ফরিদগঞ্জে সহ-সুপার পদে অবৈধ নিয়োগ বৈধ করতে দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন মাদ্রাসা সুপার
ফরিদগঞ্জ উপজেলার পাইকপাড়া ইউনিয়নের ঐতিহ্যবাহী সাহাপুর মোহাম্মদ চৌধুরী গাজী ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসায় অনিয়ম-দুর্নীতি করে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সহ-সুপার নিয়োগের অভিযোগ উঠেছে আরো আগেই। যার উপযুক্ত প্রমাণ পেয়ে ফরিদগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার ওই নিয়োগকে বাতিল ঘোষণা করেছিলেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ক’দিন অত্র মাদ্রাসা এলাকা সহ পুরো ফরিদগঞ্জেই চলছে বিভিন্ন রকম কানাঘুষা। অবৈধ নিয়োগ প্রক্রিয়ার প্রধান সমন্বয়ক মাদ্রাসার সুপার মাওলানা আবু তাহেরের বিরুদ্ধে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও অত্র মাদ্রাসা গভর্নিংবডির বিদ্যোৎসাহী সদস্য এবং সুপারের নিজ সন্তানদের অভিযোগ থাকলেও সেই অভিযোগে কোনো রকম কর্ণপাত না করে অবৈধ নিয়োগকে বৈধ করার জন্যে তিনি বর্তমানে বিভিন্ন সংবাদকর্মী ও রাজনৈতিক মহলের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন।
তথ্য সূত্রে জানা যায়, গত ১ মে সোমবার তড়িঘড়ি করে নিয়োগ কার্যক্রম চূড়ান্ত করার সময় অনিয়মের অভিযোগে নিয়োগ বোর্ড ত্যাগ করেন মাদ্রাসা গভর্নিংবডির সদস্য ইউপি চেয়ারম্যান হোসেন আহম্মদ রাজন এবং নিয়োগ প্রক্রিয়াটি বিভিন্ন রকম প্রশ্নবিদ্ধ হলে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারও কিছুটা মনঃক্ষুণ্ন হন। বিষয়টি সংবাদকর্মীরা জানতে পেরে ঘটনাস্থলে গেলে অত্র ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সাংবাদিকদের বলেন, এই নিয়োগ কার্যক্রম সম্পূর্ণরূপে প্রক্সি, এখানে নির্ধারিত ব্যক্তিকে বিশেষ সুবিধা দিয়ে নিয়োগ দেয়ার সকল কার্যক্রম তারা আগেই করে রেখেছে। শুধু ফলাফল ঘোষণার বাকি ছিলো। তাদের অনিয়ম দেখে আমি সেখান থেকে চলে এসেছি। তাদের পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নাম্বারপ্রাপ্ত ব্যক্তি যে প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়েছে, সে প্রশ্নপত্র থেকে আমি তাকে প্রশ্ন করলে তিনি একটি প্রশ্নেরও উত্তর দিতে পারেননি। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারকে ফোন দিলে তিনি বলেন, নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ থাকার কারণে তা স্থগিত করা হয়েছে।
এদিন সহকারী সুপার পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন বালিয়া দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক মোঃ ফজলুল করিম, গোবিন্দপুর দাখিল মাদ্রাসার শিক্ষক মোঃ আবদুল কাদীর সহ ৫ জন। তবে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী শিক্ষকদের সাথে কথা হলে এবং বিভিন্ন প্রশ্নের তোপে পড়ে তারা সংবাদকর্মীদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিতে হিমশিম খান। এ সময় নিয়োগ বোর্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষা বোর্ডের ডিজির প্রতিনিধি, মাদ্রাসা গভর্নিংবডির সভাপতি এমরান মেম্বার ও অত্র মাদ্রাসার সুপারের সিদ্ধান্তে কাঁশারা দাখিল মাদ্রাসার ইবতেদায়ী প্রধান মাওলানা সালাউদ্দিনকে সহ-সুপার হিসেবে চূড়ান্ত করে ফলাফল ঘোষণা করেন। পরীক্ষায় মোট ৭জন আবেদন করলেও ২জন নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেননি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী জানান, আমাদের চিঠি দিয়ে জাতীয় বন্ধের দিনে নিয়োগ পরীক্ষা হবে বলে জানালে আমরা সকালে পরীক্ষা দিতে আসি। ৩০ (ত্রিশ) নাম্বারের লিখিত পরীক্ষায় একজনকে ২৪ নাম্বার এবং অন্যদের ৮, ৬ ও ১৩ নাম্বার দেয়াটা পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়াকে সন্দেহযুক্ত করেছে। এছাড়া পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা দু-তিনজন শিক্ষকের সাথে কথা হলে তাদের অগোছালো কথা বলার ধরনে নিয়োগ প্রক্রিয়াকে একেবারেই সন্দেহজনক মনে করেছে। নিয়োগ পরীক্ষা চূড়ান্ত করা মাওলানা সালাউদ্দিনের কাছে কত নাম্বারে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দিয়েছেন জানতে চাইলে এ ব্যাপারে তিনি কিছুই জানেন না বলে জানান। কোন্ পত্রিকায় এই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে সেটাও তিনি বলতে পারেন নি। তিনি শুধু বলেন, বেশি নাম্বার পাওয়ার জন্যে বেশি করে লিখেছে। এ সময় বিভিন্ন প্রশ্নে তিনি অগোছালো কথাবার্তা বলেন। কিন্তু মূলত পরীক্ষাটি হয়েছে ৫০ নাম্বারে।
মাদ্রাসা গভর্নিংবডির সভাপতি এমরান মেম্বারের সাথে কথা হলে তিনি প্রথমে নিয়োগ বোর্ডের পরীক্ষার বিভিন্ন অনিয়মের কথা বলেন। কয়েক ঘন্টা পরে আবার তার কাছে চূড়ান্তভাবে জানতে চাইলে নিয়োগ পরীক্ষা ভালো হয়েছে বলে তিনি জানান। এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অনেকে জানান, এই নিয়োগ পরীক্ষায় সম্পূর্ণ অনিয়ম করা হয়েছে এবং বর্তমান এই নিয়োগ প্রক্রিয়াকে নিয়ে এলাকায় হাস্যরসের সৃষ্টি হয়েছে। নতুন সহ-সুপারকে নিয়োগ প্রদানে ৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা বাণিজ্য করা হয়েছে। যার ব্যাপারে বর্তমানে এলাকার ছোট বড় সবাই অবগত।
মাদ্রাসার সুপার মাওলানা আবু তাহেরের বড় ছেলে হাফেজ তোহা এই প্রতিনিধিকে বলেন, আমার বাবা একজন দুর্নীতিবাজ। তিনি এই নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ৫ লাখ টাকার উপরে নিয়েছেন বলে আমার কাছে স্বীকার করেছেন। নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে এই টাকা থেকে ১ লাখ করে ক’জনকে, ৮০ হাজার এবং ৫০ হাজার করে ক’জনকে দিতে হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে আমার পিতার এই দুর্নীতির সঠিক বিচার চাই এবং মাদ্রাসায় সঠিকভাবে একজন সহ-সুপার নিয়োগের জন্যে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
মাদ্রাসার সুপার মাওলানা আবু তাহেরের সাথে কথা বলতে গেলে তিনি সংবাদকর্মীদের ম্যানেজ করার চেষ্টা করেন এবং আগামীতে সংবাদকর্মীদের আরো সুযোগ-সুবিধা দিবেন বলে ম্যানেজ করার চেষ্টা করেও তিনি ব্যর্থ হন। নিয়োগ প্রক্রিয়াকে বৈধ করতে বর্তমানে তিনি এলাকার বিভিন্ন রাজনীতিবিদ ও সংবাদ কর্মীদের সাথে দেন-দরবার চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও মাদ্রাসা গভর্নিংবডির বিদ্যোৎসাহী সদস্য হোসেন আহমদ রাজনের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, নিয়োগ প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণ অবৈধ। তবে টাকার কাছে বিক্রি হয়ে স্থানীয় কিছু লোক এই অবৈধ নিয়োগ প্রক্রিয়াটিকে বৈধ করার জন্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতা ও সংবাদ কর্মীদের কাছে গিয়ে তদবির চালিয়ে যাচ্ছেন।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা মাধ্যমিক অফিসার একেএম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহের সাথে কথা হলে তিনি বলেন, নিয়োগে কিছু অনিয়মের কথা জানতে পেরে নিয়োগ পরীক্ষাটি স্থগিত করে দেয়ার জন্যে আমি নির্দেশ দিয়েছি। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারের নির্দেশনায় তদন্তের মাধ্যমে সত্য ঘটনা উদ্ঘাটন করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে বলে তিনি জানান।
বিষয়টি নিয়ে জেলা শিক্ষা অফিসার প্রাণকৃষ্ণ দেবনাথের সাথে কথা হলে এ বিষয়ে অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নিবেন বলে তিনি জানান।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাসলিমুন নেছা জানান, বিষয়টি নিয়ে আমি অবগত নই, আমি খোঁজ-খবর নিয়ে জানাবো।
ফরিদগঞ্জ আসনের মাননীয় সংসদ সদস্য সাংবাদিক মুহাম্মদ শফিকুর রহমান বলেন, নিয়োগ পরীক্ষার দিনই অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছি এবং আমি মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারকে নিয়োগ স্থগিত করার নির্দেশ দিয়েছি। অনিয়ম হলে কোনো ছাড় নয়, আপনারা নিউজ করেন, আমি বিষয়টি দেখছি।