একটি ডাকাতি, একটি অডিও: সিআইডি-ডিবি কর্মকর্তার পাল্টাপাল্টি
খবর > বাংলাদেশ
একটি ডাকাতি, একটি অডিও: সিআইডি-ডিবি কর্মকর্তার পাল্টাপাল্টি
লিটন হায়দার ও গোলাম মর্তুজা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published: 08 Sep 2021 11:46 PM BdST Updated: 09 Sep 2021 12:31 AM BdST
এই মাইক্রোবাস থেকে ঘটনার সূত্রপাত; মামলা অনুযায়ী, প্রবাসীর অর্থ লুট করা হয় এই মাইক্রোবাস ব্যবহার করে।
এই মাইক্রোবাস থেকে ঘটনার সূত্রপাত; মামলা অনুযায়ী, প্রবাসীর অর্থ লুট করা হয় এই মাইক্রোবাস ব্যবহার করে।
প্রবাসী এক ব্যক্তিকে ডিবি পরিচয়ে ধরে অর্থ লুট হল, সেই মামলা তদন্তে নেমে সিআইডির এক কর্মকর্তার ‘জড়িত থাকার প্রমাণ’ পেল ডিবি; এর মধ্যে ইন্টারনেটে এল ‘ঘুষ লেনদেনের কথাবার্তার’ একটি অডিও, সিআইডির সেই কর্মকর্তা দাবি করলেন, তাকে ‘ফাঁসানো’ হয়েছে।
সম্প্রতি ফোনালাপের একটি অডিও ছড়িয়ে পড়ার পর তার অনুসন্ধানে নেমে প্রবাসীর অর্থ লুট এবং সেই ঘটনার নানা পর্যায়ে পুলিশের দুটি শাখার কর্মকর্তাদের জড়িয়ে পড়ার বিষয়টি বেরিয়ে আসে।
ওই অডিওতে এক নারী ও এক পুরুষের কথোপকথনে কোটি টাকার বেশি লেনদেনের কথা এসেছে।
সিআইডির উপপরিদর্শক আকসাদুর জামানের দাবি, এটা তার স্ত্রীর সঙ্গে মামলার তদন্ত দেখভালকারী ডিবি কর্মকর্তা কায়সার রিজভী কোরায়শির কথোপকথন।
তবে এডিসি কোরায়শি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, লুটের মামলা থেকে বাঁচতে এই ‘সাজানো অডিওটেপ তৈরি করেছেন’ সিআইডি কর্মকর্তা আকসাদুর।
ডিবির অভিযোগের ভিত্তিতে আকসাদুরকে ইতোমধ্যে সাময়িক বরখাস্ত করছে সিআইডি।
আকসাদুর এবং কোরায়শি দুজনের বাড়িই ঠাকুরগাঁও জেলায়।
ঘটনার শুরু যেখানে
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত বছরের ২০ অক্টোবর ঢাকার বিমানবন্দর সড়কে এক প্রবাসীর অর্থ লুট থেকে ঘটনার শুরু।
দুবাই প্রবাসী রোমান মিয়া এই লুটের শিকার। দুবাইয়ে তাদের কাপড়ের দোকান আছে।
তার করা মামলায় বলা হয়েছে, ২০ অক্টোবর সকাল পৌনে ৭টার দিকে তিনি টিকাটুলির কেএম দাস লেন থেকে ফুফাতো ভাই মনির হোসেনকে (২৫) সঙ্গে নিয়ে একটি সিএনজি অটোরিকশায় শাহজালাল বিমানবন্দরে যাত্রা করেন। বিমানবন্দর সড়কের কাওলা ওভারব্রিজের নিচে একটি হাইয়েস মাইক্রোবাস তাদের আটকায়। গাড়ি থেকে দুজন নেমে এসে নিজেদের ‘ডিবির লোক’ পরিচয় দিয়ে রোমানকে লাগেজসহ মাইক্রোবাসে তুলে নেয় তারা।
রোমানের অভিযোগ, গাড়ির ভেতরে তার হাতে হাতকড়া পড়িয়ে, চোখে কালো কাপড় বেঁধে মারধর করা হয়। এরপর তার কাছ থেকে ৫ হাজার মার্কিন ডলার, দুই হাজার দিরহাম, দুই হাজার টাকাসহ লাগেজটি ছিনিয়ে নেয়। এরপর তাঁর হাতের হাতকড়া খুলে রশি বেঁধে রামপুরা-স্টাফ কোয়ার্টার সড়কের পাশে ফেলে দিয়ে গাড়িটি চলে যায়।
বিমানবন্দর থানায় করা সেই মামলার তদন্তভার পায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ।
মামলার নথিসূত্রে জানা যায়, ওই মামলায় ডিবি ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে। তারা হলেন- সিআইডির রাইটার মোশাররফ হোসেন, সেলিম মোল্লা, রিপন মোড়ল, আমির হোসেন তালুকদার, রিজু মিয়া সিকদার ও হাসান রাজা।
গ্রেপ্তার ছয়জনের সবাই জামিন পেয়েছেন, এরমধ্যে পাঁচজনই কারাগার থেকে বেরিয়ে গেছেন। কেবল হাসান রাজা অন্য আরেকটি ডাকাতির মামলায় (পিআইবির তদন্তাধীন) এখনও কারাগারে রয়েছেন।
ডিবির তদন্ত তদারককারী কর্মকর্তা এডিসি কায়সার কোরায়শি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মামলার তদন্তভার পেয়ে সিসি ক্যামেরা ও অন্যান্য প্রযুক্তির সহায়তায় প্রথমে মাইক্রোবাসটি শনাক্ত করা হয়। এরপরই পুরো চক্রটির বিষয়ে জানা যায়। বেরিয়ে আসে সিআইডি কর্মকর্তার সংশ্লিষ্টতার বিষয়টিও।”
মাইক্রোবাসের চালক হারুনুর রশীদ সজীব এই মামলায় আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
তার বক্তব্য উদ্ধৃত করে ডিবি কর্মকর্তা বলছেন, সজীব সিআইডির ভাড়া করা মাইক্রোবাসটি চালান। ১৯ অক্টোবর রাতে এসআই আকসাদুর জামান তাকে ফোন করে বলেন, ভোরবেলায় ‘অপারেশন’ আছে, প্রস্তুত থাকতে। এরপর ভোর ৫টায় তিনি গাড়ি নিয়ে বের হন। আকসাদুরকে নেওয়ার পর মালিবাগের সিআইডি দপ্তর থেকে মোশাররফ হোসেনকে তোলেন। এরপর বিভিন্ন জায়গা থেকে বাকিদের তুলে টিকাটুলিতে গিয়ে আধা ঘণ্টা অপেক্ষার পর একটি সিএনজি অটোরিকশাকে অনুসরণ করেন।
আকসাদুরের নির্দেশেই কাওলায় ওই অটোরিকশাটিকে আটকানোর কথা বলেন সজীব।
হাসান রাজাও আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
তাকে উদ্ধৃত করে ডিবি কর্মকর্তারা বলেন, সেদিন তিনি আকসাদুরের সঙ্গে ছিলেন। এবং এজন্য আকসাদুর তাকে ৭০ হাজার টাকা দিয়েছিলেন।
তদন্তে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ডিবি পুলিশ সদর দপ্তর ও সিআইডিতে একটি প্রতিবেদন পাঠায়।
সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (গণমাধ্যম) আজাদ রহমান বলেন, তার ভিত্তিতে আকসাদুরের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তাকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে।
অডিওতে ঘুষের আলাপ
সম্প্রতি ২ মিনিট ১০ সেকেন্ডের একটি মোবাইল কথোপকথন ছড়িয়ে পড়েছে।
ওই ফোনালাপে এক নারী ও পুরুষ কণ্ঠের আলাপ শোনা যায়। তাতে কয়েক দফায় ১ কোটি ২৮ লাখ ও ১৪ লাখ টাকা লেনদেন হওয়ার কথা বলতে শোনা যায়।
ফোনালাপে ডিবি কর্মকর্তাদের টাকা দেওয়ার পরও কাঙ্ক্ষিত আচরণ না পাওয়ার অনুযোগ করতে শোনা যায় ওই নারীকে। আর পুরুষ কণ্ঠের ব্যক্তিটি এ বিষয়ে কথা বলতে তার অফিসে যেতে বলছিলেন।
নারী কণ্ঠ: ভাই, আমার লোক তো অসুস্থ হয়ে গেছে চিন্তায়। আপনারে এত টাকা-পয়সা দিলাম, ১৪ লাখ, কিছু ফেরত দিলে আমরা খরচপাতি করি।
পুরুষ কণ্ঠ: ওই যে এক কোটি ২৮ লাখ টাকা দিছেন, ওইটা নেওয়া যায় কিনা, দ্যাখেন দেখি। আর এখানে চাইলে কিছু লাগলে কিছু দেবনে। একটু সময় দেন আমারে। কাল অফিস টাইমে কথা বলি?
নারী কণ্ঠ: আমার ফোনটা একটু ধরিয়েন। দেশি মানুষ। আপনিই ভরসা।
পুরুষ কণ্ঠ: টাকাগুলো যে দিছেন ওইখানে স্যাররে, ওইটা বলব স্যাররে যে, স্যার ওই লোকটারে যে এমন করলেন, টাকাগুলা দেন। ঠিক আছে? তাহলে কালকে কথা বলি আমরা, ওকে? কোনো সমস্যা হবে না।
নারী কণ্ঠ: আপনি কী বুঝতেছেন, আপনি কিছু করতে পারবেন না?
পুরুষ কণ্ঠ: আপনার জামাই সব জানে, তার সাথে কথা বলে নিয়েন। ঠিক আছে?
নারী কণ্ঠ: না, আমি যে ব্যক্তিগতভাবে আপনারে ১৪ লাখ টাকা দিলাম, আপনি ওইটা থেকে কিছু ফেরত দিলে...
পুরুষ কণ্ঠ: আরে ভাই, আমাকে কোথায় টাকা দিলেন? এই টাকাগুলা তো সব ওখানে গেছে।
নারী কণ্ঠ: আলাদা আমি দিয়ে আসলাম না যায়া?
পুরুষ কণ্ঠ: না না না, এগুলো সব ওখানকার টাকা। এগুলো সব সাক্ষাতে এসে কথা বলেন, বুঝায়ে দিচ্ছি আমি।
নারী কণ্ঠ: শোনেন, আগের দিন যে আপনি নিছেন, সবাই মিলে।
পুরুষ কণ্ঠ: রাখেন, কোনো সবাই মিলে-টিলে না রে ভাই...
নারী কণ্ঠ: ওই আপনারা যারা আসছিলেন...
পুরুষ কণ্ঠ: আচ্ছা সাক্ষাতে কথা বলি, এগুলো নিয়ে সাক্ষাতে কথা বলি। কালকে আসেন, অফিসে। এগুলো স্যারদের বলেন। আমি নিজেও তো বলছি।
নারী কণ্ঠ: শোনেন, আপনি আমার দেশি মানুষ। ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে ১৪ লাখ টাকা দিছি না?
পুরুষ কণ্ঠ: না না, ব্যক্তিগত কিছু নাই, এগুলা সব ওইখানকার টাকা। সাক্ষাতে কথা বলেন, কেন এগুলা নিবার পরে মামলা-টামলা হলো, স্যারের সাথে কথা বলেন।
নারী কণ্ঠ: এক কোটি ২৮ লাখ তো নিছেন আপনারা সবাই, আপনাকে ব্যক্তিগতভাবে ১৪ লাখ দিছি না?
পুরুষ কণ্ঠ: ঠিক আছে রাখেন।
আকসাদুরের অভিযোগ
বরখাস্ত এসআই আকসাদুরের দাবি, তার স্ত্রী তাহমিনা আক্তারের সঙ্গে ডিবির এডিসি কায়সার রিজভী কোরায়শির কথোপকথন এটি।
তিনি এক দিন আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার পূর্ব পরিচিত কয়েকজনকে ডিবির দল আটক করে টাকা দাবি করেছিল। ওই ব্যক্তিদের স্বজনেরা তার দ্বারস্ত হলে তিনি টাকা লেনদেনের বিষয়টিতে মধ্যস্থতা করেন।
আকসাদুর বলেন, “ওই লোকগুলো সবাই মিলে কয়েক লাখ টাকা করে দিয়ে তহবিল তৈরি করে। গত বছরের নভেম্বরে আমার খিলগাঁওয়ের বাসায় বসে দুই দফায় ডিবির দলকে এক কোটি ২৮ লাখ টাকা দেওয়া হয়।”
এই টাকা নিয়ে বাগবিতণ্ডার জের ধরে ডিবির দলটি তাকেও আটক করে, বলেন আকসাদুর।
তিনি বলেন, তাকে ছাড়াতে তার স্ত্রী আরও ১৪ লাখ টাকা দিয়েছিলেন।
আকসাদুরের দাবি, টাকা নেওয়ার পরও কয়েকজনকে ডাকাতির মামলায় গ্রেপ্তার দেখায় ডিবি। তখন ওই ব্যক্তিদের স্বজনেরা এসে আকসাদুর ধরেন। তা নিয়েই বিরোধ শুরু হয়।
আকসাদুর দাবি করেন, তিনি ঘটনাটি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানিয়েছিলেন।
রোমান মিয়ার অর্থ লুটের অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
এডিসি কোরায়শির অস্বীকার
ডিবি কর্মকর্তা কায়সার কোরায়শি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মামলায় এসআই আকসাদুরের সংশ্লিষ্টতা আসার পর থেকেই তিনি নানাভাবে অনুরোধ করতে থাকেন, চাপ দিতে থাকেন। এক পর্যায়ে আকসাদুর নানাভাবে হুমকি দেওয়ারও চেষ্টা করেন। যেহেতু তিনি পুলিশে কাজ করেন তাই মামলার অনেক বিষয়ই তার জানা।
“অনেক কিছু করেও মামলা থেকে নিজেকে বাঁচাতে না পেরে আকসাদুর মামলা ও তদন্তকারীদের বিতর্কিত করার জন্য ওই অডিওটি তৈরি করেছেন।”
অডিওতে তার কণ্ঠ ‘ফেব্রিকেট’ করা হয়েছে বলে দাবি কায়সার কোরায়শির।
তিনি বলেন, মামলার ছয় আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তিনজন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।
“প্রযুক্তিগত আরও কিছু প্রমাণাদিও ডিবি পেয়েছে। যা প্রমাণ করে এসআই আকসাদুর ওই অপরাধে যুক্ত ছিলেন।”
আকসাদুরকে গ্রেপ্তার করা হবে বলে জানান কোরায়শি।
কী বলছেন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা
এই ঘটনার বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) এ কে এম হাফিজ আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পুরো বিষয়টি নিয়ে আমরা তদন্ত করছি। মামলার তদন্ত তো চলছেই।
“আর ঘুষের অভিযোগের বিষয়টিও ডিএমপি কমিশনার ওয়াকিবহাল। এ বিষয়টিও আমরা তদন্ত করে দেখছি।”
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম এই ঘটনার বিষয়ে কোনো কথা বলতে চাননি।