অনেক সময় তারা দলকে জিম্মি করে ফেলেন। যার কারণে দলের ত্যাগী কর্মীরা বরাবরের মতোই অবহেলিত থেকে যায়। তাই এবার জাতীয় নির্বাচনে তাদেরকে দলের কাজে সম্পৃক্ত না করাই ভালো। এদের মধ্যে অনেকেই আবার দলের পদপদবীর প্রভাব ও নাম ভাঙ্গিয়ে সাধারণ মানুষের উপর অনেক অন্যায় করেছেন। আর এই পর্যায়ে তারা দলের সাথে সম্পৃক্ত না থাকলেই এর দায় এড়ানো যাবে। নচেৎ তাদের ব্যক্তিগত কর্মের খেসারত দলকেই দিতে হবে। আওয়ামী লীগের দলপ্রধান জাতির জনকের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা বরাবরই তার দলের ত্যাগী কর্মীদের মূল্যায়ন করতে চান। ফলে এই পর্য়ায়ে সুবিধাভোগীরা বাদ পড়বেন, এটাই স্বাভাবিক। তবে দলের ত্যাগী কর্মীদের মূল্যায়ন করার কাজটা সত্যিই খুবই দূরহ। কারণ সুবিধাভোগীরা সব সময় ভোল পাল্টে ফেলতে জানে। সেক্ষেত্রে প্রকৃত ত্যাগী কর্মীদের অবস্থান চিহ্নিত কারাটা কষ্টসাধ্য। তবুও এবার চাঁদপুরের আওয়ামী রাজনীতিতে এক ধরনের গুণগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অন্তত এখন পর্যন্ত তা অব্যাহত আছে। স্থানীয় দলগত বিভাজনের ক্ষেত্রে নির্বাচনপূর্ব মীমাংসায় একটা গুণগত রূপান্তর হতে পারে বলে মনে হয়। আর তাহলেই তা হবে একটা দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান। এই আসনের এমপি ডাঃ দীপু মনি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সাথে আমারও ধারণা এবার তিনি নির্বাচনপূর্ব মীমাংসায় একটা গুণগত রূপান্তর আনবেন। 
অন্যদিকে বিএনপির রাজনীতি এখনো সাধারণ জনগণের কাছে পরিষ্কার নয়। স্থানীয় নির্বাচনগুলোতে অংশ নিলেও এবার জাতীয় নির্বাচনে বিএনপির অবস্থান বা স্ট্যাটিজি কী হবে তাতেও যথেষ্ট দোদুল্যমানতা রয়েছে। তবে আপাতভাবে বিএনপির নেতারা দেশনেত্রী ম্যাডাম খালেদা জিয়ার কারামুক্তির ইস্যুটি সামনে এনে নির্বাচন বয়কটের হুমকি দিচ্ছে। আবার পাশাপাশি  তারা জাতীয় নির্বাচনের দিকেও এক পা দু’ পা করে এগুচ্ছে বলেই মনে হয়। অন্তত এবার তারা ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কটের মত ভুল সিদ্ধান্ত আর নিতে চায় না। কারণ ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরে তার পূর্ণমেয়াদ অতিক্রম করে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের দ্বারপ্রান্তে এসে উপস্থিত হতে পেরেছে। চাঁদপুরে বিএপির রাজনীতিতেও আছে অনেক বিভাজন। অন্যান্য আরো অনেক বিভক্তির মধ্যে প্রধান দুই পক্ষের বহিষ্কার ও বহিষ্কার প্রত্যাহারের পাল্টাপাল্টি লড়াইটা চলছে। স্থানীয় বিএনপির রাজনীতিতে বিএনপির অনেক সাধারণ কর্মীদের কাছে শফিকুর রহমান ভূঁইয়া একজন পরীক্ষিত নেতা। পাশাপাশি শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক অনেক পরে এসেও বেশ দাপটের সাথে স্থানীয় বিএনপির রাজনীতিতে এক যুগ পার করে দিলেন। এছাড়া মাঝেমধ্যে সাবেক এমপি এস এ সুলতান টিটু ও প্রফেসর আবদুল্লাহর নাম শোনা গেলেও বর্তমানে চাঁদপুরে বিএনপির রাজনীতিতে তাদের দুজনের উপস্থিতি একদম নেই বললেই চলে। ফলে শেখ ফরিদ আহমেদ মানিক বনাম শফিকুর রহমান ভূঁইয়ার মধ্যে বিদ্যমান অন্তর্দলীয় বিভেদটাই হবে আগামী জাতীয় নির্বাচনে চাঁদপুরে এই আসনটিতে বিএনপির প্রধান প্রতিবন্ধকতা। আর এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের কোনো পথই এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না। ভবিষ্যতেও এর রাজনৈতিক নিষ্পত্তি হবে বলেও মনে হচ্ছে না। পাশাপাশি স্থানীয় পর্যায়ে এমন রাজনৈতিক রেষারেষির কারণে আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দল থেকে প্রত্যাখ্যাত নেতারা একজোট হবার সম্ভাবনাকে একদম উড়িয়ে দেয়া যায় না। আর তাই স্থানীয় দলগুলোর আভ্যন্তরীণ বিরোধ মীমাংসায় এখনই একটা গুণগত রূপান্তর হওয়া চাই। তবেই দলের ত্যাগী নেতাকর্মীদের সঠিক মূল্যায়ন করা সম্ভব হবে। আর তার ফলে আগামী জাতীয় নির্বাচনটি প্রকৃতভাবে অর্থবহ হয়ে উঠবে। যার মাধ্যমে আমরা আমাদের আগামী ভবিষ্যতের নতুন প্রজন্মের কাছে একটি সুফলা রাজনৈতিক ক্ষেত্র উপহার দিতে পারবো।

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব।

 

সর্বাধিক পঠিত