উপজেলায় যাচ্ছে কৃষি বিপণনের অফিস, সৃষ্টি হচ্ছে ২৩২৫ পদ
যথাযথ বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তুলে প্রান্তিক পর্যায়ে কৃষকের কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে উপজেলা পর্যায়ে হচ্ছে কৃষি বিপণন অধিদফতরের অফিস। এজন্য দুই হাজার ৩২৫টি পদ সৃষ্টি করা হচ্ছে।
কৃষি মন্ত্রণালয় ও কৃষি বিপণন অধিদফতর থেকে এ তথ্য জানা গেছে। কর্মকর্তারা জানান, কৃষি বিপণন অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়, বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা কার্যালয় এবং আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের জন্য ২২৮টি ক্যাডার পদসহ মোট দুই হাজার ৩২৫টি পদ তৈরির সিদ্ধান্ত হয়েছে। পদ তৈরি সংক্রান্ত প্রস্তাব কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।
উৎপাদক, বিক্রেতা ও ভোক্তা সহায়ক কৃষি বিপণন ব্যবস্থা এবং কৃষি ব্যবসা উন্নয়নের জন্য কৃষি বিপণন অধিদফতর প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বর্তমানে অধিদফতরের বিভাগীয় শহরে দফতর ছাড়াও সব জেলায় অফিস রয়েছে। মোট লোকবল আটশ’র মতো।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো প্রস্তাব থেকে জানা গেছে, কৃষি বিপণন অধিদফতরের প্রধান কার্যালয়ের রফতানি উন্নয়ন শাখাসহ অন্যান্য দায়িত্ব পালনের জন্য পরিচালকের একটি পদ (ক্যাডার) সৃষ্টির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এছাড়া প্রধান কার্যালয়ের রফতানি উন্নয়ন শাখার জন্য একটি, ফিল্ড সার্ভিসের একটি, প্রশিক্ষণ ও সমন্বয়ের একটি, কৃষি ব্যবসা উন্নয়ন নিয়ে একটি, সম্প্রসারণ ও রেগুলেশন নিয়ে একটি, আইসিটি নিয়ে একটি—এই ছয়টি উপ-পরিচালকের (ক্যাডার পদ) সৃষ্টি করা হচ্ছে।
সিনিয়র সরকারী পরিচালক বা সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তার পদ সৃজন করা হবে ১০টি। এর মধ্যে প্রধান কার্যালয়ের জন্য দুটি ক্যাডার পদ ও আটটি বিভাগীয় কার্যালয়ের জন্য আটটি ক্যাডার পদ থাকবে।
প্রধান কার্যালয়ের রফতানি উন্নয়ন শাখার জন্য একটি এবং ‘এ’ ক্যাটাগরির ২১২টি উপজেলা কার্যালয়ের জন্য ২১২টি সহকারী পরিচালক/কৃষি বিপণন কর্মকর্তার পদ হচ্ছে। সহকারী পরিচালক (প্রশিক্ষণ)(নন ক্যাডার) পাঁচটি এবং চুয়াডাঙ্গা, সিলেট, বরিশাল ও ময়মনসিংহ আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের জন্য আটটি সহকারী প্রশিক্ষণ কর্মকর্তার পদ সৃষ্টিরও সিদ্ধান্ত হয়েছে।
এছাড়া ৪২টি জেলা কার্যালয়ের জন্য ৪২টি, ‘এ’ ক্যাটাগরির ২১২টি উপজেলা কার্যালয়ের জন্য ২১২টি এবং ‘বি’ ও ‘সি’ ক্যাটাগরির ২৮১টি উপজেলা কার্যালয়ের জন্য ২৮১টিসহ মোট ৫৩৫টি সহকারী কৃষি বিপণন কর্মকর্তার পদ সৃষ্টির সিদ্ধান্ত হয়েছে।
প্রধান কার্যালয়ের রফতানি উন্নয়ন শাখার জন্য একটি এবং ফিল্ড সার্ভিস একটি, প্রশিক্ষণ ও সমন্বয়ে একটি, কৃষি ব্যবসায় একটি, গবেষণায় একটি, সম্প্রসারণ ও রেগুলেশন নিয়ে একটি, নীতি ও পরিকল্পনা নিয়ে একটি, বাজার সংযোগ নিয়ে একটি মিলিয়ে মোট আটটি প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি করা হবে।
ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের জন্য দুটি ও অন্যান্য সাতটি বিভাগীয় কার্যালয়ের জন্য একটি করে সাতটিসহ মোট নয়টি এবং ‘এ’ ক্যাটাগরির ২১২টি উপজেলা কার্যালয়ের জন্য ২১২টি এবং ‘বি’ ও ‘সি’ ক্যাটাগরির ২৮১টি উপজেলা কার্যালয়ের জন্য ২৮১টিসহ সর্বমোট ৫০২টি মাঠ ও বাজার পরিদর্শকের পদ তৈরি হবে।
এছাড়া সাঁটলিপিকার কাম-কম্পিউটার অপারেটরের আটটি, অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটরের ৫০৯টি, গাড়ি চালকের তিনটি, কেয়ারটেকার কাম কুকের চারটি, অফিস সহায়কের ৫০৯টি ও নিরাপত্তা প্রহরীর চারটি পদ সৃষ্টির জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।
কৃষি বিপণন অধিদফতরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মোহাম্মদ ইউসুফ জাগো নিউজকে বলেন, ‘এখন জেলাতে আমাদের অফিসার আছেন মাত্র চারজন। তাদের পক্ষে তো পুরো জেলা কাভার করা সম্ভব নয়। যেভাবে আমাদের উৎপাদন বেড়ে গেছে, বিভিন্ন কৃষি পণ্যের ক্ষেত্রে আমরা অন্যান্য দেশের তুলনায় এগিয়ে আছি। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছে না। উৎপাদিত পণ্যের বাজারজাতকরণ ভালোভাবে হচ্ছে না।’
তিনি বলেন, ‘আমাদের অফিস যদি উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়, এক্ষেত্রে আমাদের অফিসাররা প্রতিটি ইউনিয়নে গিয়ে প্রতিটি কৃষক কী কী পণ্য উৎপাদন করেন, তাকে প্রশিক্ষণ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের সুবিধা দিতে পারবেন। তখন ন্যায্যমূল্য পাওয়ার ক্ষেত্রে একটা পথ বের হয়ে যাবে।’
‘এছাড়া রফতানি বাড়ানোর জন্য রফতানি উইং খোলা হচ্ছে। সেখানেও লোকবল প্রয়োজন।’
এখন প্রধান কার্যালয়সহ সারাদেশে কৃষি বিপণন অধিদফতরের লোকবল আটশ’র মতো জানিয়ে মহাপরিচালক বলেন, ‘আমরা উপজেলা পর্যায়ে অফিস সম্প্রসারণের জন্য আরও দুই হাজার ৩২৫টি পদ সৃজনের প্রস্তাব দিয়েছি। প্রস্তাবটি জনপ্রশাসনে রয়েছে। প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির অনুমোদন লাগবে। এরপর এটি অর্থ মন্ত্রণালয়ে যাবে।’
‘সবাই ইতিবাচক, সবাই এটি উপলব্ধি করছে। আশা করছি উপজেলা পর্যায়ে অফিস করার জন্য আমরা পদগুলো পাব।’
মহাপরিচালক আরও বলেন, ‘স্থানীয় পর্যায়ে কোল্ড স্টোরেজ স্থাপনে আমরা প্রকল্প নিচ্ছি। এছাড়া পেঁয়াজ ও আলু নিয়েও আমরা প্রকল্প নিচ্ছি। ইঞ্জিনিয়ারিং সাইডেও আমাদের লোকবল আরও বাড়াতে হবে। গবেষণার সাইডে লোকবল বাড়াতে হবে। একটা কল সেন্টার করার চিন্তা-ভাবনা করছি। অনলাইন মার্কেটিংয়েও আমরা কাজ বাড়াচ্ছি। সার্বিকভাবে আমাদের নতুন করে অর্গানোগ্রাম চিন্তা করতে হবে। আগে আপাতত আমরা এটা (উপজেলায় অফিস সম্প্রসারণ) করি।’
‘আমরা কৃষিপণ্যের প্রক্রিয়াকরণ নিয়ে কাজ করতে পারছি না। এই ক্ষেত্রটি নিয়ে কাজ করতে হলে আমাদের অ্যাগ্রিকালচার ইঞ্জিনিয়ার লাগবে। বিষয়টি আমরা মাথায় রেখেছি। কৃষির ক্ষেত্রে আমাদের ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ আছে, এখন ফরোয়ার্ড লিংকেজ সৃষ্টি করতে হবে। সেজন্য আমাদের প্রসেসিং, প্যাকেজিং, ল্যাবরেটরি টেস্টিং এগুলো করতে হবে। তাই জেলা ও উপজেলায় লোকবল বাড়াতে হবে। সেই উদ্যোগই আমরা নিয়েছি’—বলেন মোহাম্মদ ইউসুফ।
কৃষি বিপণন অধিদফতরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ইতোমধ্যে কৃষি বিপণন সংক্রান্ত কার্যক্রমে নতুন নতুন ধারা যুক্ত হয়েছে এবং উপজেলা পর্যায়েও তা সম্প্রসারিত হয়েছে। ফলে গুরুত্বপূর্ণ উপজেলা বিশেষ করে ‘এ’ ক্যাটাগরির উপজেলাগুলোতে নবম গ্রেডের ক্যাডার পদ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। সে কারণে দেশের ‘এ’ ক্যাটাগরির ২১২টি উপজেলায় নবম গ্রেডের কৃষি বিপণন কর্মকর্তার ক্যাডার পদ সৃজনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
বর্তমানে সব জেলায় কৃষি বিপণন অধিদফতরের মার্কেটিং অফিস রয়েছে
‘অপরদিকে কৃষি বিপণন আইন-২০১৮’-এ কৃষি পণ্য রফতানির কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত থাকায় এবং কৃষি বিপণন অধিদফতরের পণ্য রফতানি কাজে প্রয়োজনীয় সেবা সুষ্ঠুভাবে দিতে নিয়ম অনুযায়ী মোট আটটি পদ সাংগঠনিক কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করে প্রধান কার্যালয়ের জন্য নতুন একটি রফতানি উন্নয়ন শাখা সৃষ্টি করা প্রয়োজন বলেও জানান ওই কর্মকর্তা।
তিনি আরও বলেন, ‘ইতোমধ্যে চুয়াডাঙ্গা ও সিলেট আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে এবং বরিশাল ও ময়মনসিংহ বিভাগে আরও দুটি আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপিত হচ্ছে। ফলে চারটি আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের জন্য নতুন লোকবল প্রয়োজন।’
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সম্প্রসারণ অনুবিভাগ) মো. হাসানুজ্জামান কল্লোল জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা উপজেলা পর্যায়ে কৃষি বিপণন অধিদফতরের অফিস করতে যাচ্ছি। মার্কেট লিংকেজ করার জন্য আমরা উপজেলা পর্যায়ে লোকবল কাজে লাগাব। পদ সৃজনের আবেদনটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে আছে। খুব বেশি সময় লাগবে বলে মনে করছি না। জনপ্রশাসন এ বিষয়ে অ্যাগ্রি করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের পর এটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদনের জন্য যাবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা যদি বিপণন অধিদফতরে জেলা পর্যায়ে আরও লোক দিতে পারি, উপজেলায় দিতে পারি, তবে কৃষি বিপণনের বিষয়টি আরও ভালোভাবে হ্যান্ডেল করতে পারব। যা কৃষকের ন্যায্যমূল্য পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। আমরা স্থানীয়ভাবে কৃষিপণ্য সংরক্ষণের উদ্যোগ নিচ্ছি, সেই বিষয়ে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করা হবে।’
‘জেলা পর্যায়ে যে কর্মকর্তারা আছেন তারাও উচ্চ পর্যায়ের নন। বিভাগীয় পর্যায়ে উপ-পরিচালকরা আছেন। উপজেলায় কোনো অবকাঠামো নেই। সবগুলো পর্যায়কেই আমরা অ্যাড্রেস করছি। আমরা কৃষি বিপণনকে আরও শক্তিশালী করতে চাই। কৃষকের পণ্যের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা, মার্কেট লিংকেজকে সহায়তা করতে ঢেলে সাজানো হচ্ছে কৃষি বিপণন অধিদফতরকে’—বলেন হাসানুজ্জামান কল্লোল।
কৃষি বিপণন অধিদফতরের উপ-পরিচালক (উপসচিব) ইকবাল হোসেন চাকলাদার বলেন, ‘উপজেলা পর্যায়ে আমাদের কোনো অফিস নেই। আমাদের মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে সমস্যা হচ্ছে। অনেক সময় দেখা যায় কোনো পণ্যের দাম মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যাচ্ছে, আবার কৃষক দাম পাচ্ছে না। উপজেলা পর্যায়ে অফিস থাকলে বাজার সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে বলে আমরা মনে করছি।’
এখন বিপণন অধিদফতরের প্রধান কার্যালয় ও আটটি বিভাগীয় অফিস ছাড়াও ৬৪ জেলায় অফিস আছে। এছাড়া চট্টগ্রামের পটিয়া, কাপ্তাই, লামা, রামু উপজেলায় অফিস আছে বলেও জানান উপ-পরিচালক।