• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • রোববার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

একাত্তরের অসহযোগ আন্দোলনে শিল্পী সমাজ

জাফর ওয়াজেদ

প্রকাশ:  ২২ মার্চ ২০২৩, ১২:০১
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

বাঙালি জাতির জীবনে নতুন বাঁক নেয়ার মাস মার্চ, ১৯৭১। বাঙালির নিজ ঘরে ফেরার প্রস্তুতিপর্ব। সহস্র বছরের সাধনা শেষে একটি জাতির নিজস্ব সত্তার দিকে মুখ ফেরানোর এক উজ্জ্বল সময়। সারা বাংলাদেশ তখন শেখ মুজিবের আঙ্গুলি হেলনে পরিচালিত হয়ে আসছে। সে এক যুগান্তকারী ক্ষণ ও সময়। অন্যরকম এক উপলব্ধিতে দেদীপ্যমান পুরো জাতি। এই এক অসহযোগ আন্দোলন, গান্ধীর অহিংস আন্দোলনকে ছাড়িয়ে যাওয়ার এই আন্দোলন ছিল অন্যসব আন্দোলন থেকে ভিন্ন। এ আন্দোলনের আড়ালে বাঙালি যে একটি পরাধীন জাতি, সে উপলব্ধি তীব্র হয়ে ওঠে স্বাধীনতার আক্সক্ষায়। জাতীয়তাবাদী চেতনায় বাঙালি তার নেতৃত্ব নির্ধারণ করে স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার পথ ধরে এগিয়ে গিয়েছিল। ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন; হঠাৎ বাংলাদেশ’ গেয়ে শিল্পীরা নেমে এসেছিলেন রাজপথে। কবিরা সদ্য রচিত কবিতা নিয়ে পল্টন ময়দানে দাঁড়িয়ে পাঠ করেছিলেন জনগণকে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্য নিয়ে। চারু ও কারুশিল্পীরাও নেমে এসেছিলেন রাজপথে। উত্তাল রাজপথ জনপদ। সারা বাংলার সর্বস্তরের মানুষের পদভারে কম্পিত বাংলার মাঠ-ঘাট প্রান্তর। বাঙালির জীবনে সে ছিল এই উজ্জ্বল সময়। মার্চের প্রথম তিন সপ্তাহে এই অসহযোগ আন্দোলন বাঙালি জাতিকে নিয়ে গিয়েছিল এক অসীম উচ্চতায়। পহেলা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ সন্ধ্যা পর্যন্ত বাঙালি সাহসের বরাভয় হয়ে স্বাধীনতার জয়গান গেয়ে ওঠেছিল। ভেঙ্গে দিতে সব বাঁধা, প্রতিবন্ধকতা। কণ্ঠে তাই ধ্বনিত হয়েছে, ‘বাঁধ ভেঙ্গে দাও, ভাঙ্গো’। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে শুরু হওয়া আন্দোলনে ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ, সারা বাংলা অস্বীকার করে সামরিক শাসক ও শাসনকে। বঙ্গবন্ধুর দিক নির্দেশনায় চলতে থাকে দেশ। পুরো বাংলা জুড়ে বাঙালির শাসন। শেখ মুজিবের নির্দেশে অফিস, আদালত, যানবাহন, ব্যাংক, বীমা চলছে। ২৫ মার্চ পাকিস্তানী হানাদার সেনাদের গণহত্যা শুরুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলনের চেহারা ছিল পুরোপুরি অহিংস। পাকিস্তানীদের প্রতি ঘৃণার পাহাড় জমে উঠলেও হিংসাত্মক আচরণ ছিল না বাঙালির। আঘাত না আসা পর্যন্ত পাল্টা আঘাত হানার পক্ষপাতি ছিল না বাঙালি।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাঙালি স্বাধিকারের পক্ষে রায় দেয়। শেখ মুজিবের ছয় দফা বাঙালির মুক্তির সনদ হিসেবে বিবেচিত তখন। সেই ৬ দফার পক্ষে নিরঙ্কুশ সমর্থন লাভ করে আওয়ামী লীগ। শেখ মুজিব হয়ে ওঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। ১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগ হবার পর পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রে পূর্ব বাংলা যে নয়া উপনিবেশে পরিণত হতে যাচ্ছে, শেখ মুজিব তা দ্রুত উপলব্ধি করেন। ক্রমান্বয়ে তিনি পাকিস্তানীদের উপনিবেশ থেকে পূর্ব বাংলা ও বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে রাজনীতিতে ঝাঁপিয়ে পড়েন। জেল, জুলুম, নিপীড়ন, নির্যাতন নেমে আসে তরুণ শেখ মুজিবের জীবনে। ছাত্রত্ব কেড়ে নেয়া হয়। কিন্তু তিনি দমে যাবার পাত্র নন। সাহস ও নির্ভিকতার সঙ্গে সবকিছু মোকাবেলা করেছেন। নিজের দল গড়েছেন। নির্বাচনে গিয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন, আবার মন্ত্রিত্ব ত্যাগও করেছেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে কারাগার থেকেও ভূমিকা রেখেছেন। ক্রমান্বয়ে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবিটিকে সামনে নিয়ে আসেন। সারাদেশে গড়ে তোলেন জনগণের রাজনৈতিক সংগঠন। এক পর্যায়ে এসে ঘোষণা করেন বাঙালির মুক্তির সনদ  ছয় দফা। পাকিস্তানী শাসকরা বাঙালির শিল্প, সাহিত্য সংস্কৃতির কণ্ঠ রোধ করতে নানা নিপীড়নের পন্থা বেছে নেয়। রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার নিষিদ্ধ করে। নজরুলের রচনাকে ইসলামীকরণ শুরু হয়। বাঙালির সংস্কৃতিচর্চায় আসে বাধা। ধর্মের নামে, বর্ণের নামে পাকিস্তানীরা বাঙালির বিকাশের সব পথ রুদ্ধ করে দিতে চায়। পাশাপাশি শাসকগোষ্ঠী তাদের পক্ষে একটি দালালগোষ্ঠী তৈরি করে। যারা বাঙালির ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ইসলামীকরণ করে বিজাতীয় রূপ দিতে সচেষ্ট ছিল। শেখ মুজিবকে মিথ্যে মামলায় জড়িয়ে কারাগারে আটক রাখা হলে জনগণ ক্ষুব্ধ হতে থাকে। এক সময় জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ছাত্রসমাজ সামরিক জান্তাবিরোধী আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। জান্তার গুলি, টিয়ারগ্যাস, জেল, জুলুম উপেক্ষা করে সারাদেশে বাঙালি প্রতিরোধে নেমে পড়ে। গণঅভ্যুত্থানে পতন ঘটে সামরিক জান্তা শাসকের। ক্ষমতা আরেক জান্তার হাতে চলে যায়। গণদাবির মুখে শাসকরা সাধারণ নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়। ততদিনে শেখ মুজিব জনগণের একচ্ছত্র নেতায় পরিণত হন। হয়ে ওঠেন ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, বাংলাদেশের গানে গানে চিরঞ্জীব।’ ছাত্রসমাজ তখন আন্দোলনের মধ্যগগনে দাঁড়িয়ে জনগণকে স্বাধিকারের আন্দোলনের দিকে ধাবিত করেন। নির্বাচনে শেখ মুজিবের আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে। তিনি হয়ে ওঠেন ততদিনে বঙ্গবন্ধু। আর নির্বাচিত পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতায় পরিণত হন। বাংলার মানুষ শেখ মুজিবকে তাঁদের মুক্তির দূত হিসেবে মর্যাদা দিতে থাকেন। নির্বাচনে বিজয়ের পর সামরিক জান্তা বাংলার নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানা শুরু করে। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকে তিনদিন আগে তা স্থগিত ঘোষণা করে। আর ফেটে পড়ে সারা বাংলাদেশ। দরিদ্র্র, হতশ্রী, ভাগ্যবিড়ম্বিত জাতি এক কাতারে শামিল হয়ে দাবি আদায়ের সেøাগানে মিছিলে মুখরিত হয়ে পড়ে। দেশজুড়ে শুরু হয়  পহেলা মার্চ থেকে অসহযোগ আন্দোলন। জনগণ লাঠিসোঁটা নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় বিক্ষোভ করতে থাকে। কিন্তু পাকিস্তানী হানাদাররা বাঙালিদের ওপর গুলি চালায়। দোসরা মার্চ রাতে শুধু ঢাকাতেই ২৩ জন বাঙালি নিহত ও ৩ শতাধিক আহত হয়। দেশজুড়ে হরতাল চলছিল। পাশাপাশি হানাদাররা কারফিউ জারি করে। জনতা কারফিউ ভঙ্গ করে রাস্তায় সেøাগানে মুখরিত হয়ে ওঠে।  তেসরা মার্চ হরতাল চলাকালে সারাদেশে পাকিস্তানী সেনাদের গুলিতে শতাধিক বাঙালি শহীদ হন। আহত হন কয়েক শ’ বাঙালি।
বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে মৃত্যুর খবর আসতে থাকে। বিচলিত কবি শামসুর রাহমান লিখলেন, ‘বারবার ফিরে আসে রক্তাপ্লুত শার্ট।’ যেন এ মৃত্যুর শেষ নেই, শামসুর রাহমানও প্রশ্ন করে উত্তর পান না; ‘বাংলাদেশ শুধু এক সুবিশাল শহীদ মিনার হয়ে যাবে?’ এই প্রশ্নের জবাব পেয়েছিল জাতি ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায়। যে জনসভায় শেখ মুজিব পুরো জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়ে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়ে বজ্রকণ্ঠে উচ্চারণ করেছিলেনÑ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ ততদিনে ছাত্রসমাজ স্বাধীনতার সেøাগান ধারণই শুধু নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকাও তৈরি করে। সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে যে পতাকা মুক্তির দীপ্রতারুণ্যে। শেখ মুজিবের আহ্বানে স্বাধিকার ও স্বাধীনতার আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানায় আগা খান সম্প্রদায়ও। বঙ্গবন্ধুর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবিতে শিল্পসাহিত্য, সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্র জগতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা রাস্তায় নেমে আসেন ব্যানার প্ল্যাকার্ডসহ। পাকিস্তানীদের নির্বিচারে গুলি করে বাঙালি হত্যার প্রতিবাদে পাকিস্তান সরকারের খেতাব ও তমঘা বর্জন করেন শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, শিক্ষাবিদ ইব্রাহীম খাঁ, কবি আহসান হাবীব ও কথাশিল্পী সরদার জয়েনউদ্দিন, সঙ্গীতজ্ঞ আবদুল আহাদ প্রমুখ। অসহযোগ আন্দোলনের আগেই একাত্তরের ফেব্রুয়ারির মাঝে সৈয়দ হাসান ইমামকে আহ্বায়ক এবং ওয়াহিদুল হক আর আতিকুল ইসলামকে যুগ্ম আহ্বায়ক করে ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পীসমাজ’ গঠিত হয়েছিল। এরা তখন উরিরচর, চরফ্যাশন এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত মানুষের সেবা সহায়তা করতে করতে এ বিষয়ে পাকিস্তানী প্রভুদের অমানুষিক নির্বিকারতা লক্ষ্য করে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছিলেন। তাই ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পীসমাজ’ গঠন। অসহযোগ আন্দোলনকালে সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো দেশপ্রেমের গানে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে রাস্তায় নেমে আসে। আন্দোলনের অন্যতম শিল্পী সানজীদা খাতুন সে সময়টিকে তুলে ধরে বলেছেন, ‘ঊনসত্তর থেকে একাত্তরের ২৪ মার্চ পর্যন্ত, বিশেষ করে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জয়লাভের পর থেকে সারাদেশ উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছিল। বঙ্গবন্ধুর শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য হাতে যা পাওয়া যায় তাই নিয়ে ঘরে ঘরে প্রস্তুতির কথা বলছেন, রাজনৈতিক সংলাপ চালাচ্ছেন, বাংলাদেশের শাসনব্যবস্থা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করে যাবতীয় নির্দেশ দিচ্ছেন। সেই সময়ে নেতার নির্দেশ মতোই অস্ত্রের মহড়া কিছু কিছু হলেও মানুষ তখন প্রধানত ছুটছে শহীদ মিনারের গান আর ময়দানের বক্তৃতা থেকে উদ্দীপ্ত হবার জন্যে। সেই তাপ লাগল পাকিস্তানের পতাকায়। পুড়ল পতাকা। টেলিভিশনের পর্দাতেও আন্দোলনে যাবার আহ্বান। দেশাত্মবোধক গানÑ ‘জন্ম আমার ধন্য হলো মাগো, ও আমার বাংলা মা।’ গানে গানে বলা হতে লাগলÑ ‘ওরে আগুন আমার ভাই, আমি তোমারই জয় গাই।’ একাত্তর সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্র রাত্রির অধিবেশন শেষে পাকিস্তানী পতাকা উড়াবে না বলে জেদ করল। সরাসরি রবীন্দ্রনাথের দেশপ্রেমের উদ্দীপক গান পরিবেশন করতে করতে ২৩ মার্চের রাত্রি বারোটা পার করে তার পরে পতাকা দেখাল তারা। প্রতিবাদের কত ধরনই যে দেখা গেছিল তখন। ৮ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত বেতার এবং টেলিভিশনে বুদ্ধিজীবীদের নিয়ন্ত্রণ ছিল কার্যকর।’
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী ভাষণের পর মার্চ জুড়েই গোটা বাংলার অসহযোগ আন্দোলনের যে জোয়ার বয়ে যায়। তা ইতিহাসে শুধু অনন্য ঘটনাই নয়, বাঙালি জাতির জন্য অবিস্মরণীয় অবশ্যই। বাঙালির ইতিহাস নতুন পথে ধাবিত তখন। অসহযোগের স্বেচ্ছাব্রতী রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথ ধরেই এসেছিল মুক্তিযুদ্ধ। বাঙালি আর হুমকিতে ভীত নয় বলে বেতার ও টেলিভিশনে সেন্সর করা সংবাদ পাঠকালে পাঠকরা কালোব্যাজ পরতে শুরু করেন।
বেতার, টিভি, চলচ্চিত্র ও চারুশিল্পীরা বাংলা একাডেমিতে সমবেত হয়ে স্বাধীনতার পক্ষে নিজেদের অবস্থান ঘোষণা করে। সেখানে সেøাগান ওঠে, ‘যন্ত্রীরা তবলা ছেড়ে ধরবে দামামা।’ সারা বাংলা নতুন নতুন সেøাগানে মুখরিত হয়ে ওঠে। সবার চোখে-মুখে ‘বাধা দিলে বাধবে লড়াই’ মনোভাব। কণ্ঠে আকাশ বাতাস কাঁপানো সেøাগান : ‘তোমার দেশ আমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ’, ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব’, ‘ভুট্টোর মুখে লাথি মারো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’, ‘ইয়াহিয়ার ঘোষণা-মানি না মানি না’। এদিকে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার না করায় বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ ক্ষুব্ধ হয়। তাঁরা বেতার ও টিভিতে শর্ত প্রদান করলেন, ‘আমরা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করব। তবে যাবতীয় অনুষ্ঠান অবশ্যই আন্দোলনের অনুকূল হতে হবে।’ কর্তৃপক্ষ এ শর্ত মানতে বাধ্য হয়েছিল। রাজনৈতিক আন্দোলনকে সফল করতে সাংস্কৃতিক আন্দোলন পরিপূরক হিসেবে দাঁড়িয়েছিল তখন। বাঙালি অসহযোগ আন্দোলনকে সফল করতে পেরেছিলেন সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সক্রিয়তায়। সর্বস্তরের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার জন্য সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো হাতে নিয়েছিল নানা কর্মসূচী।
‘বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল পূণ্য হউক’ বলে ধ্বনিত হতে থাকে গান। মিছিলের নগরী ঢাকাতে শিল্পীরা গলায় হারমোনিয়াম বেঁধে গেয়ে উঠতেন, ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে, কিংবা ‘বুক বেঁধে তুই দাঁড়াস দেখি’, ‘এবার তোর মরা গাঙ্গে’, ‘একি অপরূপা রূপে মা’সহ আরও কত শতগান। সব গণসঙ্গীত সেদিন মূর্ত হয়ে ওঠেছিল শিল্পীদের কণ্ঠে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১২৮ জন শিক্ষক ৩ মার্চ এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেন যে, “দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির জন্য শোষক শ্রেণী ও কায়েমী স্বার্থবাদী মহল দায়ী। বিভিন্ন ষড়যন্ত্র ও কারসাজির মাধ্যমে তারা শোষিত জনসাধারণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির দাবিকে নস্যাৎ করে দেয়ার চেষ্টায় লিপ্ত। পাকিস্তানের ইতিহাসে চিহ্নিত দু’একটি রাজনৈতিক মহলের অযৌক্তিক দাবির অজুহাতে জাতীয় পরিষদের আসন্ন অধিবেশন স্থগিতকরণ এই অশুভ ষড়যন্ত্রের সর্বশেষ বহির্প্রকাশ। দেশকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে।” ঢাকায় ২৪ জন প্রখ্যাত শিল্পী ৪ মার্চ এক যুক্ত বিবৃতিতে উল্লেখ করেন, যতদিন পর্যন্ত গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র চলতে থাকবে এবং যতদিন পর্যন্ত দেশের জনগণ ও ছাত্র সমাজ সংগ্রামে লিপ্ত থাকবেন, ততদিন পর্যন্ত তারা বেতার ও টেলিভিশনে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন না। প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫০ জন শিক্ষক বাংলাদেশের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রতি সমর্থন জানিয়ে এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, এজন্য যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত রয়েছেন। অপরদিকে পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন পূর্ব বাংলার স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে সামরিক আইন প্রত্যাহারের দাবি জানায়। এক সমাবেশে ইউনিয়ন নেতারা বলেন, সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের ওপর যেসব বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে, অবিলম্বে তা প্রত্যাহার করতে হবে। সঠিত মতামত প্রকাশের অধিকার না দিলে সাংবাদিকরা বেতার ও টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন না।
বাংলার ৩৩ জন চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা-অভিনেত্রী ও সঙ্গীত পরিচালক এক যুক্ত বিবৃতিতে ঘোষণা করেন যে, পূর্ব বাংলার ন্যায্য দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত চলচ্চিত্র সমাজ জনতার সংগ্রামের সঙ্গে থাকবে। বিবৃতিতে সই করেছিলেন, আবদুল জব্বার খান, সালাউদ্দিন, ইফতেখারুল আলম, মুস্তাফিজ, আনোয়ার হোসেন, শবনম, রাজ্জাক, রোজী, কবরী, আজিম, সুজাতা, সুলতানা জামান, আবুল খায়ের, কিউএম জামান, গোলাম মোস্তফা, আবদুস সামাদ, নারায়ণ ঘোষ, সত্য সাহা, গাজী মাযহারুল আনোয়ার, সুবল দাস, আলতাফ মাহমুদ, সুচন্দা ও জহির রায়হান প্রমুখ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীরা ৫ মার্চ সকালে বিশ্ববিদ্যালয় মাঠে আন্দোলনে নিহত শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে গায়েবানা জানাজায় অংশ নেন। পরে প্রতিবাদ মিছিল বের করা হয়। কালো কাপড়ের ব্যানার ও প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘বাঙালি হত্যা বন্ধ কর, সামরিক শাসন বাতিল কর, গোলটেবিল না রাজপথÑ রাজপথ রাজপথ, স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলা কায়েম কর, নতুন নাম নতুন দেশÑ বাংলাদেশ, বাংলাদেশ, কৃষক রাজ শ্রমিক রাজ কায়েম কর।’ পূর্বপাকিস্তান সরকারী কলেজ শিক্ষক সমিতি এক বিবৃতিতে শেখ মুজিবের ভূমিকার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে বলেন, তারা যে কোন ত্যাগ স্বীকার করতে প্রস্তুত।
সারাদেশ নানা পেশার মানুষের মিছিলে মিছিলে সয়লাব। সবার কণ্ঠে একই ধ্বনি, ‘বাংলাদেশ স্বাধীন কর, জয়বাংলা।’ ৬ মার্চ বাংলা একাডেমিতে বেতার, টিভি ও চলচ্চিত্র শিল্পীদের এক সভায় স্বাধিকার আন্দোলনের মূল বিষয়কে গানের সুরে জনতার মুখে মুখে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য সিদ্ধান্ত হয়। তারা পূর্ব বাংলায় পাইকারি গণহত্যার বিচার অনুষ্ঠানের দাবি জানায়। এই দিনে পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়ন প্রেসক্লাব থেকে মিছিল বের করে। বায়তুল মোকাররমে সমাবেশে ইউনিয়ন সভাপতি কেজি মোস্তফা পূর্ব বাংলার গণআন্দোলনকে সঠিকভাবে বিশ্বের কাছে তুলে ধরার জন্য বিশ্বের সকল সাংবাদিকদের প্রতি আহ্বান জানান। এমনকি কোন প্রকার বিধিনিষেধ না মানার ঘোষণা দেন। তারা পূর্ব বাংলার গণআন্দোলনকে সমর্থন করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের সাংবাদিকদের প্রতিও আহ্বান জানান।
৭ মার্চ বেতারে শেষ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সরাসরি প্রচারে সামরিক জান্তারা বাধা প্রদান করায় সকল বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারী বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে বেতার কেন্দ্র বন্ধ রেখে রাস্তায় নেমে আসেন। তাদের ক্ষোভের মুখে পরদিন সকালে ভাষণ প্রচার করা হয়। দেশের শিল্পীসমাজ তখন স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠে। ৮ মার্চ শিল্পীরা ঘোষণা করেন, বাংলাদেশের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার গণআন্দোলনের সঙ্গে প্রতিবারের মতো এবারেও বাংলার সমগ্র শিল্পীসমাজ একাত্ম রয়েছেন। অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শিল্পীরা অনুষ্ঠান বর্জন করে চলেছেন। কিন্তু এই মুক্তি সংগ্রামের চেতনাকে সদা জাগ্রত রাখার অনুপ্রেরণা যোগানোর প্রয়োজনে নানামুখী সঙ্গীত, নাটক প্রভৃতি প্রচারের প্রয়োজন রয়েছে। তাই শিল্পীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ১০ মার্চ থেকে রেডিও, টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন এই শর্তে যে, যাবতীয় অনুষ্ঠান অবশ্যই আন্দোলনের অনুকূলে হতে হবে। কোন অবস্থাতেই আন্দোলনের পরিপন্থী অথবা দেশের সামগ্রিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অসঙ্গতিপূর্ণ অনুষ্ঠান তাঁরা প্রচার করবেন না। যতদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকবে, ততদিন প্রদেশের সমস্ত সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান ও সঙ্গীত একাডেমিগুলো বন্ধ থাকবে, যদি আবার সামগ্রিক হরতাল ঘোষিত হয়, তাহলে শিল্পীদের অসহযোগ আন্দোলন পুনরায় চলতে থাকবে। উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী ১০ মার্চ বাংলার মুক্তি অন্দোলনের পটভূমিতে বাংলার সর্বস্তরের লোকদের কাছ থেকে গণমুখীসঙ্গীত রচনা করার আহ্বান জানান। স্বাধিকার আন্দোলনে ব্যাপক গণহত্যার প্রতিবাদে বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী মুর্তাজা বশীর তথ্য ও জাতীয়বিষয়ক দফতরের উদ্যোগে আয়োজিত চিত্র প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণে অস্বীকৃতি জানান। শিল্পী জানান, মুক্তি ও স্বাধিকার আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী বাংলার নিরস্ত্র জনগণ যখন একাত্তরে প্রাণ হারাচ্ছেন, ঠিক সেই সময়ে আমি সচেতন শিল্পী হিসেবে ইসলামাবাদ সরকার আয়োজিত চিত্র প্রদর্শনীতে অংশ নিতে পারি না।
চারু ও কারুশিল্প মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ শিল্পী সৈয়দ শফিকুল হোসেনের সভাপতিত্বে ১২ মার্চ অনুষ্ঠিত এক সভায় শিল্পীরা বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়। আন্দোলনমুখী পোস্টার ফেস্টুনসহ মিছিলের আয়োজন করা প্রভৃতি কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। টেলিভিশন নাট্যশিল্পীদের ১৫ মার্চ অনুষ্ঠিত সভায় বঙ্গবন্ধুর আহ্বানের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা করে সিদ্ধান্ত নেন যে, গণআন্দোলনের পরিপন্থী কোন অনুষ্ঠান টেলিভিশনে প্রচার করা হবে না। আবদুল মজিদের সভাপতিত্ব সভার বক্তব্য রাখেন সৈয়দ হাসান ইমাম, শওকত আকবর, ফরিদ আলী, আলতাফ হোসেন, রওশন জামিল, আলেয়া ফেরদৌসী প্রমুখ। টিএসসি, পল্টন, তোপখানা রোড, বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণ, সরদঘাট টার্মিনাল, হাজারীবাগ, শান্তিনগর, মগবাজারসহ শহরের বিভিন্ন এলাকায় গণসঙ্গীত, গণনাট্য অনুষ্ঠান ও পথসভা চলতে থাকে। কবিতা পাঠের আসর বসে পল্টন ময়দানে, টিএসসি সড়কদ্বীপে। পঞ্চাশ ও ষাট দশকের কবিরা অনুষ্ঠানে উদ্দীপনামূলক কবিতা পাঠ করেন। বিক্ষুব্ধ শিল্পীসমাজ, সাহিত্য সংস্কৃতি সঙ্গীতসহ আরও সংগঠন বাহাদুর শাহ পার্ক ও পল্টন ময়দানে ২২ মার্চ ছড়া পাঠের আসর গণসঙ্গীত ও নাটক পরিবেশন করে।
২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস। এই দিন টেলিভিশন বিদ্রোহ করে। রাত ১১টা থেকে ডিআইটিতে অবস্থিত টেলিভিশন কেন্দ্র হতে দেশপ্রেম ও উদ্দীপনামূলক গান পরিবেশন করা হতে থাকে। বাঙালি কর্মকর্তাদের লক্ষ্য রাত ১২টায় পাকিস্তান দিবসে পাকিস্তানের পতাকা না দেখানো। ফাহমিদা খাতুন গাইতে থাকেনে ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’। গানটি ক্রমান্বয়ে গাইতে গাইতে রাত্র ১২টা পার হয়ে যায়। ১২টা ২ মিনিটে অধিবেশন সমাপ্ত করা হয় পাকিস্তান দিবসকে উপেক্ষা করেই। এতে সামরিক কর্তারা ক্ষুব্ধ হন। টেলিভিশন কেন্দ্রে প্রহরারত সেনাবাহিনী কর্তৃক কর্মচারীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের প্রতিবাদে টিভি কেন্দ্রের সকল কর্মচারী অব্যাহতভাবে কাজে যোগদান থেকে বিরত থাকায় ২৪ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা থেকে ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রের অনুষ্ঠান প্রচার বন্ধ থাকে।
‘শেখ মুজিবের পথ ধর, বাংলাদেশ কায়েম কর’ সেøাগান নিয়ে সেদিন রাজ পথে সব পেশার মানুষ নেমে এসেছিলেন। শিল্পী সমাজ তাদের দেশপ্রেম ও স্বাধীনতার অভীপ্সায় কণ্ঠ খুলে গেয়েছিল উদ্দীপনার গান। আর সেই গানের সুরতাল লয়ে উদ্দীপিত বাংলার মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। বিপ্লবের রক্তলাল ঝান্ডা উড়িয়ে দিয়েছিল সেইদিন বাংলার শিল্পীসমাজ। তাদের সেই অবদান বাঙালির ইতিহাসে জ্বল জ্বল করবে চিরকাল।

লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক, কবি ও মহাপরিচালক প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)

 

সর্বাধিক পঠিত