পদ্মা-মেঘনা নদীতে ডাকাতের হানা বন্ধ হয়নি
ঈদকে ঘিরে চরাঞ্চলের গরু খামারিরা আতঙ্কে
প্রতিবছর কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে বিক্রির জন্যে চাঁদপুরের বিভিন্ন চরাঞ্চলে গবাদি পশু পালন করা হয়। অথচ কোনো কোনো চরে এ সময় গরুর খামারী কিংবা গবাদি পশু পালনকারীদের অনেকে ডাকাত ও জলদস্যু আতঙ্কে থাকেন। কোনো কোনো স্থানে তারা রাতভর পাহারায় থাকেন। এসব অপরাধ রোধে এ অঞ্চলের পদ্মা-মেঘনা নদীর বিশাল এলাকায় ১২টি নৌ স্টেশন (ফাঁড়ি) স্থাপন করেছে সরকার। তাছাড়া ডাকাতি, দস্যুতা, চোরাচালান রোধ, জাটকা রক্ষা, নদী দূষণরোধ সহ নদীকে সুরক্ষিত রাখতে চাঁদপুরের নদী সীমানায় নৌ-পুলিশের তৎপরতা বেড়েছে পূর্বের চেয়ে বেশি। রয়েছে কোস্টগার্ড স্টেশনও। তারপরও জনমনে ডাকাত আতঙ্ক পুরোপুরি কমেনি বলে দাবি এ নদী অঞ্চলের জেলে, নৌযান চালকসহ সংশ্লিষ্টদের।
ষাটনল থেকে চরআলেকজান্ডারসহ শরীয়তপুর জেলার বিশাল নৌ-সীমানার চাঁদপুরে ৬টি, শরীয়তপুরে ৩টি, লক্ষ্মীপুরে ২টি ও কুমিল্লায় ১টি নৌ-ফাঁড়ি করা হয়েছে। যে কারণে পদ্মা-মেঘনায় চাঁদপুরগামী যাত্রীবাহী লঞ্চ, ট্রলার ও স্পীডবোটে ডাকাতির ঘটনা গত বছরের তুলনায় এ বছর কিছুটা কমেছে বলে দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি কমে আসছে নৌপথে অন্যান্য অপরাধও। তারপরও নদীকেন্দ্রিক কর্মজীবী মানুষদের মাঝে এখনো অজানা আতঙ্ক কাজ করছে বলে জানান রাজরাজেশ^রের ট্রলার চালক ইব্রাহিম বেপারী ও চেয়ারম্যান ঘাট এলাকার জেলে মইজউদ্দিন খালাসী।
চাঁদপুর নৌ-পুলিশ সূত্রে জানা যায়, গত ছয় মাসে এখানকার নৌ সীমানায় দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে চারটি। এসব ডাকাতির সাথে জড়িত ৪৭ ডাকাতকে আটক করেছে পুলিশ। তাছাড়া নদীতে দস্যুতা ও চাঁদাবাজিকালে আটক হয়েছে ৫৩জন। দেশী-বিদেশী অস্ত্রসহ ২১ জনকে আটক করা হয়েছে। ডাকাতির ঘটনায় দেখা যাচ্ছে প্রতিটি ডাকাতি ঘটেছে বিভিন্ন রূট থেকে চাঁদপুরের দিকে আসা যাত্রীবাহী ট্রলার বা লঞ্চে।
চাঁদপুর নৌ-পুলিশ সূত্রে জানা যায়, পদ্মা-মেঘনায় ডাকাতির জন্যে বর্তমানে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হচ্ছে সুরেশ^র, নারায়ণগঞ্জ, মোহনপুর, ষাটনল, কাচিকাটা ও মরা পদ্মার মুখ। এসব স্থানে ডাকাতি করে ডাকাতরা সহজেই তাদের আস্তানায় পালিয়ে যেতে অনেকটা সক্ষম হয়। তাই চাঁদপুরের নৌ-সীমানায় অত্যাধুনিক নৌযানসহ অতি প্রয়োজনীয় সরঞ্জমাদি সরবরাহ জরুরি। এছাড়া নৌ-পুলিশের সদস্য সংখ্যা বৃদ্ধি করে ডাকাতি রোধের পাশাপাশি বিশাল পদ্মা-মেঘনা নদীও রক্ষিত করা সম্ভব বলে মনে করেন এখানকার নৌযান সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, ডাকাত দল দ্রুত গতির স্পীডবোটে আর্মির পোশাকের সাথে মিল রেখে পোশাক পরে পদ্মা-মেঘনায় ডাকাতিতে অংশ নেয়। যাত্রীবাহী ট্রলারগুলো দূর থেকে নৌ-পুলিশ বা আর্মির ট্রলার ভেবে তাদের ইশারায় সাড়া দিয়ে ট্রলারের গতি কমিয়ে আনে, আর তাতেই দুর্ধর্ষ ডাকাত দল কয়েক মিনিটের মধ্যে যাত্রীদের কাছ থেকে সর্বস্ব লুট করে নিয়ে যায়। চলতি মাসের ২ তারিখ জাজিরার মাঝিরচরে গরু বোঝাই ট্রলারে ডাকাতিকালে ৭ জনকে আাটক করা হয়েছে এবং ৩৪ লাখ টাকার উপরে উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া দুই তিন মাস আগে মোহনপুরে ডাকাতির প্রস্তুতিকালে ১৬ ডাকাতকে আটক করেছে বলে জানায় নৌ-পুলিশ।
সম্প্রতি চিড়ার চরের কাছে একটি যাত্রীবাহী ট্রলারে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে নৌ-পুলিশ ধাওয়া করলে ডাকাত দল মরা পদ্মার চরের দিকে চলে যায়। নৌ-পুলিশের স্পীডবোট থেকে ডাকাতদের স্পীডবোটের গতি বেশি থাকায় তাদের ধরা যাচ্ছিলো না। নৌ-পুলিশ দল অভিযান অব্যাহত রাখায় ডাকাতরা বাংলাবাজারের কাছে স্পীডবোট রেখে স্থলভাগ দিয়ে পালিয়ে যায়। ঘটনাস্থলে পৌঁছে নৌ-পুলিশ ১টি স্পীডবোট, ৭টি লাইফ জ্যাকেট ও কিছু পোশাক উদ্ধার করে।
এ অঞ্চলে ডাকাতির বিষয়ে জানতে চাইলে চাঁদপুর, শরীয়তপুর, লক্ষ্মীপুর ও কুমিল্লা অঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত নৌ-পুলিশ সুপার কামরুজ্জামান জানান, চারটি অঞ্চলের মধ্যে চাঁদপুর অঞ্চলে মেঘনায় বেশ ক’টি ছোট চর থাকায় ডাকাত দল অনেকটা সহজে ও কৌশলে চরে পালিয়ে যেতে পারে। তাই ডাকাতরা এ অঞ্চলকে টার্গেট করে এখানে হানা দেয়। তবে পুলিশ তৎপর থাকায় ডাকাতি অনেক কমে গেছে এবং নদী নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে বলে জানান এ কর্মকর্তা। ইতোপূর্বে মেঘনায় বেশ ক’টি ডাকাতির ঘটনায় সংশ্লিষ্ট লঞ্চ বা ট্রলার চালকদের হাত থাকার বিষয়টি অনেকটা প্রমাণিত হয়েছে বলে জানা যায়। গুচ্ছগ্রামে ট্রলারে ডাকাতির ঘটনায় ট্রলার চালকের যে হাত ছিলো তা প্রমাণিত হয়েছে। ডাকাতির শিকার ট্রলারের যাত্রীদের দেয়া বিবরণ অনুযায়ী ট্রলার চালক সন্দেহের তালিকায় থাকায় নৌ-পুলিশের তদন্তে তা বেরিয়ে আসে। ষাটনলের স্পীডবোট চালক আইয়ুব ডাকাতির সাথে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মিলেছে।
নৌ-পুলিশ সুপারের দাবি, নৌ-পুলিশ টহলে না থাকলে এতোদিনে পদ্মা-মেঘনায় কয়েশ’ ডাকাতির ঘটনা ঘটতো। তিনি বলেন, সীমিত সংখ্যক সদস্য নিয়ে আমরা নৌ এরিয়াকে সাধ্যমত নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছি।
নৌ-পুলিশ সদস্যরা প্রতি রাতে টহল অব্যাহত রেখেছে। তিনি আরো জানান, চাঁদপুরে ইচলী মৌজায় প্রায় তিন একর সম্পত্তি অধিগ্রহণসহ স্থায়ী নৌ-পুলিশ সুপারের দপ্তর স্থাপনের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।