জুয়াড়িদের কব্জায় শেয়ারবাজার!
চার বছর ধরে বিনিয়োগকারীদের কোনো লভ্যাংশ দেয় না মিথুন নিটিং। সবশেষ প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী কোম্পানিটি রয়েছে বড় ধরনের লোকসানে। অথচ এ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম গত চার মাসে বেড়েছে ২০০ শতাংশের বেশি।
দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদনে না থাকা এবং বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ না দেওয়া আরেক প্রতিষ্ঠান সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইল। চার বছর ধরে কোম্পানি কোনো আর্থিক প্রতিবেদনও প্রকাশ করে না। অথচ এ প্রতিষ্ঠানটির শেয়ার দাম গত চার মাসে বেড়েছে প্রায় ৩০০ শতাংশ।
শুধু মিথুন নিটিং বা সি অ্যান্ড এ টেক্সটাইল নয়, সম্প্রতি অনেক দুর্বল কোম্পানির শেয়ার দাম এমন অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে। এর মধ্যে রয়েছে আইসিবি ইসলামী ব্যাংক, ফু-ওয়াং সিরামিক, সেলভো কেমিক্যাল, আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, জিবিবি পাওয়ার, এমারেল্ড অয়েল, বাংলাদেশ ন্যাশনাল ইন্স্যুরেন্স, ন্যাশনাল ফিড মিল, পেপার প্রসেসিং অ্যান্ড প্যাকেজিং, ঢাকা ডাইং, ফরচুন সুজসহ আরও বেশকিছু কোম্পানি।
এসব দুর্বল কোম্পানির শেয়ার দাম অস্বাভাবিক বাড়লেও ভালো লভ্যাংশ দেওয়ার পরও অনেক প্রতিষ্ঠানের দাম তলানিতে। এমনকি ১২ শতাংশ লভ্যাংশ দেওয়া প্রতিষ্ঠানের দাম পড়ে রয়েছে ১০ টাকার নিচে। এর মধ্যে সবচেয়ে তলানিতে মিউচ্যুয়াল ফান্ডের দাম।
বিনিয়োগকারীদের ১২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়া গ্রীণ ডেল্টা মিউচ্যুয়াল ফান্ডের দাম দাঁড়িয়েছে ৮ টাকা ৭০ পয়সায়। ১২ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়া আর এক মিউচ্যুয়াল ফান্ড ডিবিএইচ ফার্স্ট’র দাম দাঁড়িয়েছে ৮ টাকা ৮০ পয়সা। একইভাবে ১৩ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়া ফার্স্ট জনতা মিউচ্যুয়ার ফান্ডের দাম পড়ে রয়েছে ৯ টাকা ২০ পয়সায়। ১৩ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়া আরেক মিউচ্যুয়াল ফান্ড ইবিএল ফার্স্টের দাম পড়ে আছে ৯ টাকা ৬০ পয়সায়। ৯ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দেওয়া ট্রাস্ট ব্যাংক ফার্স্ট মিউচ্যুয়ার ফান্ডের দাম ৭ টাকা ৪০ পয়সা।
একদিকে দুর্বল কোম্পানির শেয়ার দাম অস্বাভাবিক বাড়া, অন্যদিকে ভালো লভ্যাংশ দেওয়া প্রতিষ্ঠানের দাম তলানিতে পড়ে থাকাকে অস্বাভাবিক বলছেন শেয়ারবাজার বিশ্লেকরা। তারা বলছেন, এখন শেয়ারবাজার অনেকটাই জুয়াড়িদের দখলে। জুয়াড়িরা যেসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করছে, তার দাম হু হু করে বাড়ছে। ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরাও অধিক মুনাফার আশায় ওই সব দুর্বল কোম্পানিতে বিনিয়োগ করছেন।
তারা আরও বলছেন, শেয়ারবাজারের বর্তমান চিত্র বাজারের স্বাভাবিক পরিবেশ নষ্ট করছে এবং ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। অধিক মুনাফার আশায় যেসব সাধারণ বিনিয়োগকারী অতিরিক্ত দামে দুর্বল কোম্পানির শেয়ার কিনছেন, তারা যে কোনো মুহূর্তে লোকসানের মধ্যে পড়তে পারেন। তাই বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করা অর্থ নিরাপদ রাখা এবং সার্বিক বাজারের স্বার্থে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নজরদারি বাড়ানো উচিত। একই সঙ্গে অস্বাভাবিাক কিছু দেখলে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তা না হলে বর্তমানে বাজারের যে উন্নয়ন দেখা যাচ্ছে তা টেকসই নাও হতে পারে।
তাদের অভিমত, সম্প্রতি কিছু দুর্বল শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বাড়লেও সার্বিক শেয়ারবাজার এখন বিনিয়োগের জন্য যথেষ্ট উপযোগী। তাই বিনিয়োগকারীদের অধিক মুনাফার লোভ পরিত্যাগ করে ভালো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা উচিত। এক্ষেত্রে ভালো কোম্পানির শেয়ার দাম কমে গেলেও চিন্তার কিছু নেই। কারণ বছর শেষে ভালো কোম্পানি থেকে ভালো লভ্যাংশ পাওয়া যাবে।
ডিএসইর এক সদস্য বলেন, এখন বাজারে ফান্ডামেন্টাল বলে কিছু নেই। কোন শেয়ারে পার্টি আছে, সবাই এখন তাই দেখছে। লভ্যাংশ দেয় না, দীর্ঘদিন ধরে উৎপাদন নেই- এমন শেয়ারের দাম হু হু করে বাড়ছে। আবার ভালো লভ্যাংশ দেওয়া প্রতিষ্ঠানের শেয়ার বা ইউনিটের দাম তলানিতে পড়ে থাকছে। যে কারণে অধিক মুনাফার আশায় সাধারণ বিনিয়োগকারীদের একটি বড় অংশ ভালো কোম্পানি ফেলে দুর্বল কোম্পানির শেয়ার কিনছে। এটা কিছুতেই শেয়ারবাজারের জন্য ভালো লক্ষণ নয়।
তিনি আরও বলেন, এখন বাজারে কোন শেয়ার নিয়ে কারা খেলছে সবই ওপেট সিক্রেট। নিয়ন্ত্রক সংস্থাও জানে কে কোন শেয়ার নিয়ে খেলছে। সবকিছুই হচ্ছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চোখের সামনে। কিন্তু এসব বন্ধে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না। এতে সাময়িকভাবে কিছু বিনিয়োগকারী মুনাফা করতে পারলেও সার্বিকভাবে বাজারের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত করছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সাবেক চেয়ারম্যান মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ভালো প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম না বাড়া এবং দুর্বল প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দাম অস্বাভাবিক বাড়া মোটেই শেয়ারবাজারের স্বাভাবিক আচরণ না। বিনিয়োগকারীরা কীসের ভরসায় এখানে (দুর্বল প্রতিষ্ঠান) বিনিয়োগ করেন বুঝি না। দুদিন আগে হোক অথবা পরে- তারা তো মার খাবে। দুদিন পর যখন অন্য বিনিয়োগকারীরা বুঝতে পারবে এটা টেকসই না তখন তারা বিক্রি শুরু করবে এবং দাম পড়ে যাবে। তখন তাদের মূলধন লস হবে।
‘কিছু কিছু শেয়ারের নিয়ন্ত্রণ হয়তো জুয়াড়িদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, তবে সার্বিকভাবে বাজার জুয়াড়িদের নিয়ন্ত্রণে আছে বলে আমার মনে হয় না। আমার কাছে মনে হয় সার্বিকভাবে বাজারের পরিস্থিতি খুব একটা উদ্বেগজনক না। কারণ বাজার যে ওঠা-নামার মধ্যে আছে তা অতিরঞ্জিত না।’
তিনি আরও বলেন, কেন এগুলো হচ্ছে তা বিএসইসি ও স্টক এক্সচেঞ্জের দেখা উচিত। একই সঙ্গে এক্ষেত্রে যে ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত তা নিতে হবে। যেমন মার্জিন ঋণ কমিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও শেয়ারবাজার বিশ্লেষক আবু আহমেদ জাগো নিউজকে বলেন, এখন শেয়ারবাজারে যেসব বিনিয়োগকারী ঢুকছে তাদের টাকা হচ্ছে ৬-১০ লাখ। এরা কম দামের শেয়ার কিনে তাড়াতাড়ি লাভ করতে চায়। এখন এগুলো নিয়ে জুয়া খেলা হচ্ছে। এ কারণে দুর্বল, বন্ধ এমন কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়ে। ভালো কোম্পানির শেয়ার দাম বাড়ে না। কারণ ওখানে জুয়াড়িরা ঢোকে না।
তিনি বলেন, মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির শেয়ার দাম বাড়ে না। মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানি নিয়ে এরা টিটকারি করে। মিউচ্যুয়াল ফান্ডগুলো খুব ভালো লভ্যাংশ দিয়েছে, কিন্তু দামে তার কোনো প্রভাব নেই। সারাজীবন আমরা পড়িয়েছি স্টক প্রাইস বা শেয়ারের দাম নির্ধারিত হয় কোম্পানির আয় এবং কোম্পানি কী দেয় (লভ্যাংশ কী দেয়) তার ওপর। এখন এগুলোর ধারে কাছেও নেই।
‘এটা বাজারের জন্য ভালো সংকেত না। এটা কোনা সুস্থ বাজারের লক্ষণ না। তবে যারা প্রকৃত বিনিয়োগকারী তারা কিন্তু মৌলভিত্তি দেখেন। এরা সাতদিনের জন্য বিনিয়োগ করে না।’
এই শেয়ারবাজার বিশ্লেষক বলেন, তালিকাভুক্ত সরকারি ভালো কোম্পানিগুলোর শেয়ারগুলো বাজারে ছাড়া উচিত। একই সঙ্গে যেগুলো এখনো তালিকাভুক্ত হয়নি, তাদের তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া। সানোফি ও গ্লাক্সো স্মিথক্লাইনের মতো কোম্পানি বিক্রি করে দেশ থেকে চলে গেছে। আর আমরা ওপর দিয়ে বলছি বিদেশি বিনিয়োগ আনো। এখানে যারা বিদেশি বিনিয়োগ করেছে তারাই তো চলে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশের শেয়ারবাজারের বেশিরভাগ ট্রেডার, এরা বিনিয়োগকারী না। যার কারণে তারা লভ্যাংশে ইন্টারেস্টেড (আগ্রহী) না। যেসব শেয়ারের দাম দ্রুত বাড়বে অর্থাৎ যেগুলো নিয়ে ম্যানুপুলেশন (কারসাজি) হচ্ছে সেগুলোতে আমাদের ট্রেডাররা আগ্রহী।
তিনি বলেন, ভালো একটা কোম্পানির শেয়ার দাম কতো বাড়বে? ১০ শতাংশ বা ১৫ শতাংশ। আর ছোট একটা কোম্পানির শেয়ার দাম ১০ টাকা থেকে ৩০ টাকা হয়ে যাচ্ছে। তিনশ শতাংশ দাম বাড়ছে। বাজারে ব্যাপক ম্যানুপুলেশন হয় সব সময়। কোম্পানি আছে কি না তারই খবর নেই, লভ্যাংশ দিতে পারে না। এসব কোম্পানির শেয়ার দাম দ্রুত বাড়ে। কারণ এই বিনিয়োগকারীরা কম দামের শেয়ার কিনতে পারে। বেশি দামের শেয়ার কেনার সামর্থ্য তাদের নেই।
‘এখন বাজার প্রকৃত বিনিয়োগকারী না, জুয়াড়িদের ওপর নির্ভরশীল- এমনটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে। যারা পর্যালোচনা করে ফান্ডামেন্টাল দেখে বিনিয়োগ করবে তাদের লাভ হবে না। জুয়াড়িদের সঙ্গে তালমিলিয়ে বিনিয়োগ করলে বেশি মুনাফা পাবে।’
এই বিশ্লেষক বলেন, এত শিক্ষার পরও আমাদের বিনিয়োগকারীদের চরিত্র বদলায়নি। এখানে আমাদের নিয়ন্ত্রক সংস্থার একটা দুর্বলতাও প্রকাশ পাচ্ছে। এই দুর্বলতা হলো তারা (নিয়ন্ত্রক সংস্থা) ম্যানুপুলেশন বন্ধ করতে পারছে না। আমাদের বিনিয়োগকারীরা যদি বিনিয়োগ করতে যায়, তাহলে তারা (নিয়ন্ত্রক সংস্থা) তো তাদের হাত-পা বেঁধে রাখতে পারবে না। তারা তো জেনে-শুনে বিনিয়োগ করতে যাচ্ছে।
বাজারের এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার উপায় হিসেবে তিনি বলেন, বিনিয়োগকারীদের অল্পদিনের মধ্যে অধিক মুনাফা করার লোভ-লালসা ত্যাগ করতে হবে। একই সঙ্গে নিয়ন্ত্রক সংস্থার মান উন্নয়ন করতে হবে। তারা (নিয়ন্ত্রক সংস্থা) যদি ম্যানুপুলেশন বন্ধ করতে না পারে তাহলে এমনই চলবে বাজার।
এ বিষয়ে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম জাগো নিউজকে বলেন, যেসব বন্ধ ও দুর্বল কোম্পানির শেয়ার দাম সম্প্রতি বেড়েছে আমরা সেগুলোকে নজরদারিতে রেখেছি। কোনো ধরনের কারসাজি থাকলে আমরা তদন্ত করে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো। তবে কেউ যদি কোনো শেয়ার কেনেন আমরা সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারি না।