• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

চাঁদপুর ভরপুর জলে-স্থলে, মাটির মানুষ আর সোনার ফলে

প্রকাশ:  ১৪ মার্চ ২০২১, ১৪:০৮
শিতাংশু গুহ
প্রিন্ট

অজয়দা’র কথা ভুলেই গিয়েছিলাম! অজয় ভৌমিক, চাঁদপুর। চাঁদপুর আওয়ামী লীগ ‘ভারতীয় নাগরিক’ অপবাদ দিয়ে তাঁকে দল থেকে বের করে দিয়েছে। এই নেতিবাচক সংবাদটি নিয়ে আলোচনার আগে দু’টি ভাল সংবাদ দেই? নিউইয়র্ক টাইমস বুধবার ১০ই মার্চ ২০২১-এ এক নিবন্ধে প্রশ্ন রেখেছে, ‘দারিদ্র বিমোচনে বাইডেনের প্ল্যান কি হতে পারে’? উত্তরও দিয়েছে টাইমস, বলেছে, ‘লুক এট বাংলাদেশ’। শুক্রবার ১২ই মার্চ ওয়াশিংটনভিত্তিক কনজারভেটিভ থিংক ট্যাংক ‘দ্য হেরিটেজ ফাউন্ডেশন’ বলেছে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা সূচকে ভারত-পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। এ দু’টি সংবাদ বাংলাদেশের জন্যে উৎসাহব্যঞ্জক।

সামাজিক মাধ্যমে অজয় ভৌমিকের সংবাদটি দেখি, সাথে ছবি ছিলো, চেহারা একই, তবে বয়সের ছাপ পড়েছে। সেই কবেকার অজয়দা, সুন্দর, গোলগাল ছিমছাম চেহারা। আমাকে বা আমাদের যথেষ্ট স্নেহ করতেন। আমাদের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত ছিলো। তিনি চাঁদপুর কলেজে ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন, সেটি ষাটের দশকে। তখনকার আমলের আওয়ামী লীগ নেতা মিজান চৌধুরীর ঘনিষ্ট ছিলেন। যাঁরা তাকে বহিস্কার করেছেন, সেই আওয়ামী লীগ নেতার বাবা করিম পাটারী’র (পাটোয়ারী, কেউ তা বলতো না, সবাই পাটারী বলতো) সাথে রাজনীতি করেছেন। আরো পরে অজয়দা-কে আমরা এমপি কিরণভাই’র ঘনিষ্ঠ দেখেছি।

ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, যাঁরা চাঁদপুরে আওয়ামী লীগকে শক্ত মাটির ওপর দাঁড় করিয়েছেন, তাঁদেরই একজন অজয়দা দল থেকে আউট! মিজান চৌধুরীর কথা যখন এলো, একটি ঘটনা বলি, আমরা তখন জুবলী স্কুলে (হাসান আলী বহুমুখী উচ্চ বিদ্যালয়) পড়ি, হেডমাষ্টার আবদুল হামিদ, পূর্ব-পাকিস্তানে নির্বাচন, মিজান চৌধুরী দাঁড়িয়েছেন, প্রতিদ্ধন্ধী আমাদের হেড-মাষ্টার। সময়টা ১৯৬৫? মনে নেই! স্কুলে হেড-মাষ্টারের জন্যে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল। সেদিন হেডমাষ্টার ব্যাতিত সবাই মিজান চৌধুরী’র জন্যে প্রার্থনা করেছিলেন, তিনি জয়ী হ’ন। গল্পটি বলার কারণ হচ্ছে, অজয়দা তখনো মিজান চৌধুরীর সাথে ছিলেন। স্কুল শেষ করে চাঁদপুর কলেজে, অজয়দা কি তখনো কলেজে ছিলেন?

এরপর মুক্তিযুদ্ধ, আমার ঢাকা চলে আসা, অজয়দা’র সাথে যোগাযোগ কমে যায়, চাঁদপুর গেলে দেখা হতো। ১৯৯০-এ আমেরিকা আসার আগে আমার ‘নাগরিকত্ব ও পুলিশ সার্টিফিকেট’ নিতে পৌরসভায় যাই, অজয়দা’র সাথে দেখা। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কবে আইছো, পৌরসভায় কি লাগবো’? বললাম। তিনি আমাকে নিয়ে চেয়ারম্যানের কক্ষে গেলেন। ভুল না হলে চেয়ারম্যান তখন শামসুভাই। আমার বাবা, শামসু চেয়ারম্যান, কলেজের ইংরেজীর শিক্ষক শৈলেন রায় একসাথে বড়শি বাইতেন। স্বাধীনতার পর সামসু-ভাই’র সাথে আমাদেরও কিছুটা সখ্যতা হয়, অজয়দা নিয়ে যাওয়ার ফলে কাজটা জটজলদি হয়ে যায়। এরপর তিনি নিজেই আমায় থানায় নিয়ে যান, সেটাও সাথে সাথে হয়ে যায়। আমার মনে আছে, ওসি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আগের কোন কেইস-টেইস নাইতো? অজয়দা উত্তর দিলেন, না, খুব ভালো ছেলে?

আমেরিকায় আসার পর যতবার চাঁদপুর গেছি, অজয়দা’র সাথে দেখা হয়েছে বলে মনে পড়েনা! চাঁদপুর ছাত্রলীগ সভাপতি জহিরুদ্দিন’র পোষ্ট থেকে জানলাম, ‘মুক্তিযোদ্ধা অজয় ভৌমিক প্রতিহিংসার বলি’, তিনি লিখেছেন, ‘এক মহান নেতার অজানা কাহিনী’। অজয়দা মহান ছিলেন কিনা জানিনা, তবে ভদ্রলোক ছিলেন, রাজনীতি করতেন, দোষেগুণে মানুষ। আমি তাঁর মা-কে দেখেছি, বাবাকে দেখেছি বলে মনে পড়েনা! চাঁদপুর মহিলা কলেজের পাশে বিরাট মাঠের এককোনে একটি হিন্দু পাড়া ছিলো, অজয়দা সেখানে থাকতেন। ওই বাড়ীতে আমি অনেক গিয়েছি। ওই মাঠে আমরা ব্যাডমিন্টন খেলতাম, পার্শ্ববর্তী লেকে ঝাঁপ দিয়ে স্নান করতাম। সেই লেকটি ভরাট হয়ে গেছে দেখে দুঃখ পেয়েছি।

অজয়দা-কে নিয়ে জহিরুদ্দীনের পোষ্টটি পড়লাম। প্রথমেই মনে এলো জহিরুদ্দিন বাবর ভাই’র কথা, পরক্ষনে মনে এলো, তিনি তো নেই, পরে দেখলাম জহিরুদ্দিন ছাত্রলীগের সভাপতি। মনিরভাই, মাহবুব ভাই, ফজলুভাই, শিশুভাই, লেকুভাই, মোমিনভাই, দুলাল পোদ্দার, গণেশ, সন্তোষ এবং আরো অনেকের কথা মনে এলো। অজয়দা এবং এঁরা একসময় চাঁদপুর দাঁপিয়ে বেড়াতো। এরপর হানিফভাই, সেলিম, মানিক, মনসুর, রব্বানী বা আমাদের যুগ আসে। সেটা পুরানো স্মৃতি। সম্ভবত: ২০১৪ বা ২০১৭ সালে চাঁদপুর থেকে ঢাকা ফেরার পথে পুরো সময়টা জীবনকানাইদা’র সাথে দাঁড়িয়ে কথা বলেই কাটিয়ে দেই? জীবনকানাইদা, মাহবুবভাই বা ফজলুভাই-রা ছাত্র ইউনিয়ন, তবে চমৎকার মানুষ। বিষয়টি নিয়ে আমি চাঁদপুরের বন্ধু রব্বানী, সেলিম-র সাথে কথা বলার চেষ্টা করি। তবে এডভোকেট বিনয় মজুমদার জানালো, তিনি আওয়ামী লীগের সেক্রেটারী ক্যান্ডিডেট! ফেইসবুকে দেখলাম বন্ধু পার্থসারথী লিখেছে, নিলয় চক্রবর্তী, রাজীব চন্দ্র শীল, এবং আরো অনেকে লিখেছেন। জানতে ইচ্ছে করে চাঁদপুরের এমপি ডাক্তার দীপুমনি কি এঘটনা জানেন? সুজিত নন্দী?

চাঁদপুর জেলা ছাত্রলীগ সভাপতি জহিরুদ্দিনকে আমি চিনিনা, তাঁকে ধন্যবাদ সত্যটা তুলে ধরার জন্যে। জহির লিখেছেন, ১৯৬৯ সালে চাঁদপুর কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ঘটে যায় একটি নাটকীয় ঘটনা, অজয়দা নির্বাচনে প্রার্থী নন, কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ১১০০ ভোটের মধ্যে ৬৭৯টি ভোট পান, ছাত্র ইউনিয়নের প্রার্থী এড রহমান পান ১২০ ভোট, ছাত্রলীগের প্রার্থী বোরহান উদ্দিন আহমেদ পেয়েছেন ৩৩ ভোট। অবাক কান্ড, তাইনা? হ্যাঁ, সেটাই হয়েছে, ব্যালটে তার নাম ছিলো না তাই সবাই ব্যালটের পিছনে লিখে দিয়ে ছিলো অজয়-দাকে ভিপি চাই। অজয়দা ১৯৬৯ সালে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহবায়ক, ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, ১৯৭২-এ চাঁদপুর মহকুমা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক, এরপর থানা-আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব নিষ্ঠার সাথে পালন করেন। জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩-এ চাঁদপুর এলে সেই অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন অজয়দা। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর জেল খেটেছেন, নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তার পরিবারও রেহাই পায়নি। সাংস্কৃতিক অঙ্গনে তার অবদান ছিলো ব্যাপক, সুনামের সাথে চাঁদপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারন সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন ২৯ বছর।

হ্যাঁ, এই অজয় ভৌমিক-কে বহিস্কার করেছেন করিম পাটারীর গুনধর পুত্র আবু নঈম পাটোয়ারী দুলাল। চাঁদপুর আওয়ামী লীগে করিম পাটারীর সুনাম ছিলো, আমরা তাঁকে শ্রদ্ধা করতাম। তাই হয়তো দুলাল পাটোয়ারীর কাছে এমনটা আশা করিনি। বড়দের শ্রদ্ধা করা চাঁদপুরের রেওয়াজ কি উঠে গেছে? অজয়দা মাটি কামড়ে থাকার লোক। চাঁদপুরে গ্রূপিং-এ অজয় ভৌমিক কোন গ্রূপ আমার জানা নেই, তবে নির্দ্বিধায় বলা যায়, কাজটি অন্যায় হয়েছে, এটি ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। সামাজিক মাধ্যমে দেখলাম অজয়দা’র বিবিধ সনদ দিয়ে সবাই প্রমান করতে চেয়েছেন যে, তিনি বাংলাদেশ এবং চাঁদপুরের ভূমিপুত্র। এর প্রয়োজন ছিলোনা, কারণ অজয় ভৌমিক-কে যদি নথিপত্র দিয়ে প্রমান করতে হয় যে তিনি চাঁদপুর বা বাংলাদেশের সন্তান, আওয়ামী ঘরানার মানুষ, তবে যাঁরা তাকে বহিস্কার করেছেন, তাঁরা একদিন হারিয়ে যাবেন। জহিরের লেখা পড়ে বলেছি, ‘হে মোর দুর্ভাগা চাঁদপুর’।

ষাটের দশকের চাঁদপুরের শ্লোগান ছিলো, ‘চাঁদপুর ভরপুর জলে-স্থলে, মাটির মানুষ আর সোনার ফলে’। সেই জল-স্থলে ভরপুর আজকের যে চাঁদপুর এর পেছনের ইতিহাস লিখতে গেলে অনেকের সাথে অজয়দা’র নামটি প্রথম সারিতে থাকবে, তাঁর প্রতি একটি অন্যায় করা হয়েছে। আশা করি, এটি দ্রুত সংশোধন করে আজীবন সংগ্রামী একজন অজয়দা’কে তাঁর হৃতগৌরব ফিরিয়ে দিয়ে সসম্মানে যথাযোগ্য পুনর্বাসন করা হবে? আমার এ লেখাটি যদি কোন কারণে জননেত্রী শেখ হাসিনা বা ওবায়দুল কাদের-র নজরে পড়ে, আমি জানি অজয়দা সুবিচার পাবেন, যারা এ অপকর্মটি করছেন, তাঁরা শাস্তি পাবেন।

অজয়দা ভালো থাকুন, আরো দীর্ঘকাল মানুষের সেবায় নিয়োজিত থাকুন।

লেখক : আমেরিকা প্রবাসী।

সর্বাধিক পঠিত