পরকীয়ার কারণে অনিশ্চিত ভবিষ্যত শিশু আফনানের
বাবা কিংবা মা যতো কিছুই করুক, যতো দূরেই থাকুক, যতো অন্যায়ে ডুবে থাকুক, পুরো দুনিয়া একদিকে নিজের সন্তান আরেক দিকে। সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে সাত খুন মাপ। এটিই সৃষ্টির নিয়ম। হিংস্র বাঘ আর রক্ত-মাংসের মানুষ, সবার সন্তানই নিজের কাছে কলিজার টুকরা। যে সন্তানকে ভিডিও কলে দিনে একবার না দেখলে প্রবাসী বাবার মন শান্ত থাকতো না, সন্তানের নানা আবদার পূরণ না করলে সকল কিছু যেনো অনর্থ হয়ে যেতো, সেই বাবা সন্তানকে রেখে কবরে শায়িত।
অপরদিকে মা নিজে যতোটাই পাপী হন না কেনো, সন্তানের জন্যে সবটুকু বিলিয়ে দিতে দ্বিধা করতেন না। মায়ের হাতে সকালের নাস্তা, দুপুরের খাবার, রাতের খাবার কিংবা কোলবালিশের মতো মাকে জড়িয়ে না ধরলে রাতে ঘুম আসতো না, সেই মা এখন বাবাকে হত্যার দায়ে জেলে। বাবার কবরে বারবার ছুটে যায়, গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, আবার দাদার ঘরে ফিরে আসে।
যে খালার বুকে পিঠে চড়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেতো, সেই খালা পুলিশের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। যে নানু সারাদিন চোখে চোখে রাখতেন একমাত্র নাতিকে, সেই নানু মায়ের সাথে জেলে দিন কাটাচ্ছেন। সব হারিয়ে দাদার বাড়িতে ফুফিদের কাছে ঠাঁই মিলেছে শিশুটির। পাঠকগণ! যে যতো কথা বলুন না কেনো, একবার কি বুঝতে পারেন, এ ক্ষতি কি আর এ জন্মে পূরণ হবে এই শিশুটির? শিশুটি এখনো বুঝতে পারে না তার জীবনে কী ক্ষতি হয়ে গেছে। মোটেই বোঝার বয়স এখনো হয়নি তার।
অনেক পাঠকের কাছে এতোক্ষণ মনে হয়েছে, এটি একটি বাংলা ছবির গল্প। না, এটি হাজীগঞ্জের সেই আলোচিত পরকীয়া সম্পর্কের বলি প্রবাসী এমরানের একমাত্র সন্তান আফনানের বর্তমান অবস্থা। মায়ের একটি মাত্র অন্যায় সম্পর্কের কারণে তার বাবা কবরে, মা-নানু জেলে, খালামণি পালিয়ে বেড়াচ্ছে। কোথায় সেই মায়ের কোল, কোথায় বাবার আদর, সবই চিরতরে বিলীন হয়ে গেছে আফনানের জীবন থেকে।
ছোট্ট আফনানের সামনে তার আংকেল তথা মায়ের পরকীয়া প্রেমিক কুপিয়ে বাবাকে হত্যা করেছে। মাকে নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টানাটানি, এসবই অফনানের চোখে দেখা। এসব কিছুতে অনেকটাই বিচলিত হয়ে পড়েছে সে।
মায়ের একটি অন্যায় সম্পর্কের কারণে তার মা-বাবা চিরতরে আলাদা হয়ে গেছে, দাদার পরিবারে চলছে শোকের মাতম, ফুফি মামলার বাদী হওয়ার কারণে নিজের সংসার সামলাতে পারছেন না। বিবাহিত খালা মামলার আসামী হওয়ার কারণে খালার সংসার নষ্ট হওয়ার পথে, নানু জেলে থাকার কারণে নানার সংসার এলোমেলো হওয়ার পথে। খুনি আশেক এলাহী বাবু নিজে জেলে থাকলেও যতোদিন বাঁচবে ততোদিন খুনির তকমা নিয়ে বেঁচে থাকবে এবং নিজ সংসারে থাকবে কলঙ্কের বোঝা হয়ে। একটি অন্যায় সম্পর্কে কতোগুলো পরিবারে নানা অশান্তি সৃষ্টি হয়েছে! সর্বোপরি শিশু আফনান যখন বুঝতে পারবে তার বাবার খুনি তার মা, মায়ের পরকীয়া প্রেমিক কিংবা যখন নিজেই নিজের অজান্তে ভাববে বা সমাজের মুখে শুনবে, জন্মদাতা মা এমন চরিত্রের, তখন তার মানসিক অবস্থা কী হবে, তার ভুক্তভোগী হবে সে নিজেই, অন্য কেউ নয়।
উল্লেখ্য, গত ৮ অক্টোবর হাজীগঞ্জ বাজারস্থ ট্রাক রোডের আমেনা ম্যানশনের ৩য় তলার নিজ ভাড়া বাসায় খুনের শিকার হন সৌদি প্রবাসী এমরান বাশার। তাৎক্ষণিক পুলিশ নিহতের লাশ উদ্ধারসহ তার স্ত্রী ফারজানা আক্তারকে আটক করে। ঘটনার পরদিন ৯ অক্টোবর নিহতের বোন রিনা আক্তার বাদী হয়ে চারজনকে আসামী করে হাজীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা (নং-৯) দায়ের করেন। খুনের শিকার এমরান বাশার ফরিদগঞ্জ উপজেলার সুবিদপুর ইউনিয়নের লক্ষ্মীপুর গ্রামের দালাল বাড়ির আবুল বাশারের ছেলে। ফারজানা আক্তার হাজীগঞ্জ উপজেলার বড়কুল পশ্চিম ইউনিয়নের জাখনি গ্রামের মৃত জসিম উদ্দিনের মেয়ে। এই দম্পতির দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া আফনান (৮) নামের একমাত্র পুত্র সন্তান রয়েছে। এ ঘটনার মূল আসামী ফারজানার পরকীয়া প্রেমিক ও চাচাতো বোনের দেবর সৈয়দ আশেকে এলাহী বাবু শাহরাস্তি উপজেলার টামটা দক্ষিণ ইউনিয়নের আজাগরা গ্রামের মুন্সী বাড়ির সৈয়দ মাসুদ মুন্সীর ছেলে। এ মামলায় ৪ আসামীর মধ্যে প্রধান আসামী আশেক এলাহী বাবু, ফারজানা আক্তার ও তার মা নাজমা খানম জেলহাজতে রয়েছেন। অপর আসামী ফারজানার বোন মারজানা আক্তার পলাতক। শিশু আফনান দাদার বাড়িতে রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এমরান বাশারের স্ত্রী ফারজানা আক্তারের সঙ্গে সৈয়দ আশেকে এলাহী বাবুর দীর্ঘদিন পরকীয়া সম্পর্ক ছিলো। এ নিয়ে সালিসি বৈঠক ও থানায় অভিযোগ হওয়ার পর ফারজানা আক্তার ও তার পরিবার ভুল স্বীকার করে ভবিষ্যতে এমন কাজ করবে না বলে ক্ষমা চেয়ে এমরানের সংসারে ফিরে আসে। একমাত্র ছেলের কথা ভেবে এমরান স্ত্রীকে ক্ষমা করে দেন। কিন্তু ছুটি শেষে এমরান প্রবাসে যাওয়ার পর ফের সেই একই সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন ফারজানা। সম্প্রতি এমরান দেশে আসার কিছুদিন পরে গত ৮ অক্টোবর এমরানের হাজীগঞ্জের ভাড়া বাসায় আশেক এলাহী আর এমরানের মাঝে বাক-বিতণ্ডা হয়। এক পর্যায়ে আশেক এলাহী বাবু এমরানকে কুপিয়ে পালিয়ে যায়। এমরানকে কুপিয়ে হত্যার সময় ফারজানা বাসাতেই ছিলো বলে পুলিশের কাছে স্বীকার করে।