কেন এমন নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার শিশু মুনতাহা
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কয়েক দিন ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছিল নিখোঁজ মুনতাহা আক্তার জেরিনের (৬) ফুটফুটে একটি ছবি। মুনতাহার হাসিমাখা মুখের ছবি যার দৃষ্টিতে পড়েছে তাকেই থমকে দীর্ঘ নিশ্বাস নিতে হয়েছে। শিশুটিকে জীবিত খুঁজে পেতে তার জন্য মানুষ প্রার্থনা করেছে। কেউ কেউ ঘোষণা করেছে পুরস্কারও।
কিন্তু নিখোঁজের ছয় দিন পর সবার আকুতি মিথ্যা করে দিয়ে শেষ পর্যন্ত মুনতাহার মরদেহ খুঁজে পাওয়া গেছে। শিশুটিকে হত্যা করা হয়েছে। গত শনিবার দিবাগত রাত ৪টার দিকে শিশু মুনতাহার মরদেহ খুঁজে পাওয়া যায় তাদের বাড়ির পাশের ডোবায়।
এদিকে এ ঘটনায় অভিযুক্ত প্রতিবেশী মর্জিনা বেগমসহ (২৬) চারজনকে আটক করেছে পুলিশ। আটক অন্যরা হলেন- মর্জিনার মা আলিফজান বেগম, প্রতিবেশী নাজমা বেগম ও ইসলাম উদ্দিন। এ ছাড়া আরও কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নেওয়া হয়েছে।
মুনতাহা কানাইঘাট সদরের বীরদল ভাড়ারিফৌদ গ্রামের শামীম আহমদের মেয়ে। গত ৩ নভেম্বর সকালে বাবার সঙ্গে স্থানীয় একটি ওয়াজ মাহফিলে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফিরে প্রতিবেশী শিশুদের সঙ্গে খেলতে যায় মুনতাহা। এরপর আর তার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছিল না। ধারণা করা হচ্ছে ওই দিনই মুনতাহাকে অপহরণের পর হত্যা করে মরদেহ গুম করতে বাড়ির পাশের ডোবায় পুঁতে রাখা হয়েছিল।
মুনতাহার করুণ এই পরিণতি মেনে নিতে পারছেন না কেউ। মেয়ের মরদেহ দেখার পর থেকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন মা রামিমা বেগম। নির্বাক পাথরের মূর্তি হয়ে আছেন তিনি। মুনতাহার বাবা শামীম আহমদও পাগলপ্রায়। কথা বলার চেষ্টা করেই কান্নায় ভেঙে পড়ছেন। চোখের জল ফেলছেন আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরাও।
বিজ্ঞাপন
মেয়ের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন মুনতাহার বাবা শামীম আহমদ। তিনি বলেন, আমার ফুলের মতো বাচ্চাটাকে কেন এভাবে হত্যা করা হলো? আমি এর সুষ্ঠু বিচার চাই।
তিনি আরও বলেন, নিখোঁজের পর থেকে আমার মেয়েটা সারা দেশের মানুষের সন্তান হয়ে গেছে। নিখোঁজের পর দেশবাসী যেভাবে তার সন্ধানে এগিয়ে এসেছে, সহযোগিতা করেছে, ভালোবেসেছে, তাতে আমার মনে হয়েছে মুনতাহা সবার সন্তান।
মুনতাহার ফুফু ফাতেমা জান্নাত বলেন, কেন আমার ভাতিজিকে হত্যা করা হলো? মর্জিনা তো বাসায় এসে মুনতাহাকে পড়াত। তাকে ঘুরতে নিয়ে যেত। সে কীভাবে এ কাজ করল?
পূর্বশত্রুতা ছিল কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, সে রকম কিছু ছিল না। পড়ানো শেষে প্রায়ই মর্জিনা কাউকে না জানিয়ে মুনতাহাকে নিয়ে বেড়াতে চলে যেত। বারবার নিষেধ করেও কাজ হয়নি। পরে মুনতাহার বাবা তাকে গৃহশিক্ষকের কাজ থেকে বাদ দেয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে সে এ কাজ করল কি না বুঝতে পারছি না।
মর্জিনা স্থানীয় মাদরাসায় নবম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছে জানা গেছে।
পুলিশ ও মুনতাহার প্রতিবেশীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৩ নভেম্বর মুনতাহাকে অপহরণের পর ওই দিন মাগরিবের পর মুনতাহাকে গলা টিপে হত্যা করা হয়। এরপর রাতে তাকে বাড়ির পাশের একটি ডোবায় পুঁতে রাখা হয়। মর্জিনার কথাবার্তায় সন্দেহ দেখা দিলে গত শনিবার রাতে পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যায়। ঘটনা জানাজানি হয়ে যেতে পারে এই ভয়ে মর্জিনার মা অলিফজান রাত ৪টার দিকে ডোবা থেকে মুনতাহার মরদেহ তুলে পাশের পুকুরে ফেলে দিতে যাচ্ছিলেন। এ সময় স্থানীয়রা সেটি দেখে তাকে আটক করে পুলিশে খবর দেয়। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ জনতা আলিফজানের ঘরে আগুন দেয়। পরে পুলিশ এসে তাদের নিবৃত্ত করে।
পুলিশ জানায়, মরদেহ উদ্ধারের সময় মুনতাহার শরীর কাদায় লেপ্টে ছিল। গলায় রশি জাতীয় কিছু পেঁচানো ছিল।
এ বিষয়ে কানাইঘাট থানার ওসি আব্দুল আউয়াল বলেন, রাত সাড়ে ৩টার দিকে এক মহিলা মুনতাহার বাড়ির পাশের একটি ডোবা থেকে মরদেহ উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। সম্ভবত পুকুরে ফেলে দেওয়ার জন্য মরদেহটি তোলা হয়েছিল। তখন স্থানীয় লোকজন বিষয়টি দেখে ফেলে। আর আমরা আগে থেকে এলাকার কিছু মানুষকে বলে রেখেছিলাম পাহারা দেওয়ার জন্য। সে অনুযায়ী লোকজন পাহারায় ছিল। এ ঘটনায় জড়িত সন্দেহে চারজনকে আটক করেছি। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
এদিকে ঠিক কী কারণে মুনতাহাকে হত্যা করা হয়েছে এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। গৃহশিক্ষকের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ায় এই হত্যাকাণ্ড কি না সেই প্রশ্ন বেশি ঘুরপাক খাচ্ছে। নিহত মুনতাহার পরিবারও এর বাইরে কোনো বিরোধের কথা মনে করতে পারছে না। একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, এখন পর্যন্ত জিজ্ঞাসাবাদে হত্যার কারণ খুব বড় কিছু বলে মনে হচ্ছে না। সম্ভবত তুচ্ছ কারণেই এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটতে পারে।
সিলেট জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড অপস), রফিকুল ইসলাম বলেন, এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে তুচ্ছ কারণেই এই হত্যার ঘটনা ঘটেছে। আমরা অভিযুক্ত মর্জিনা ও তার মাকে আটক করেছি। সঙ্গে আরও দুজনকে আটক করেছি। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।
এ বিষয়ে রোববার বিকেলে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন সিলেটের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান। তিনি বলেন, সিলেট জেলা পুলিশ প্রথম থেকে বাচ্চাটিকে উদ্ধারে চেষ্টা চালিয়েছে। আমাদের সব সোর্সকে কাজে লাগিয়ে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু বাচ্চাটিকে আমরা জীবিত উদ্ধার করতে পারিনি। প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে এই হত্যাকাণ্ডে একজনই প্রত্যক্ষভাবে জড়িত।