হাতের ইশারায় চলে গাড়ি বাতির পেছনে ব্যয় বছরে ১২ কোটি টাকা
ঢাকার ট্রাফিক সিগনাল বাতি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণে বছরে প্রায় ১২ কোটি টাকা ব্যয় করছে দুই সিটি করপোরেশন। তার পরও কাজে আসছে না এ সিগনাল বাতি। বছর বছর বড় অংকের অর্থ ব্যয় করেও এখনো হাতের ইশারায় নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে ঢাকার ট্রাফিক। এ অবস্থায় সিগনাল বাতির পেছনে ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন উঠছে।উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন মিলিয়ে রাজধানীতে সিগনাল বাতি রয়েছে ১০০ পয়েন্টে। এর মধ্যে উত্তরে পড়েছে ৬০টি। বাকি ৪০টি দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে (ডিএসসিসি)। ২০০৪ সালের পর থেকে বিভিন্ন সময় এসব বাতি স্থাপন হয়েছে। সিগনাল বাতির পাশাপাশি স্থাপন হয়েছে ‘টাইমার কাউন্টডাউন’ যন্ত্র। এসব খাতে ব্যয় হয়েছে অর্ধশত কোটি টাকার উপরে।স্থাপন করার পর থেকে বাতিগুলো সচল রাখতে প্রতি মাসে মোটা অংকের অর্থ খরচ করছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রতিটি পয়েন্টে সিগনাল বাতির বিদ্যুৎ বিল, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণে মাসে ব্যয় হচ্ছে ১ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ঢাকার সিগনাল বাতিগুলোর পেছনে মাসে ১ কোটি ও বছরে ১২ কোটি টাকা খরচ হচ্ছে। তবে সিগনাল বাতিতে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ না হওয়ায় প্রায় পুরো টাকাই গচ্চা যাচ্ছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মীর রেজাউল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, সিগনাল বাতিগুলো তত্ত্বাবধান করে সিটি করপোরেশন। যদিও বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এ দায়িত্ব ট্রাফিক পুলিশই পালন করে থাকে। বাতির মাধ্যমে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করতে হলে এ দায়িত্ব শতভাগ ট্রাফিক পুলিশের কাছেই হস্তান্তর করতে হবে। তবেই এ খাতের বাড়তি ব্যয় কমিয়ে আনা যাবে।ঢাকার রাস্তায় ব্যাপকভিত্তিক ট্রাফিক সিগনাল স্থাপন শুরু হয় ২০০৪ সালের পর থেকে। ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের আওতায় ২০০৪ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রায় ১৪ কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপন করা হয় ৫৯টি সিগনাল বাতি। ২০০৯ সালে বিশ্বব্যাংকের ঋণসহায়তায় ক্লিন এয়ার অ্যান্ড সাসটেইনেবল এনভায়রনমেন্ট (কেস) প্রকল্পের আওতায় স্থাপন করা হয় ১০০টি স্বয়ংক্রিয় ট্রাফিক সংকেত ব্যবস্থা। তবে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় এসব সিগনাল বাতি কোনো কাজেই আসেনি। সিগনাল বাতির ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের অভিজ্ঞতা, অর্থ ও দক্ষতার অভাবে এসবের সুফল পায়নি রাজধানীবাসী। হাতের ইশারাতেই যান নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে এখনো।
রাজধানীর ব্যস্ততম সিগনাল বিজয় সরণি। গুরুত্বপূর্ণ আটটি সড়ক এসে মিশেছে এ সিগনালে। প্রতিটি সড়কের মুখেই রয়েছে লাল, সবুজ ও হলুদ বাতি। রয়েছে টাইম কাউন্টডাউন যন্ত্রও। সবকিছু থাকার পরও সেখানে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে ট্রাফিক পুলিশের হাতের ইশারায়।শুধু বিজয় সরণির সিগনালেই নয়, এমন চিত্র রাজধানীর গুলশানের দুটি বাদে সব সিগনালেই। পুলিশ বলছে, প্রকল্প শেষ হলেও এখনো সিগনাল বাতির নিয়ন্ত্রণ তাদের বুঝিয়ে দেয়া হয়নি। যার ফলে হাতের ইশারাতেই ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করতে হচ্ছে।রাজধানীর যান চলাচলে শৃঙ্খলা আনতে ২০১৫ সালের ১৭ মে পরীক্ষামূলকভাবে কাকলী থেকে শাহবাগ পর্যন্ত ১১টি পয়েন্টে অটোসিগনালও চালু করা হয়। তবে যানজটের শঙ্কায় চালুর পর পরই এগুলোর ব্যবহারও বন্ধ হয়ে যায়।২০১৮ সালের শুরুতে নতুন করে হাতে নেয়া হয় আরো একটি প্রকল্প। নতুন এ প্রকল্পে আগের মতো যন্ত্রনির্ভর না হয়ে যন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা ট্রাফিক পুলিশের হাতে রাখার কথা বলা হয়। সড়কে গাড়ির চাপ বুঝে রিমোটের সাহায্যে ট্রাফিক নিজেই পরিবর্তন করতে পারবে সিগনালের ব্যাপ্তি। তবে প্রকল্প শেষ হলেও কার্যকর না থাকায় কোনো সুবিধাই পাচ্ছে না রাজধানীবাসী।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী ব্রিগেডিয়ার জেনারেল যুবায়ের সালেহীন বণিক বার্তাকে বলেন, ট্রাফিক সিগনাল বাতি আধুনিকায়নের সর্বশেষ প্রকল্পটিও শেষ হয়েছে মার্চে। কিন্তু এখনো আমরা নিজেদের ইন্টারসেকশনগুলো বুঝে পাইনি। দায়িত্ব বুঝে না পাওয়ায় এখনো উত্তরের সিগনাল বাতিগুলো সেভাবে কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।জানা গেছে, রাজধানীর ট্রাফিক সিগনাল বাতির পেছনেই এখন পর্যন্ত ১০০ কোটি টাকার বেশি বিনিয়োগ হয়েছে। এর বাইরে ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে ২৫ কোটি টাকায় সাতরাস্তা থেকে উত্তরা পর্যন্ত ১১টি ইউলুপ নির্মাণ করেছে ডিএনসিসি। ১৬৫ কোটি টাকায় শাহবাগ, শেরাটন, বাংলামোটর ও সোনারগাঁও ইন্টারসেকশনে আন্ডারপাস নির্মাণের আরেকটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। ৩৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ঢাকার চারটি সিগনালে স্থাপন করা হচ্ছে ইন্টেলিজেন্ট ট্রাফিক সিস্টেম (আইটিএস)। ফ্লাইওভার, সড়ক, ইউটার্ন, ইন্টারসেকশন, ফুটপাত, ড্রেন, মেট্রোরেল, বাস র্যাপিড ট্রানজিট, রেলপথ, বৃত্তাকার রেলপথ—যানজট নিয়ন্ত্রণ ও ট্রাফিক ব্যবস্থার উন্নয়নে গত ১০ বছরে প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে সরকার। এর মধ্যে মেট্রোরেল, বাস র্যাপিড ট্রানজিট, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ কয়েকটি মেগা প্রকল্প রয়েছে বাস্তবায়নাধীন অবস্থায়।আইটিএস একটি পরীক্ষামূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। এর মাধ্যমে ক্যামেরা (সিসি ক্যামেরা) বা রাস্তায় বসানো ভেহিকল ডিটেক্টরের (গাড়ি শনাক্তকরণ যন্ত্র) মাধ্যমে যানবাহনের সংখ্যা হিসাব করার কথা। নির্দিষ্ট সময়ে একটি লেন দিয়ে কতগুলো গাড়ি পার হলো, সে হিসাব রাখে এ যন্ত্র। এ অনুযায়ী যে লেনে চাপ বেশি থাকে, সেদিকের গাড়িগুলোর জন্য জ্বলে ওঠে সবুজ সিগনাল বাতি। কোনো গাড়ি ট্রাফিক আইন অমান্য করলে সেটিকে শনাক্ত করে। রাস্তায় থাকা পথচারীদেরও হিসাব করে আইটিএস। সে অনুযায়ী সংকেত দেয় পথচারী পারাপারের। সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হয় একটি কন্ট্রোল রুম থেকে। পরীক্ষামূলকভাবে ঢাকার মহাখালী, গুলশান-১, পল্টন ও ফুলবাড়িয়ায় আইটিএস স্থাপন হওয়ার কথা থাকলেও থমকে আছে প্রকল্পের কাজ।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মিজানুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, শুধু ট্রাফিক সিগনাল বাতি স্থাপন করলেই হবে না। সেগুলো ব্যবহারের জন্যও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। ব্যবহারে কঠোর আইন প্রয়োগের বদলে আগে মানুষের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। কিন্তু এ কাজটাই আমরা ঠিকমতো করতে পারছি না। ট্রাফিক আইন ভঙের যে প্রবণতা, সেটি থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে যত উদ্যোগই নেয়া হোক না কেন, সেটি কার্যকর করা কঠিন হবে।বণিক বার্তা