জনতার রাজনীতি ও আওয়ামী লীগ
আওয়ামী লীগ একটি বিপ্লবের নাম, একটি সংগ্রামের নাম। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে আওয়ামী লীগ। এ দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ইতিহাস মানে আওয়ামী লীগ, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাস মানে আওয়ামী লীগ। এছাড়া ৬ দফা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানও আওয়ামী লীগের সৃষ্টি। দলটির নেতা-কর্মীদের রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে তাদের বেশিরভাগ সময় কেটেছে রাজপথে মিছিল-মিটিং করে আর কেটেছে জেলে। শুধু পাকিস্তান সরকারের নির্যাতন নয়, স্বাধীন বাংলাদেশে ৭৫-এর পট পরিবর্তনের পর দলটির বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস হয়েছে ২১ বছর। এমনকি ১/১১ সময় দলের নেতা-কর্মীদের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সম্মুখীন হতে হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কারাবন্দী করা হয়। তাঁকে বিদেশে নির্বাসন দেয়ার চেষ্টা করা হয়। তবু বারবার জনগণের কল্যাণে দলটি মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে, কোনো অপশক্তির কাছে পরাজিত হয়নি। এসব আন্দোলনে আওয়ামী নেতা-কর্মীরা যেমন রক্ত দিয়েছেন, তেমনি কারাবরণ করেছেন এমন কি জীবন বিসর্জন দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোনো দলের এমন আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের নজির নেই। এই দলের অর্জনের তুলনায় অন্য দলের অর্জন খুব অল্প। মজলুম জননেতা মাওলানা ভাষানী, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নেতা এ দলকে সামনে রেখে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বর্তমানে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য উত্তরসূরী বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। এ দেশে যতোবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে ততোবারই বাংলাদেশ সার্বিক দিক দিয়ে এগিয়ে গেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগ টানা ২ বার সরকার পরিচালনা করছে। দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে শিক্ষা, যোগাযোগ, তথ্য-প্রযুক্তি, কৃষি, প্রতিরক্ষা, বাণিজ্য এবং শিল্প খাতে ব্যাপক উন্নয়ন সাধন করেছে। যার কারণে সারা পৃথিবীতে বাংলাদেশ একটি রোল মডেল। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল বাংলার প্রতিটি ঘরে ঘরে। আগে আমাদের আক্ষেপ ছিলো সরকারের উন্নয়নের কথা সাধারণ মানুষের কাছে ভালোভাবে পৌঁছায় না। আর বিএনপি-জামাত চক্র এই সুযোগে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে সরকারের উন্নয়ন কর্মকা-ের কথা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে এবং ভ্রান্ত ধারণা ও অপপ্রচার রুখতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় জোরেশোরে কাজ করছেন। ফলে দেশের সার্বিক উন্নয়নের চিত্র সম্পর্কে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষজনও জানতে পারছে। আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন, অগ্রগতি, কর্মকা- সম্পর্কে সাধারণ মানুষকে জানানো অনেক জরুরী। কারণ, সাধারণ মানুষই ভোটের মাধ্যমেই তাদের নেতৃত্ব ঠিক করবে। তাই আওয়ামী লীগকে নিয়ে জনমনে যতো বেশি ভ্রান্ত ধারণা থাকবে ততো বেশি ষড়যন্ত্রকারীদের লাভ হবে। এজন্যে দেশের উন্নয়নচিত্র জানাতে এবং ভ্রান্ত ধারণা রুখতে আওয়ামী কর্মীদের আরো বেশি সক্রিয় ও সচেতন হতে হবে। নতুবা সুযোগসন্ধানীরা সুযোগ নিতে ভুল করবে না। আর আওয়ামী লীগ হঠাৎ সৃষ্ট কোনো দল নয়। এর রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস ও পথ পরিক্রমা।
আর এ কারণে দলকে এগিয়ে নিতে হলে সবার আগে ত্যাগী ও সিনিয়র নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন করতে হবে। আমি মনে করি, এসব নেতা-কর্মীরা যদি প্রাপ্য সম্মান না পান, তাহলে তা দলের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। তাই যে নেতা বা কর্মী দলের জন্য যতোটুকু করবে তাকে দল থেকে ততোটুকু মূল্যায়ন করতে হবে। দলের ভেতর বিশ^াসঘাতক বা সুযোগসন্ধানীদের বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে। কারণ এদের ষড়যন্ত্র ও নীলনকশায় অনেক ত্যাগী ও জ্যেষ্ঠ নেতার অবমূল্যায়নের নজির প্রতি জেলাতেই কম-বেশি আছে। অথচ আমরা সবাই জানি দেশ ও জাতির কল্যাণের জন্য এসব নেতা-কর্মীদের খুব প্রয়োজন। এদের যথার্থ মূল্যায়ন না করলে নতুন করে নিবেদিতপ্রাণ কর্মী-নেতা তৈরি হবে না। আওয়ামী লীগকে অবশ্যই এই দিকে খেয়াল করতে হবে। অন্যদিকে টানা দুবারের ক্ষমতায় থাকায় এখন অনেকের মুখেই বঙ্গবন্ধুর কথা শুনি। এদের মধ্যে কারা প্রকৃতভাবে বঙ্গবন্ধুকে ভালোবাসেন তা বুঝতে হবে। তাদের কথা মনে রাখতে হবে, যারা দলের দুঃসময়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে ছিলো। কারা নির্যাতনের মুখে কিংবা কারো চাপের মুখে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ভুলে যায়নি। তাদেরকে মূল্যায়ন করতে হবে সবার আগে। কারণ সুসময়ের বন্ধুর চেয়ে দুঃসময়ের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু। তাই কোনো দুধের মাছিকে যেন গুরুত্ব না দেয়া হয়, সেই দিকে সজাগ থাকতে হবে। আবার দলের অনুপ্রবেশকারীদেরকেও নিয়ে ভাবা দরকার। একসময় জামাত-শিবির করতো এরকম অনেকেই এখন আওয়ামী লীগে ঢুকতে চায়। আবার কোথাও ঢুকেছে। এসব অনুপ্রবেশকারীরা দলের মঙ্গলের চেয়ে অমঙ্গলই বেশি করবে। যাকে-তাকে আওয়ামী লীগে স্থান দিয়ে দলের ইমেজ ক্ষুণœ করা যাবে না। যাকে-তাকে দলে স্থান দিলে তাদের অপকর্মের ভার দলের ওপরও এসে পড়বে। আওয়ামী লীগের ভুলের খেসারত শুধু দলটি একা নয় পুরো জাতিকে দিতে হয়।
কোনোরকম দলীয় কোন্দল সৃষ্টি হতে দেয়া যাবে না। আওয়ামী লীগ কোন্দলের দল নয়। দেশ, জাতির, উন্নয়নের ও দলের প্রশ্নে সবাইকে হাতে-হাত কাঁধে-কাঁধ রেখে কাজ করতে হবে। নিজেরদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি, মান-অভিমান ভুলে এগিয়ে যেতে হবে।
অন্যদিকে মুখে মুখে বঙ্গবন্ধুর নাম, কিন্তু কাজে-কর্মে অন্য কিছু, এমন নেতা-কর্মী আমরা চাই না। দলের সভাপতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাও তাঁর বিভিন্ন বক্তব্যে এ বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু কন্যার মতো আমরাও চাই যে, কেবল কথাবার্তা বা বক্তব্যে নয়, কাজের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অক্ষুণœ থাকুক। যোগ্য নেতা হতে হলে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে সবার স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ ও আওয়ামী লীগ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না থাকলে কেউ কীভাবে সচেতন আওয়ামী কর্মী হতে পারবে? যারা ভালো রাজনীতিবিদ হতে চায় তাদের অবশ্যই ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ পড়া উচিত। আদর্শ নেতা-কর্মী না হলে আদর্শ বাংলাদেশ গঠন করা সম্ভব হবে না। মুখে মুখে নয়, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ কাজে কর্মে এবং অন্তরে ধারণ করলেই আওয়ামী লীগ সমৃদ্ধ হবে এবং বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে। দলের প্রতি আহ্বান জানাই, ঐতিহ্য ধরে রাখতে ত্যাগী ও সিনিয়র নেতা-কর্মীদের মূল্যায়ন করুন। নতুনদের সুযোগ দেয়ার নামে অযোগ্য অর্বাচীনদের সুযোগ দেবেন না। অনুপ্রবেশকারী এবং মুখোশধারীদের সম্পর্কে সচেতন হয়ে তাদেরকে দল থেকে দূরে রাখুন। নেতা-কর্মীরা বিভেদ ভুলে দেশের স্বার্থে এক কাতারে দাঁড়ালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের উন্নয়ন আরো ত্বরান্বিত হবে।
একটা কথা বলে শেষ করছি। জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে আমি প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত ছিলাম। আমি যখন এমবিএ করি তখন আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক, জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য ড. মীজানুর রহমান স্যার মাঝে মাঝে বলতেন, ‘বঙ্গবন্ধু দেশ ও দেশের মানুষকে নিজের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন। তিনি নেতা-কর্মীদের নামধাম মনে রাখতেন ও সাধারণ মানুষের সাথে নিঃসঙ্কোচে মিশে যেতেন। সে কারণে দেশের মানুষ তাঁকে নিঃস্বার্থভাবে শ্রদ্ধা করেছে এবং করছে। তাই আওয়ামী লীগ করতে হলে আগে সাধারণ মানুষকে ভালোবেসে নিঃস্বার্থভাবে কাজ করতে হবে।’ মনে আছে ড. মীজান স্যার আরো বলতেন, ‘তোমরা যারা রাজনীতি করতে চাও, তারা আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রাখো। তাহলে তোমার রাজনৈতিক কর্মকা-ে দেশ উপকৃত হবে। তোমার রাজনীতিতে যদি সাধারণ মানুষের কোন উপকার না হয় তবে সেই রাজনীতির কোন দাম নেই।’ স্যারের কথা এখনো মনে গেঁথে আছে। আসলেই তো, রাজনীতি করে যদি কারো উপকার না হয় তবে সে রাজনীতি মূল্যহীন। আমি বিশ^াস করি, আওয়ামী লীগ মানুষের কল্যাণের জন্য রাজনীতি করে। দেশের উন্নতির জন্যে রাজনীতি করে। আমি আশা করি, এই রাজনৈতিক ধারা যোগ্য নেতা-কর্মীদের মধ্য দিয়ে অব্যাহত থাকবে।
জয় বাংলা।
জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক : সদস্য,
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, চাঁদপুর জেলা শাখা।