নদীতে মাছের আকাল ॥ হতাশ জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা
চাঁদপুরে গত দুই সপ্তাহ ধরে মেঘনা নদীতে ইলিশসহ সব ধরনের মাছের আকাল চলছে। মাছ না পাওয়ায় হাজার হাজার জেলে পরিবারের মাঝে হতাশা বিরাজ করছে। মাছ ঘাটগুলোতে ইলিশের আমদানী না হওয়ায় অলস সময় কাটাচ্ছে জেলে, ইলিশ বেপারী, চালানী, আড়তদার ও শ্রমিকরা। নদ-নদীর মাছের এই দুষ্প্রাপ্যতায় যতসামান্য পরিমাণ মাছ যে হাটে, বাজারে এবং ঘাটে আসে তার দাম অস্বাভাবিক।
গুড়া চিংড়ির কেজি ৭/৮শ’ টাকা, পোয়া মাছ ৮শ’ থেকে হাজার টাকা আর ইলিশের কেজি তার চেয়েও বেশি। সাধারণ মানুষ পুকুর, ডোবা-নালা, ঝিলে এবং ভাসমান খাঁচায় চাষ করা হাইব্রীড মাছ তেলাপিয়া, পাঙ্গাস, রুই কাতলাসহ চাষের মাছ খেয়ে আমিষের চাহিদা মিটাচ্ছে। আর হতদরিদ্র পরিবারগুলোর আর্থিক দুরবস্থার কারণে পঁচা মাছই তাদের ভরসা। তবে ভারি বৃষ্টিপাত না হওয়ায় নদীতে নতুন পানি আসেনি।
নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ার কারণে মাছের এই আকাল বলে জানিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ আসাদুল বাকী। তিনি বলেন, গতবছর এপ্রিলের মাঝামাঝিতে প্রচুর বৃষ্টি দেখা গেছে। এবার এপ্রিল-মে চলে যাচ্ছে বৃষ্টিপাত নেই। সাগরে আবার মাছ ধরা বন্ধের অভিযান চলছে। তবে পানি বাড়লে মাছের দেখা মিলবে বলে আশা করেন তিনি।
জেলা মৎস্য অধিদপ্তর জানায়, এ জেলায় প্রায় ৫১ হাজারের উপরে নিবন্ধিত জেলে রয়েছে। এদের অধিকাংশই মেঘনা নদীতে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে। মতলব উত্তরের ষাটনল হতে লক্ষ্মীপুর জেলার চরআলেকজান্ডার পর্যন্ত ১শ’ কিঃ মিঃ মেঘনা নদী এলাকায় মাছ শিকার করে থাকেন এখানকার জেলেরা। জাটকা সংরক্ষণ ও ইলিশের উৎপাদনের লক্ষ্য গত মার্চ-এপ্রিল দু’মাস সব ধরনের মাছ ধরা নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু নিষেধাজ্ঞা উঠে যাওয়ার ২৬ দিন পার হলেও জেলেদের জালে মিলছে না ইলিশ। আনন্দবাজার, কানুদী, সফরমালী, আমিরাবাদ, রাজরাজেশ^রচর, ঈদগাহ ফেরিঘাট, আলুরবাজার, পুরাণবাজার রণাগোয়াল, দোকানঘর, বহরিয়া, হরিণা, আখনেরহাট, হাইমচরের কাটাখালি, ঈশানবালা, চরভৈরবীসহ বিভিন্ন ঘাটে এবং প্রধান ইলিশ বাণিজ্য কেন্দ্র চাঁদপুর মাছঘাট ঘুরে দেখা যায়, ঘাটে তেমন মাছ নেই বললেই চলে। জেলে ও আড়তদাররা অলস সময় পার করছেন। ঘাটের লেবাররাও বসে শুয়ে আড্ডা দিয়ে সময় পার করছেন আর মাছের আশায় আছেন। এ সময় হরিণাঘাটের উঃ গোবিন্দিয়ার জেলে মুসলিম দিদার, জাহাঙ্গীর চকিদার, রহমান শেখ, আড়তদার মনির শেখসহ অনেক জেলে অভিযোগ করে বলেন, নিষেধাজ্ঞা উঠে গেছে অনেক আগে কিন্তু নদীতে মাছ নেই। সারাদিন নদীতে জাল ফেলে এবং মাছ শিকার করলে দুই/চারটা মাছ পাওয়া যায়। এ দিয়ে ইঞ্জিন চালিত নৌকার তেলের খরচও মেটানো যায় না। গত দুই সপ্তাহ ধরে হঠাৎ করে নদীতে মাছ নেই। সারাদিন জাল বেয়ে ৫/৬শ’ টাকার মাছ ছোট জেলের এবং দেড়/২ হাজার টাকার মাছ পাচ্ছে গুল্টি জেলেরা।
এদিকে জেলেদের জালে ইলিশ মাছ ধরা না পড়ায় তারা চরম বিপাকে পড়েছে। অপরদিকে জেলেদের দাদন দিয়ে এখন বেকাদায় পড়ছে দাদন ব্যবসায়ীরা। মাছ ধরা না পড়ায় তারা মহাজনের দাদনের টাকা পরিশোধ করতে পারছে না। মাছ ধরা পড়ার খবর না থাকায় অনেক জেলে নদীতে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। এতে মহাজনের দাদনের টাকা পরিশোধ নিয়ে তারা বিপাকে পড়েছে। বর্তমানে জেলেরা পরিবার পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন। সামনে ঈদ। চরম দুশ্চিন্তায় আছেন জেলেরা। জাটকা নিধনের ফলে মাছের আকাল বলেও দাবি করেন তারা।
চাঁদপুর মৎস্য বণিক সমবায় সমিতি লিঃ-এর সাধারণ সম্পাদক শবেবরাত সরকার জানান, এ সময়ে ঘাটে ভরপুর মাছ থাকার কথা। সব মিলিয়ে ঘাটে ৫ মণ ইলিশও আসছে না। তবে পানি বাড়লে আর বৃষ্টি হলে জ্যৈষ্ঠ মাসের শেষে মাছ ধরা পড়ার আশা করছেন তারা।
চাঁদপুর মৎস বণিক সমবায় সমিতির পরিচালক মাসুম মিয়া মাসুদ বলেন, দুই মাসের অভিযানের সময় অবৈধ জেলে ও চালানিরা নদীর মাছ সব শেষ করে ফেলেছে। আবার সাগরে মাছ ধরা বন্ধ, মাছ পাইব কোথেকে।
মাছঘাটের আড়তদার সিরাজ চোকদার (ছোট) জানান, নদীতে মাছ নেই বললেই চলে। আড়তের দৈনিক খরচের টাকা পাই না, বেকাদায় আছি।
ইলিশ পাইকার রফিক, আজিজুল হক ও কালা মোল্লা জানান, এবার অভয়াশ্রমের সময় জাটকাসহ রিডা, পোয়া, শিলং, পাঙ্গাস, তপসী ও চিংড়ি মাছ যেই মিলে ধরা হইছে, মাছের সর্বনাশ হয়ে গেছে। এখন হায় হুতাশ আমাগো।
মাছ একেবারেই কম। আধা কেজি ওজনের ইলিশের মণ ৩৪/৩৫ হাজার টাকা। ৭/৮শ’ গ্রাম সাইজের মাছের মণ ৪৮ থেকে ৫০ হাজার টাকা। শরীয়তপুরের চাষের মাছ আসায় ঘাটের অবস্থা কিছুটা টিকে আছে। এখন দেখার অপেক্ষা সামনের দিনগুলোতে মাছের আমদানী বাড়ে কিনা।