সব বুঝে তবু কিছু বুঝেনা
অনেক কথা অনেক সময় অনেকেই অন্যকে সঠিক ভাবে প্রকাশ করতে পারে না। আমিও তার ব্যতিক্রম নই।প্রিয় বা কাছের মানুষদের প্রতি অনিচ্ছাকৃত ভাবে অনেক সময় অপ্রিয় বাক্যগুলো প্রয়োগ করার পর নিজের এবং প্রিয় সেই ব্যক্তির হৃদয়ের রক্তক্ষরণ তৎসময়ে অনুভূত না হলেও কোন একসময় তা বিস্ফোরিত হয় ঠিক ই। যদিওবা আমরা প্রত্যেকেই জানি যে আমাদের সীমাবদ্ধতা কি। কিন্তু তারপরেও অজান্তে অনিচ্ছায়,অন্যকে অনেক সময় কষ্ট দিয়ে দিই, এবং পরবর্তীতে অনুশোচনায় ভুগতে থাকি।যেমনটা আমি অন্যের সাথে নিজে করেছি এবং অন্যের দ্বারাও হয়েছি।
এই প্রসঙ্গ আসলেই মনে পড়ে যায় শৈশবের প্রিয় বিদ্যাপীঠ ঢাকা উত্তর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক মরহুম মইনুল ইসলাম স্যারের (আমাদের মইন স্যার) কথা। স্যার বলতেন গরু ছাগলকে বুঝানো সহজ কিন্ত এই মানব সন্তান (আমাদের) বুঝানো কঠিন।আজ স্যার নেই কিন্তু স্যারের কথা যে অপ্রিয় সত্য তা মানতে দ্বিধা নেই।আজো মনে পড়ে স্কুলে যাওয়া আসার সময় মানসিক প্রতিবন্ধী একটি ছোট্ট মেয়ে আমি আর আমার বোন তাপসীর পথ আগলে দাঁড়িয়ে থাকতো। প্রথম প্রথম আমরা ভয় পেতাম। কি চাইতো কি বলতো বুজে উঠতাম না। একদিন আমার বোনের চুলের ব্যান্ড দেখিয়ে কিছু একটা বলতেই অমনি তাপসী তা দিয়ে দিয়েছিল। সে দিন তার খুশি দেখে আমরা অবাক হইনি বরং খুশি হয়েছিলাম এই ভেবে যে সে আর আমাদের পথ আগলে দাঁড়াবেনা। আর ঠিক তাই হয়েছিল পর দিন থেকে সে আমাদের দেখলে হাসত কিন্তু আর পথ আগলে দাঁড়াতোনা।তার বলা কথা গুলা না বুঝলেও সে যে আমাদের খারাপ কিছু বলছেনা তা আমরা জানতাম।
সবাই কিন্ত মনেরভাব যতাযত ভাবে উপস্তাপন করতে পারেনা আর তাই অনেক সময় ভালো কিছু করতে বা বলতে গিয়ে হিতের বিপরীত হয়ে যায়। এক্ষেত্রে শৈশবের আরো একটা চরিত্রের উদাহরণ দেয়া যায়, যার কথা বলে আমাদের মা, চাচীরা আমাদের ঘুম পাড়াতেন,খাবার খেতে না চাইলে তার নাম শুনলেই দস্যি ছেলেটা লক্ষী হয়ে যেতাম সেই ব্যাক্তি ছিলেন প্রিয় বতাই ভাই। বতাই ভাইকে ভয় পাবার কারণ ছিল ছোট বাচ্চাকাচ্চাদের বতাই ভাই কুলে নিয়ে আদর করতে চাইতেন।আর তার ভাষায় নাকে নাক ঘষিয়ে আদর দেওয়ার নাম হলো নাকু। এই ঐতিহাসিক নাকু দেওয়ার সময় ভিড়ভিড়িয়ে কি যেন তিনি বলতেন আর যা বুজতে না পেরে আমরা ভয় পেতাম প্রচণ্ড। আর তাই আমার সমসাময়িক কাজিনদের কাছে বতাই ভাইয়ের নাকু ছিল চরম ভয়ংকর এক আতংকিত অস্ত্র।শুধু মাত্র ভাব প্রকাশের ব্যর্থতায় একজন মানুষের ভালোবাসা ছিল আমাদের কাছে মুর্তিমান এক আতংকের নাম।সে অনেক কথা.....
আচার আচরন আর ভাব ভঙ্গীমায় স্বঘোষিত অনেক স্মার্ট দের কথায় তালগোল পাকাতে দেখিইনি বরং অপদস্থ হতেও দেখেছি।জ অদ্যাক্ষরের এক বড় ভাই আমাদের কথা, বক্তৃতা আর সংগঠন জ্ঞান দিতে কিয়ে নিজের পাণ্ডিত্য জাহির করতেন। আর মাইক্রোফোন হাতে আসলে মীউট মুডে চলে যেতেন। অথচ এই মাথামোটারা ষড়যন্ত্র করার সময় এত সফল হত কিভাবে সেটা আমাকে সত্যিকারে ভাবায়।
কৃকেট খেলায় খুব একটা খারাপ ছিলাম না। ভাতিজা তাইমুর চৌধুরী আর আমার ওপেনিং জুটির বেশ জনপ্রিয়তা ছিল। কোন সিংগেল টায় দৌড়াবো তা একে অন্যের মুখের ভাষায় বুঝতাম। একইভাবে জজ আর আমার বুঝাপড়া ছিল কিন্তু হাইস্কুলের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক সেলিম স্যারের (প্রিয় মাষ্টার ভাই) করা প্রশ্নের উত্তর বাংলা বাদ দেন, সিলেটী ভাষায়ও বুঝাতে পারতাম না।তার থেকেও ভয়ানক ছিল স্কুলে পরীক্ষা দিয়ে এসে গণিত পরিক্ষাটা বড় ভাইয়ের সামনে বসে আবার দেয়া। প্রিয় বড়বোন শাপলা চৌধুরী কে বুঝাতে পারলেও বড় ভাইয়ের সামনে পরীক্ষায় সঠিক দিয়ে আসা অংকটা ভুল করে ফেলতাম।আহারে আমার মত যাদের সাথে হয়েছে তারাই কেবল বুঝতে পারবে কি দখল ই না যেত। অথচ আজকাল ছেলেমেয়েরা আমাদের সেইরকম ভয় কি পায়?।বাড়ি ফিরতে দেরী হলে আম্মার চোখের ইশারায় বুঝতাম আজ আব্বা বেত দিয়ে পিটাবেন না হাত দিয়ে।গনিতে পঞ্চাশের নিচে পেয়েছিলাম বলে বড় ভাই পোরো গ্রাম দৌড়িয়ে শেষতক ধরে পিটিয়েছিলেন বলেই আজকে হিসাব সাস্ত্রে উচ্চতর ডিগ্রী নিয়েছি। বড় ভাই বলতেন গায়ের চামড়া বিক্রি করে পড়াবো তবু পড়তে হবে। ভাবতাম ভাইয়ের চামড়াটা বেচবে কোথায়। আম্মা কে কিজ্ঞেস করলে আম্মা হাসতেন। ভাইয়ের কথা গুলি যখন বুঝতে শুরু করলাম তখন সব কড়া শাষনগুলা ভালোবাসায় পরিণত হতে শুরু করে।
এত গেল ঘরের খবর।সংগঠন করতে গিয়ে না বলা নির্দেশনা সঠিক ভাবে পালন করে যাওয়া ইব্রাহীম আহমদ জেসি কে দেখি আর নিজেকে প্রশ্ন করি আমার থেকে ও আমাকে এত্ত ভালো বুঝে কি করে? রাগে অনুরাগে বুকে জড়িয়ে দুঃখ ভাগ করে নিতে শেখানো বন্ধুবর আহমদ হামজা চৌধুরী মাজে মধ্যে যখন আমাকে শাসায় তখন তার মাজে শৈশবের বড় ভাই কে খুজে নেই।আমাকে সম্মানিত দেখতে পারাতেই যেন তার সুখ। মাঝেমধ্যে ফরমায়েশি বক্তৃতা পাঠচক্রে উপস্তাপন করতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র পারভেজ যখন তথ্য উপস্তাপন করে তখন নিজেকে প্রশ্ন করি সে আমার চাওয়াটা সে বুঝে কি করে?অনুষ্টান আয়োজনের ব্যানার বানাতে আফসার আর চিঠি, দাওয়াত, হল ব্যাবস্তাপনা করতে মফিজুর রহমান মফি যেন স্বপ্নে এসে আমার মন পড়ে নেয়।সেদিন ছাব্বির কে এ বিষয়ে বলছিলাম স্নেহাশিস ছাব্বির অবাক হয়ে শুনে শুধু বলেছিল এরই নাম হৃদয়ের বন্ধন যা আমাদের প্রানের সংগঠন হৃদয়ে ৭১ থেকেই সম্ভব।
অনেকদিন পর আজকে আমার নিজের ছায়া দেখলাম বড়লেখার নাহিদের মাজে। সে যখন বলে ভাই আমি সবই বুঝি কিন্তু বুঝাতে পারিনা, তখন না হেসে পারলাম না।আমিও যে এমন সেটা তাকে যদিও বলা হয়নি তারপরও নাহিদের সরলতা আর তার সহপাঠিনী ইমার সংগীতের ভাষা আমি ঠিক ই বুঝি ।আজ আর লম্বায় যাবো না, একটা প্রশ্ন মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। আর তা হলো, জাতীয় দুর্যোগ রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে কক্সবাজার ঘুরে এসে তাদের চেহারা পড়ে আসা আমার আলীনগর গ্রামের সরল মনের বিনয়ী সুহেল আহমদের ফেসবুক স্টেটাস পড়ে বুঝলাম সে যেটা বুঝে বিশ্ববিবেক তাই বুঝে কেন যেন বুঝে না।পরিশেষে বলি মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সাধারণ থেকে সাধারণ ও বুঝতে পেরেছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ বাঙালীদের কেউ হারাতে পারবেনা,আর আজকের বাস্তবতায় জাতীয় স্বার্থে যখন জাতীয় ঐক্য দরকার তখন আধুনিক বাঙালী রা যেন সব বুঝে তাও কিছু বুঝেনা।
লেখক: কলামিস্ট ও সমন্বয়ক, সাপ্তাহিক হৃদয়ে ৭১ পাঠচক্র।