• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

হাজীগঞ্জে জোড়া খুন : কী ঘটেছিলো ওই রাতে?

প্রকাশ:  ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০৮:৫৩
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

হাজীগঞ্জের বড়কুল গ্রামের সাহা বাড়ির দুলাল সাহার বসতঘরে খুন হওয়া উত্তম চন্দ্র বর্মন তুফান (৭০) ও তার স্ত্রী কাজলী রানি বর্মন (৫৫) খুনের বিষয়ে র‌্যাব ও পুলিশের কাছে ১০জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। ওইদিন মধ্যরাতে ওই বসতঘরে ঠিক কী ঘটেছিলো, আর একটি দুর্বৃত্তের দল ঘরে ঢুকে কীভাবে এই দম্পতিকে হত্যা মিশনে অংশ নিয়েছে তার বিস্তারিত উঠে এসেছে পুলিশের দেয়া সংবাদ সম্মেলনে। চুরি করে মালামালা লুণ্ঠন ও ভয়-ভীতি দেখানোর উদ্দেশ্যে দুর্বৃত্তরা ওই ঘরে ঢুকেলেও খুন হওয়া দম্পতি তাদেরকে চিনে ফেলার কারণে খুন করা হয় তাদেরকে। সর্বশেষ এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ওই ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম আমির হোসেনের ছেলে বাবুল (৪৫)কে গ্রেফতার করা হয়েছে। মূলত এই বাবুল, মিজান আর র‌্যাবের হাতে আটক সোহাগ এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী। এ হত্যাকাণ্ডে আরো যারা রয়েছে তাদেরকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে পুলিশ সুপার কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদীপ্ত রায় জানিয়েছেন। এ সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে ঘটনার প্রায় ১৫ দিনের মধ্যেই জোড়া খুনের মূল রহস্য উদ্ঘাটনের বিষয় পরিস্কার করা হলো।
সংবাদ সম্মেলন সূত্রে জানা যায়, হাজীগঞ্জের জোড়া খুনের রহস্য উদ্ঘাটন এবং জড়িত ১০ জন আসামীকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জোড়া খুনের ঘটনায় পুলিশ সুপারের প্রত্যক্ষ দিক-নির্দেশনায় তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার এবং গোপন তথ্যের ভিত্তিতে হাজীগঞ্জ থানা পুলিশ ঘটনার পর হতে ধারাবাহিকভাবে বিভিন্নস্থানে অভিযান পরিচালনা করে এ পর্যন্ত ঘটনায় জড়িত ১০ জন আসামীকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃতরা হলো : মোঃ সোহাগ হোসেন ওরফে সোহাগ মুন্সি (২৯), মিজান ওরফে গোলাম আজম ওরফে মোঃ মিজান হোসেন (৬৯), মাসুদ রানা (২৫), শ্যামল চন্দ্র শীল (২০), মোঃ আলমাস (৩৫), মোঃ নেছার আহম্মেদ (৩০), মোঃ রাকিব হোসেন (২৩),  মোঃ রাশেদ ওরফে মোঃ রাসেল (২৬), মাসুদ কামাল (৪৫) ও শাহ আলম ওরফে বাবুল (৪২)। ধৃত আসামীদের মধ্যে মোঃ সোহাগ হোসেন ওরফে সোহাগ মুন্সি (২৯) ও মিজান ওরফে গোলাম আজম ওরফে মোঃ মিজান হোসেন (৫৯) বিজ্ঞ আদালতে স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি প্রদান করেছে।
উক্ত ঘটনায় চুরি হওয়া ১টি পিতলের গ্লাস আসামী মিজানের বসতঘরের শোকেস হতে মামলার তদন্তকারী অফিসার উদ্ধার করে জব্দ করেন। ঘটনায় জড়িত পলাতক আসামীদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
গ্রেফতারকৃত আসামীদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ঘটনার দিন শুক্রবার রাত অনুমান ১টার দিকে  আসামী নেসার ওরফে নাসির ও মিজান বাবুলদের বাড়িতে যায়। পরে আসামী বাবুল, মাসুদ, সোহাগ দুলাল সাহার কেয়ারটেকার উত্তম চন্দ্র বর্মণ ওরফে তুফান এবং তার স্ত্রীকে ভয় দেখিয়ে ঘর থেকে তাড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনামতে স্ক্যাপার ব্যবসায়ী মাসুদ কাটার দিয়ে ঘরের পূর্ব পাশের জানালার গ্রীল কেটে ঘরে ঢুকে দরজা খুলে দিলে বাইরে অবস্থানরত মিজান, রাকিব, নাসির ওরফে নেসার, শ্যামল ও আলমাস ঘরের ভিতর প্রবেশ করে। ঘরের পশ্চিম পাশের রুমে উত্তম চন্দ্র বর্মন ওরফে তুফান এবং তার স্ত্রী কাজলী রাণী বর্মনকে টিভি দেখা অবস্থায় দেখতে পেয়ে দুর্বৃত্তরা তাদের হাত পা বেঁধে ফেলে। আলমাস নেকড়া দিয়ে উত্তম চন্দ্রের মুখ চেপে ধরে এবং শ্যামলসহ অন্যরা ঘরের উত্তরের রুমে নিয়ে যায়। পরবর্তীতে রাকিব, স্ক্যাপার মাসুদ ও আলমাস উত্তম চন্দ্র বর্মণের স্ত্রী কাজলী রাণী বর্মনকে মুখ চাপা দিয়ে ধরে বসতঘরের পূর্ব পাশের রুমে নিয়ে যায়। এদিকে দুর্বৃত্তদের চিনে ফেলাই উত্তম বর্মন এবং তার স্ত্রীর জন্যে কাল হলো। ঘরের ভেতরে থাকা রাকিব, শ্যামল, আলমাস, স্ক্যাপার মাসুদ মিলে  উত্তম চন্দ্র বর্মন এবং কাজলী রাণী বর্মনকে তাদের পরনের কাপড় গলায় পেঁচিয়ে শ^াসরোধ করে হত্যা করে। এ সময় ঘরের মধ্যে থাকা ১টি সাদা বস্তা নিয়ে আসামীরা ৩টি পিতলের প্লেট, ২টি পিতলের চামচ, ২টি পিতলের গ্লাস, ২টি পিতলের বাটি, পূজা করার ২টি পিতলের বাটি নিয়ে যায়।
এ ঘটনার পরেরদিন শুক্রবার নিহত দম্পতির বড় মেয়ে হাজীগঞ্জ থানায় মামলা (নং-১০, তারিখ-০৮/০৯/২০২৩ খ্রিঃ, ধারা-৪৬০/৩০২/৩৮০/৩৪ পেনাল কোড) দায়ের করেন।
এরপর থেকেই পুলিশ সুপার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বিপিএম, পিপিএম-এর দিক নির্দেশনায়, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ), অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, (হাজীগঞ্জ সার্কেল) ও অফিসার ইনচার্জ, হাজীগঞ্জ থানা-এর তত্ত্বাবধানে পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত)সহ হাজীগঞ্জ থানার একটি চৌকষ দল মামলার ঘটনার সাথে জড়িত আসামীদের গ্রেফতার অভিযান পরিচালনা করে আসছেন।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম) রাশেদুল হক, হাজীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মুহাম্মদ আব্দুর রশিদ, ওসি (তদন্ত) নজরুল ইসলামসহ চাঁদপুরে কর্মরত প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার প্রতিনিধিসহ প্রেসক্লাব নেতৃবৃন্দ।
উল্লেখ্য, গত ৭ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতের কোনো একসময় উত্তম চন্দ্র বর্মনের বসতঘরের পিছনের গ্রিল কেটে ঘরে ঢুকে দুর্বৃত্তরা। দুর্বৃত্তরা ঘরে ঢুকে পুরো ঘরের মালামাল তছনছ করে। এ সময় উত্তম বর্মন ও কাজলী রাণীকে দুর্বত্তরা হাত-পা বেঁধে শ^াসরোধ করে হত্যা করে পালিয়ে যায়।
পরদিন ভোরবেলা প্রতিবেশী এক নারী উত্তম বর্মনের ঘরের সামনের ফুল গাছ থেকে পূজার ফুল তুলতে এসে তাদের বসতঘরের দরজা খোলা দেখে কৌতুহলের বশে প্রতিবেশী আরেক নারীকে ডেকে এনে তারা ঘরে প্রবেশ করেন। এ সময় বসতঘরের দুই রুমে স্বামী-স্ত্রীর নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখে তারা ডাক-চিৎকার শুরু করেন।
এদিকে একেবারে ক্লুলেস এই জোড়া খুনের কোনো কুল কিনারা পাচ্ছিলো না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ঘটনার পরেই হাজীগঞ্জ থানা পুলিশ ওই গ্রামের বেশ ক’জনকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। একই সাথে র‌্যাব ছায়া তদন্তে নামে।
ঢাকার সদরঘাট থেকে র‌্যাবের হাতে আটককৃত সোহাগ ও সোহাগের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মিজানুর রহমান নামের আরেকজনকে আটক করে হাজীগঞ্জ থানা পুলিশ। মিজানের পরে আটক করা হয় ওই ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম আমির হোসেনের ছেলে বাবুল (৪৫)কে ।
সোহাগ ও মিজানকে নিয়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাস্থলে যায় পুলিশ। সেখানে মিজানের বসতঘর থেকে একটি কাঁসা বা পিতলের মগ উদ্ধার করে পুলিশ। মগটি উত্তম বর্মনের ঘর থেকে হত্যাকাণ্ডের পর নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও ওই ঘর থেকে অন্য যে সকল মালামাল নেয়া হয়েছে তা ২ হাজার ৮শ’ টাকায় এক ভাঙ্গারির কাছে বিক্রি করেছে বলে সোহাগ ও মিজান পুলিশকে জানিয়েছে।
এদিকে র‌্যাবের কাছে আসামী সোহাগ হত্যার দায় স্বীকার করেছে র‌্যাব। ভিন্নভাবে ব্রিফিংয়ে তা জানিয়েছে।

সর্বাধিক পঠিত