চাঁদপুরে বাড়ছে দুই ধরনের ভিক্ষুক
যোগাযোগ সুবিধার ট্রানজিটে চাঁদপুর দেশের গুরুত্বপূর্ণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে এ জেলায় নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা না থাকায় আয়শূন্য হয়ে পড়েছে বহু নারী- পুরুষ। কিছু কিছু এলাকায় নদী ভাঙ্গনে ছিন্নমূল হচ্ছে মানুষ। তাইতো বাড়ছে ভিক্ষুকের সংখ্যা। কাজ না পেয়ে পথে পথে ভিক্ষা করছেন হতদরিদ্ররা। এখানে এখন স্থায়ী ও নিবন্ধিত ভিক্ষুকের চেয়ে ভাসমান ভিক্ষুকই বেশি। সাথে যোগ হয়েছে পাশর্^বর্তী বিভিন্ন জেলা থেকে আসা ছিন্নমূল মানুষজনও। তারা এখন গ্রামের বিভিন্ন বাড়িতে বাড়িতে না গিয়ে শহর ও বাজারমুখী হচ্ছেন ভিক্ষাবৃত্তিতে। জেলা শহর ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের বাজারগুলোতে আগের চেয়ে তুলনামূলক ভিক্ষুক বেড়েছে কয়েকগুণ। তারা শহরের অলি-গলি ও বাজারের দোকানে আগত ক্রেতাদের কাছে হাত বাড়াচ্ছেন ভিক্ষার আশায়।
শুধু এ জেলার ভাসমান বা নিবন্ধিত ভিক্ষুকরাই নয়, পাশর্^বর্তী শরীয়তপুর, লক্ষ্মীপুর, নেয়াখালী থেকেও বেশ কিছু ভাসমান ভিক্ষুক এখানে নিয়মিত এসে ভিক্ষা করে আবার চলে যায় বলে জানান জেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রজত শুভ্র সরকার। তিনি আরো জানান, বর্তমানে জেলায় নিবন্ধিত ভিক্ষুকের সংখ্যা ৯৩১জন। চলতি বছর এদের মধ্যে ১০৩ জনকে সমাজসেবা বিভাগ হতে প্রায় অর্ধ কোটি টাকা সহায়ক উপকরণ দেয়া হয়েছে। তিনি আরো জানান, যোগাযোগ সুবিধায় ভিক্ষুকদের একটি বড় অংশ জেলার বাইরে থেকে আসে। তবে জেলায় ভাসমান ও পেশাদার ভিক্ষুকের সংখ্যা প্রায় ৫ সহস্রাধিক হবে বলে জানান ভিক্ষাবৃত্তিতে অংশ নেয়া কেউ কেউ।
ভিক্ষুকদের অনেকের সাথে কথা বলে জানা যায়, এলাকার বিভিন্ন হতদরিদ্র কেউ কেউ পরিপূর্ণভাবে খাবার না পেয়ে এবং ওষুধের টাকা জোগাড় করতে না পেরে এখন ভিক্ষা করছেন। আগে যেসব নারী বিভিন্ন বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করতেন, তারা এখন বেশি ইনকামের আশায় ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নিয়েছেন। আবার এদের মধ্যে অনেকেই আছেন যারা বেশি রোজগারের আশায় লোভে পড়ে এমনিতেই ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নিয়েছেন।
গত কয়েক মাস বিভিন্ন বাজার ঘুরে নানা স্থানে দেখা গেছে, ভিক্ষুকের সংখ্যা আগের চেয়ে অনেক বেশি। যার মধ্যে বেশি ভিক্ষাবৃত্তি করতে দেখা যায় চাঁদপুর শহরের বাণিজ্যিক স্থানে, আদালত প্রাঙ্গণে, লঞ্চ টার্মিনালে, বাবুরহাট, মহামায়া, ফরাক্কাবাদ, চান্দ্রা, সফরমালী, শাহতলী, ফরিদগঞ্জের চান্দ্রা বাজার, পাটোয়ারী বাজার, রূপসা বাজার, ফরিদগঞ্জ বাজার, মুন্সীরহাট বাজার, গৃদকালিন্দিয়া বাজার, কালিরবাজার, হাজীগঞ্জের রামপুর বাজার, হাজীগঞ্জ বাজার, কচুয়া, রহিমানগর, সাচার বাজার, শাহরাস্তির কালিয়াপাড়া, কালীবাড়ি, ঠাকুরবাজার, সূচীপাড়া, হাইমচরের আলগী বাজার, মতলবের নারায়ণপুর বাজার, নায়েরগাঁও বাজার, মোহনপুরসহ বেশ ক’টি বাজারে। এদের মধ্যে পোশাক-আশাক দেখে কিছুটা আঁচ করা যায়, মধ্য বয়সী নারীর সংখ্যাই বেশি। তারা এর আগে রাস্তায় নামেন নি, তারা পেশাদার ভিক্ষুকও নন। শ্রমজীবী এসব নারী এক সময় বিভিন্ন ধরনের কাজের সঙ্গেই সম্পৃক্ত ছিলেন। অনেকটা সামাজিক মর্যাদা নিয়েই তারা জীবন-যাপন করতেন। কিন্তু সময়ের আবর্তে এখন তাদের পথে নামতে হয়েছে। তবে বাজারগুলোর অনেক ব্যবসায়ীর ধারণা, এরা পেশাদার ভিক্ষুক নন। এরা অনেকে নিজেদের সাজসজ্জার চাহিদা মেটানোর জন্যে নিজ এলাকা থেকে দূরের এলাকায় গিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি করছেন। আগে ট্রেনে দল বেঁধে ভিক্ষা করতে দেখা যেত। বর্তমানে লোকাল ট্রেন না থাকায় তাদের বিরাট একটি অংশ শহরের অলি-গলিতে ভিক্ষা করছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জানান, এমন কিছু ভিক্ষুক ভিক্ষা করে, যাদের দৈনিক আয় প্রায় ১ হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা। এরা মাসে ২/৩ দিন বাদ দিয়ে প্রতিদিনই ভিক্ষাবৃত্তি করছে। বিভিন্ন বাজারের অনেক ব্যবসায়ী অস্বস্তি প্রকাশ করে বলেন, ভিক্ষুকদেরকে দৈনিক এক থেকে দুইশ’ টাকা দিতে হয়। এখন ভিক্ষুকদের মধ্যে অনেকে দুই টাকা-পাঁচ টাকা দিলে নিতে চান না।
শরীয়তপুরের একজন ভিক্ষুকের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, তার বাড়ি ওই জেলার তারাবুনিয়ায়। ‘এত দূর থেকে এসে কেনো ভিক্ষা করছেন’ জানতে চাইলে তিনি বলেন, চাঁদপুরেরও অনেক লোক তাদের এলাকায় গিয়ে ভিক্ষা করে। যার সুবিধা যেখানে সে সেখানে যায়’।
অন্যদিকে নারী ভিক্ষুকদের সাথে কথা বলে তাদের স্বামীর নাম, গ্রামের নাম জানতে চাইলে তারা কোনো রকম পরিচয় দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। ‘এত কিছু জানার কী দরকার’ বলে বিরক্তি নিয়ে চলে যান। চাঁদপুর সদরের চান্দ্রা ইউনিয়নের একজন ভিক্ষুকের সাথে কথা হলে তার বাড়ি বাখরপুরে একটি বাড়ির নাম বলেন। অথচ অনুসন্ধানে জানা যায়, সেই বাড়িতে কোনো নারী-পুরুষ ভিক্ষাবৃত্তির সাথে জড়িত নয়।
চাঁদপুর সদর উপজেলা সমাজসেবা কার্যালয়ের কর্মকর্তা জামাল হোসেনের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, এখানে ভিক্ষুকের সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে সত্যি। তবে অনেক ভিক্ষুক আছেন যারা পেশাদার ভিক্ষুক না, এরা লোভে পড়ে ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নিয়েছেন এবং বেশিরভাগই অন্য জেলার ভিক্ষুক।
সচেতন নাগরিক কমিটি (সনাক) চাঁদপুরের সভাপতি ডাঃ পীযূষ কান্তি বড়ুয়া বলেন, ভিক্ষা পাওয়ার ক্ষেত্রে ভিক্ষাবৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করলেই তা কমে আসবে। চাঁদপুর যেহেতু ট্র্রানজিট এলাকা তাই বিভিন্ন জেলা থেকে যেসব ভিক্ষুক এখানে আসে তাদের তালিকা করে আন্তঃজেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে তাদের নিজ জেলায় পুনর্বাসন করলে এখানে ভিক্ষুক কমে আসবে বলে তিনি মনে করেন।