চাঁদপুরে সরকারি তিন বিভাগের বিশাল সম্পত্তি জবর দখল
চাঁদপুরে সরকারি তিন বিভাগের শত শত একর ভূমি বেদখল হয়ে আছে। সড়ক ও জনপথ (সওজ), রেলওয়ে এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের নানা স্থানে কয়েক হাজার একর জমি ও স্থাপনা ক্রমান্বয়ে দখল হয়ে গেছে। এখনো চলছে সেই দখল প্রক্রিয়া। চলছে স্থাপনা গড়ে তুলে ভাড়া বাণিজ্য। আইনি প্রক্রিয়ায় আটকে থাকছে এসব স্থাপনার বিষয়ে বিভিন্ন মামলা।
চাঁদপুরে রেলওয়ের সম্পত্তি শুধু অবৈধ দখল নয়, বিক্রিও হচ্ছে প্রকাশ্যে। এর সাথে প্রভাবশালী, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী, এমনকি জনপ্রতিনিধির সংশ্লিষ্টতা থাকায় দখল প্রক্রিয়া সহজ হচ্ছে। চাঁদপুর-লাকসাম রেলপথের দুই পাশের জায়গা দখল করে গড়ে তোলা হচ্ছে অবৈধ স্থাপনা। বেদখল হচ্ছে রেলওয়ের বিভিন্ন পুরানো স্থাপনা ও সম্পত্তি। চাঁদপুর শহরেই রেলওয়ের বিভিন্ন স্থাপনা দখল করে আছে প্রভাবশালী বেশ কিছু ব্যক্তি ও পরিবার। কেউ কেউ এসব কোয়ার্টার দখল করে অন্যত্র ভাড়া বাণিজ্য করছেন।
বর্তমানে চাঁদপুর-লাকসাম রেলপথের ৫২ কিলোমিটারের দূরত্বের খুব কাছ ঘেঁষে গড়ে উঠেছে হাজার হাজার অবৈধ স্থাপনা। শুধু তাই নয়, রেলওয়ের সম্পত্তি দখল করে রেললাইনের পাশ ঘেঁষে গড়ে উঠেছে হাট-বাজার। অথচ এসব অবৈধ স্থাপনার ব্যাপারে নেই রেল বিভাগের কোনো তৎপরতা।
চাঁদপুর-লাকসাম রুটে প্রায় ৪শ অবৈধ স্থাপনা রয়েছে, যা উচ্ছেদের জন্য প্রক্রিয়ায় রয়েছে বলে জানান এ অঞ্চলের লাকসাম কাচারীর কানুনগো ইকবাল মাহমুদ। তিনি আরো জানান, দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরই এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হবে। তিন বছর আগে চাঁদপুর শহরতলীর মুন্সিবাড়ি এলাকায় দ্রুতগতির ট্রেনের ধাক্কায় প্রাণ যায় মেহেদী হাসান রুবেল নামে এক যুবকের। চাঁদপুর পৌর ১৩নং ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। এক বোন দুই ভাইয়েরর মধ্যে সে ছিলো সবার বড়। বিধবা স্ত্রী ও অয়ন (৭) নামে একটি পুত্র সন্তান রয়েছে প্রয়াত এই ছাত্রলীগ নেতার। রেল কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে এমন অপ্রত্যাশিত মৃত্যুর ঘটনায় মানুষের মাঝে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয় সে সময়। অবৈধ রেলক্রসিংয়ে কোনো গেইট কিংবা গেইটম্যান নেই। পরবর্তীতে ওইস্থানে সাবধানতা সম্বলিত সাইনবোর্ড স্থাপন ছাড়া আর কোনো কিছু করেনি রেল কর্তৃপক্ষ। অথচ সেখানে অসংখ্য অবৈধ দোকানপাট গড়ে উঠেছে। যার জন্য আপ-ডাউনে ট্রেন আসছে কিনা তা দেখার সুযোগ নেই ওই ক্রসিংয়ের পাশে গড়ে তোলা এসব স্থাপনার জন্যে।
এদিকে চাঁদপুরে সড়ক ও জনপথ বিভাগের অধীনে বিভিন্ন নামে ২০টি সড়কে মোট ৩৬৯.৫৬২ কি. মি. সড়ক রয়েছে। এসব সড়কের প্রায় অধিকাংশ এলাকার দুপাশ বেদখল হয়ে আছে। কোথাও কোথাও সওজ কর্তৃপক্ষকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে গড়ে তোলা হচ্ছে এসব অবৈধ স্থাপনা। হয়েছে মার্কেটসহ নানা বাণিজ্যিক স্থাপনা।
ফরিদগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে ফের নির্মাণ করা হয় দোকান। ফরিদগঞ্জে সওজ কর্তৃপক্ষ যেনো অসহায়! নিজেদের ভূমি বেদখল থেকে মুক্ত করতে যথাযথ কর্তৃপক্ষের সহযোগিতা পাচ্ছে না। সহযোগিতা চেয়ে বিভিন্ন বিভাগের প্রধানের কাছে লিখিতভাবে জানানোর পরও সহযোগিতা পায়নি বলে জানায় চাঁদপুর সওজ। ফরিদগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় সওজের জায়গা দখল করে অবৈধভাবে স্থাপনা গড়ে তুলছেন ক’জন প্রভাবশালী। সওজের স্থানে অবৈধ স্থাপনা গড়ে উঠছে এমন সংবাদ পেয়ে সেখানে ছুটে আসেন মামুন নামের চাঁদপুর সওজের এক কর্মকর্তা। কিন্তু দখলদাররা তাকে সেখানে অপদস্থ করে। তারপর তিনি প্রতিকার চেয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার, উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়র এবং থানার অফিসার ইনচার্জ বরাবর লিখিত আবেদন করেন।
জেলা সওজ সূত্রে জানা যায়, চাঁদপুরে ২২৬ শতাংশ ভূমি বেদখলে আছে। প্রায় ৩৭৮টি অবৈধ স্থাপনা তালিকাভুক্ত করা হয়েছে এবং প্রায় সাড়ে তিনশ’ মামলা চলমান রয়েছে।
এদিকে চাঁদপুরের দু’টি সেচ প্রকল্পের অভ্যন্তরে বিপুল পরিমাণ জমি ও বেড়িবাঁধের দুই পাশ দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে অসংখ্য অবৈধ স্থাপনা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। দখল হয়ে আছে বোরোপিট খাল ও বনায়ন এলাকা। ১৯৭৮ সালে চাঁদপুর ও লক্ষ্মীপুর জেলার ৬টি উপজেলার ৫৩ হাজার হেক্টর জমি নিয়ে চাঁদপুর সেচ প্রকল্প এবং ৬০ কিঃ মিঃ নিয়ে মতলবে মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প গড়ে তোলা হয়। এ দুটি প্রকল্পের প্রায় কয়েক হাজার একর সরকারি জমি বেহাত হয়ে গেছে এবং তা এখনো চলমান রয়েছে। কিন্তু নিয়মতান্ত্রিক নানা জটিলতায় এসব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা সম্ভব হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট দপ্তর সূত্রে জানা যায়।
আরো জানা যায়, বর্তমানে এই দখল প্রক্রিয়ার অনেক অভিযোগের তালিকা জেলা প্রশাসকের দপ্তরে জমা আছে। বর্তমানে এ দুটি সেচ প্রকল্পের অভ্যন্তরে যে যার সুযোগ মতো দখল করে রেখেছে। অনেকে অবৈধভাবে স্থাপনা গড়ে তুলে ভাড়া বাণিজ্য চালিয়ে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনে গেছেন। শুধুমাত্র চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের অভ্যন্তরে ৯৯১টি অবৈধ দখলদারের তালিকা রয়েছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। এদেরকে অবৈধ দখলমুক্ত করতে নোটিশ প্রদান করা হয়েছে বলে জানান ওই সেচ প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলাম। অথচ এসব তালিকার তিন গুণ অবৈধ দখলদার রয়েছে, যারা অসংখ্য স্থাপনা গড়ে তুলেছেন ও জমি বেদখল করে বাণিজ্য করে আসছেন।
অপরদিকে ৪ হাজার একর জমি নিয়ে গঠিত মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের অভ্যন্তরে ৬৪২টি অবৈধ স্থাপনার তালিকা রয়েছে বলে জানা যায়। এসব স্থাপনা বা সেচ প্রকল্পের সরকারি জমি নিয়ে ল্যান্ড সার্ভে কিংবা দেওয়ানি মামলা চলমান আছে ৬৮টি বলে জানান ওই প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী জয়ন্তু পাল। তিনি আরো জানান, গত এক বছরে এ পর্যন্ত উচ্ছেদ মামলা করা হয়েছে ১৫টি। প্রকল্পের অভ্যন্তরে অব্যবহৃত জমি সাময়িক ব্যবহারের জন্যে প্রায় ৮শ’ আবেদন জমা আছে। যা উক্ত বিভাগের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে বলে তিনি জানান।