কোটি কোটি টাকার বাড়ি-গাড়ি, পুঁজি মিথ্যা-প্রতারণা
শিক্ষাগত যোগ্যতা দশম শ্রেণি। তবে পরিচয় দিতেন অতিরিক্ত সচিব। এক কোটি ২০ লাখ টাকার প্রাডো গাড়িতে চলাচল। সেই গাড়িতে আবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের স্টিকার ও ফ্ল্যাগস্ট্যান্ড লাগিয়ে ঢুকতেন সচিবালয়ে। ঘনিষ্ঠতা ছিল ক্যাসিনোকাণ্ডে গ্রেফতার ঠিকাদার জি কে শামীমের সঙ্গে। শুধু তাই নয়, পরিচয় দিতেন ধনকুবের প্রিন্স মুসা বিন শমসেরের আইন উপদেষ্টা। অস্ত্র ও ওয়াকিটকি নিজেই রাখতেন।
এভাবেই নিজেকে জাহির করে চাকরিপ্রার্থী, ব্যবসায়ী ও ঠিকাদারদের প্রতারিত করেছেন আব্দুল কাদের মাঝি। আজ তিনি কোটি কোটি টাকার মালিক। অথচ এক সময় মাছ ধরে জীবিকা উপার্জন করেছেন। তার আদি বাড়ি নোয়াখালীর সুবর্ণচরের ভূমিহীন এক কৃষক পরিবারে।
দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে দেশের শত শত মানুষের কাছ থেকে সরকারি অনুদানে বাড়ি ও খামার তৈরির নামে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে ৭ অক্টোবর আব্দুল কাদেরকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। মিরপুর-৬ নম্বরে বাসা থেকে বাইরে যাওয়ার সময় নিজের প্রাডো গাড়িতে গ্রেফতার হন তিনি। একই সঙ্গে আরও তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়।
এসময় তার পকেটে পাওয়া যায় অতিরিক্ত সচিবের ভুয়া আইডি কার্ড ও ভিজিটিং কার্ড। এছাড়া অবৈধ বিদেশি পিস্তল, ম্যাগাজিন ও এক রাউন্ড গুলি মেলে তার কোমরে।
৭ অক্টোবর সন্ধ্যা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত রাজধানীর কাওরান বাজার, মিরপুর ও গুলশানে অভিযান চালায় ডিবি পুলিশ। এতে নেতৃত্ব দেন ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের (উত্তর) যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার হারুন-অর-রশীদ, গোয়েন্দা গুলশান বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মশিউর রহমান ও অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) মো. কামরুজ্জামান সরদার।
গ্রেফতার অন্যরা হলেন ভুয়া অতিরিক্ত সচিব আব্দুল কাদের সততা প্রপার্টিজের চেয়ারপারসন ও তার দ্বিতীয় স্ত্রী শারমিন চৌধুরী ছোঁয়া, অফিস ম্যানেজার শহিদুল আলম ও অফিস সহায়ক আনিসুর রহমান।
শনিবার (৯ অক্টোবর) দুপুরে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন অতিরিক্ত কমিশনার ডিবি প্রধান এ কে এম হাফিজ আক্তার।
তিনি বলেন, আব্দুল কাদেরের বাবা জীবিকার সন্ধানে সন্দ্বীপে পাড়ি জমিয়েছিলেন। মাছ ধরে ও মাঝির কাজ করে জীবিকা উপার্জন করতেন। এমন ভূমিহীন ভাসমান আব্দুল কাদেরের ঢাকা এবং ঢাকার বাইরে রয়েছে কোটি কোটি টাকার সম্পদ। এর মধ্যে গুলশান-১ নম্বরের জব্বার টাওয়ারের প্রায় ৬ হাজার স্কয়ার ফিট আয়তনের তার অফিস রয়েছে। কারওয়ান বাজারেও রয়েছে আরও একটি অফিস। মিরপুর-৬ নম্বরে বসবাস করলেও একাধিক ফ্ল্যাট রয়েছে তার।
ডিবিপ্রধান জানান, আব্দুল কাদের নয়তলা বাড়ি কিনেছেন গাজীপুরের বোর্ডবাজারে। গাজীপুরের পুবাইলে রয়েছে ৮ বিঘার বাগানবাড়ি। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, মার্কেন্টাইল ব্যাংক, আইএফআইসি ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক ও সিটি ব্যাংকসহ আরও কয়েকটি ব্যাংকে রয়েছে তার একাধিক অ্যাকাউন্ট। যেখানে রয়েছে লাখ লাখ টাকা। অঢেল সম্পদের মালিক এই আব্দুল কাদেরের নেই কোনো বৈধ উপার্জন। প্রতারণা ও মিথ্যা তার একমাত্র পুঁজি বলে মন্তব্য করেন ডিবিপ্রধান।
তিনি বলেন, জি কে শামীম গ্রেফতার হওয়ার আগে আব্দুল কাদের গানম্যান নিয়ে চলাফেরা করতেন। কিন্তু বর্তমানে গানম্যান নিয়ে চলাচল অসুবিধাজনক হওয়ায় তিনি নিজেই অস্ত্র ও ওয়াকিটকি নিয়ে চলেন বলে প্রাথমিকভাবে জানিয়েছেন।
নামসর্বস্ব একাধিক কোম্পানির মাধ্যমে প্রতারণা
আব্দুল কাদেরের বেশ কয়েকটি নামসর্বস্ব কোম্পানি রয়েছে। এগুলোর মধ্যে হলো- ঢাকা ট্রেড করপোরেশন, জমিদার ট্রেডিং, সামীন এন্টারপ্রাইজ, চৌধুরী গ্রুপ, হিউম্যান ইমপ্রুভমেন্ট ফাউন্ডেশন, সততা প্রপার্টিজ, ডানা লজিস্টিকস ও ডানা মোটরস।
আব্দুল কাদের বড় ধরনের প্রতারণা করেন হিউম্যান ইমপ্রুভমেন্ট ফাউন্ডেশনের ‘একটি বাড়ি একটি খামার প্রকল্পের’ মাধ্যমে। ২০০৪-২০০৬ সালে দেশের শত শত মানুষের কাছ থেকে সরকারি অনুদানে বাড়ি ও খামার তৈরি করার নামে হাতিয়ে নেন কোটি কোটি টাকা।
২০ কোটি টাকার বেশি লোন পাইয়ে দেওয়ার নামে প্রতারণা
বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ২০ কোটি বা তার বেশি টাকার লোন পাইয়ে দেওয়ার নামে প্রতারণা করতেন আব্দুল কাদের। এক্ষেত্রে তার মার্কেটিংয়ের লোকরা বিভিন্ন ঠিকাদার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে গিয়ে বিজ্ঞাপন দিতেন।
এরপর লোন পাইয়ে দিতে আব্দুল কাদেরের ইন্টারভিউ ও কনসালটেন্সির জন্য নেওয়া হতো ৫০ হাজার টাকা। ২-১০ লাখ টাকা নেওয়া হতো লোনের জন্য প্রোফাইল বানাতে। এছাড়া ২০ কোটি বা তদূর্ধ্ব অংকের লোন পাইয়ে দিতে ডাউনপেমেন্ট হিসেবে ৫-১০ শতাংশ টাকা নেওয়া হতো লোন প্রার্থীর কাছ থেকে। পরে কাউকে লোন করিয়ে দিতে না পারলেও হাতিয়ে নেওয়া সেই লাখ লাখ টাকার অংশবিশেষ ঋণ হিসেবে দিতেন তিনি।
ঠিকাদারির নামে প্রতারণা
সেনাবাহিনী এবং সরকারের বিভিন্ন প্রজেক্টের শত শত কোটি টাকার ঠিকাদারি পেয়েছেন বলে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করতেন কাদের। সেগুলোর বিপরীতে বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ওয়ার্ক অর্ডার বিক্রি করতেন। এছাড়া ঠিকাদারদের কাছ থেকে বড় অংকের টাকা জামানত রেখে সেগুলো দিয়ে আবার করতেন প্রতারণা। এমনকি বিভিন্ন সরকারি ব্যাংকে নিয়োগ দেওয়ার নাম করে বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছ থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন টাকা।
নানাভাবে হয়রানি করে টাকা
এছাড়া সততা প্রপার্টিজের নামে প্রতারণা চালিয়ে আসছিলেন কাদের। জমি ও স্থাপনা কেনার জন্য নামেমাত্র কিছু টাকা বায়না দিয়ে চুক্তি সম্পাদন করতেন। যেগুলো দিয়ে পরে মানুষকে নানাভাবে হয়রানির মাধ্যমে করতেন টাকা আদায়। এই কাজগুলো করার জন্য আব্দুল কাদের নিজেকে অতিরিক্ত সচিব হিসেবে পরিচয় দিতেন।
মুসা বিন শমসেরের সঙ্গে ছবি তুলে প্রতারণা
প্রিন্স মুসা বিন শমসেরের সঙ্গে আব্দুল কাদের একাধিক ছবি তুলে চাকরিপ্রার্থী, ব্যবসায়ী ও ঠিকাদারদের বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা করতেন। তিনি নিজেকে পরিচয় দিতেন তার আইন উপদেষ্টা বলে।
আব্দুল কাদের, তার স্ত্রী ও সহকর্মীদের বিরুদ্ধে পল্লবী থানায় অস্ত্র মামলা, তেজগাঁও থানায় প্রতারণার মামলা রয়েছে। এর আগে তার বিরুদ্ধে পাসপোর্ট জালিয়াতি, বিভিন্ন প্রতারণা, ব্যাংকে নিয়োগ বিষয়ে কমপক্ষে অর্ধ ডজন মামলাও রয়েছে বলে জানায় ডিবি।