সেচখালে পানিতে কৃষকের মুখে হাসি, বোরো আবাদে বেড়েছে ব্যস্ততা
জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে পানি দিবে, সেজন্যে ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ থেকে মাঠ প্রস্তুত করেছেন কৃষক, সেচপাম্প চালকও খালপাড়ে পানির পাম্প প্রস্তুতের সাথে সাথে ড্রেন সংস্কার করেছেন। কিন্তু সেই পানি এলো প্রায় দেড়মাস পর। তবে পানি এসেছে -এতেই স্বস্তি ফিরে পেয়েছেন। এখন কিছুটা হলেও বিনিয়োগ করা টাকা উঠে আসবে কৃষকদের।
আদশা গ্রামের কৃষক হাসেম মিজি বলেন, আমরাও ডিসেম্বরের শেষে খালের অবশিষ্ট পানি দিয়ে জমি তৈরি করে রেখেছিলাম। নতুন বছরের প্রথমদিকে খালে পানি আসলে আমরা ধানের চারা রোপণ করবো। কিন্তু সেই পানি পেলাম দেড়মাস পর। একই কথা জানান লিটন পাঠান, রফিকুল ইসলাম, আল-আমিন আদশা, মান্দারতলীসহ আশপাশের গ্রামগুলোর কৃষকরা। তারা বলেন, আমরা পানির অভাবে যখন এ বছর বোরো আবাদ করতে পারবো না বলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম, তখন সাংবাদিক ভাইয়েরা আমাদেরকে আশার আলো দেখান। তাদের লেখনির কারণে কর্তৃপক্ষ দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করে। নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে হলেও খালে পানি আসায় আমরা ধানের ক্ষেতে পানি দিয়ে ধানের চারা রোপণ করতে সমর্থ হয়েছি।
পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রতি বছর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে খালে পর্যাপ্ত পানি না ছাড়ায় চাঁদপুর সেচ প্রকল্পভুক্ত ফরিদগঞ্জ উপজেলার পূর্বাঞ্চলের শত শত একর বোরো আবাদি জমি অনাবাদি থেকে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। কৃষকরা ধান রোপণের জন্য প্রস্তুত থাকলেও খাল পানিশূন্য থাকায় সঙ্কট তৈরি হয়। বিষয়টিতে টনক নড়ে উপজেলা প্রশাসন, কৃষি অধিদপ্তর ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের।
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডঃ জাহিদুল ইসলাম রোমান নিজে খালের মধ্যে থাকা বাঁধ অপসারণে স্বেচ্ছাশ্রমে খাল খননের জন্যে জনপ্রতিনিধিদের উদ্বুব্ধ করে খাল খনন উদ্বোধন করেন। পাশাপাশি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও কৃষি অধিদপ্তর দিনরাত পরিশ্রম করে খালের নাব্যতা কিছুটা ফিরিয়ে আনার সাথে সাথে পানি উন্নয়ন বোর্ড পানি সরবরাহ বাড়ালে সঙ্কট মোচনে আশার আলো দেখতে পায় কৃষকরা। গত দুদিনে খালে সেচ উপযোগী পানি সরবরাহ হলে উপজেলার পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা বোরো আবাদের আওতায় আসে।
এ ব্যাপারে গুপ্টি পশ্চিম ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বুলবুল আহমেদ বলেন, কৃষকদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য খাল খনন শুরু করি। ফলে বন্ধ হয়ে যাওয়া খালগুলো দিয়ে পানি সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাসলিমুন নেছা বলেন, কৃষকদের কথা চিন্তা করে দিনরাত পরিশ্রম করেছি। বারংবার মাঠে ছুটে গিয়েছি। অবশেষে পানি সরবরাহ নিশ্চিত হওয়ায় কৃষকের মুখে হাসি ফুটে উঠে এসেছে। ধানের আবাদ হচ্ছে-এটাই পরম প্রাপ্তি।
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অ্যাডঃ জাহিদুল ইসলাম রোমান বলেন, আমার এবং ইউএনওর উদ্যোগে কৃষি বিভাগের সকল কর্মকর্তা, ইউপি চেয়ারম্যান, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বিএডিসি এবং সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে জরুরি সভা করেছি। সেই সভাতে আমি স্বেচ্ছাশ্রমে খাল খননের প্রস্তাব দেই। ক’জন জনপ্রতিনিধি তা গ্রহণ করে কাজ শুরু করায় কৃষকদের মুখে হাসি ফিরে এসেছে। আশা করছি আগামীতে যেন এমনটি না হয় সেজন্যে ৪০ দিনের কর্মসূচিসহ আনুষঙ্গিক কর্মসূচির মাধ্যমে ভরাট হয়ে যাওয়া খাল খনন করলে খালের ন্যবতা ফিরে আসবে এবং পানি সরবরাহও নিশ্চিত হবে।
উল্লেখ্য, ষাটের দশকে চাঁদপুর জেলার তিনটি ও পার্শ^বর্তী লক্ষ্মীপুর জেলার তিনটি উপজেলা নিয়ে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সেচ প্রকল্প চাঁদপুর সেচপ্রকল্প (সিআইপি) তৈরি হয়। প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল বছরে একাধিক ফসল উৎপাদন। কিন্তু গত অর্ধশত বছর পরে এসে সেই উদ্দেশ্য বিভিন্ন কারণে ব্যাহত হচ্ছে। সর্বশেষ কারণ হিসেবে দেখা দেয় খালে পানিশূন্যতা।
পানির অভাবে হাহাকার দেখা গেছে গুপ্টি পশ্চিম ইউনিয়নের আদশা, খাজুরিয়া, মান্দারতলী, হুগলি, সাইসাঙ্গা এবং পাশর্^বর্তী রামগঞ্জ উপজেলার ইছাপুরা গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকার কৃষকদের মাঝে। স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, চাঁদপুর সেচ প্রকল্প কর্তৃপক্ষ যথাসময়ে খালে পানি সরবরাহ না করায় এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
স্থানীয়রা জানায়, প্রতিবছর জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহের মধ্যে খালে পর্যাপ্ত পানি চলে আসায় তারা সেচের মাধ্যমে ইরি বোরো মৌসুমে চাষাবাদ করতেন। কিন্তু এ বছর জানুয়ারি মাস পার হয়ে গেলেও পানি আসেনি।
আদশা গ্রামের কৃষক আবুল কালাম জানান, তিনি এ বছর নিজের পাশাপাশি কয়েক একর জমি আবাদের জন্য হাল দিয়েছেন। কিন্তু একমাস পার হলেও খালে আসেনি এক ফোঁটা পানি। কয়েকটি ক্ষেতে নিত্য ঘরের কাজে ব্যবহার করা পানি দিয়েছেন। এখানো বিস্তীর্ণ জমি আবাদের বাইরে। এভাবে চললে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। দুর্যোগের এ সময় আমরা নিজেদের এবং দেশকে সহযোগিতা করতে ব্যর্থ হওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
মান্দারতলী গ্রামের দেলোয়ার হোসেন, আবুল খায়ের, মানিক হোসেন, মফিজুল ইসলাম জানান, পানির অভাবে ধান ক্ষেতে একবারের স্থানে কয়েকবার হাল দিতে হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেতে পানি কিনে ধান রোপণ করলেও পানির অভাবে পারেননি বাকিগুলো। কয়েকশ’ একর ধানের আবাদী জমি এভাবে পড়েছিল। কয়েকটি স্থানে ধান ক্ষেত পানির অভাবে ফেটে চৌচির হয়ে যায়।
কৃষকরা জানান, এই এলাকাগুলো কিছুটা উঁচু হওয়ার কারণে পানি সরবরাহে সমস্যা হয়। তাই খাল খনন করাও জরুরি, যাতে আমরা সারা বছর নিরবচ্ছিন্ন পানি পেতে পারি। বর্ষার সময় পানি পর্যাপ্ত থাকলেও শুষ্ক মৌসুমে অন্য এলাকার তুলনায় কিছুটা কম থাকে। এতে আমাদের খরচ বেড়ে যায়। এ বছরতো বিপদেই রয়েছি।
গুপ্টি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বুলবুল আহমেদ বলেন, গুপ্টি পশ্চিম ইউনিয়নসহ পূর্বাঞ্চলের অনেক এলাকা এবং পাশর্^বর্তী উপজেলা রামগঞ্জের বেশ কিছু এলাকায় এ বছর অদ্যাবধি খালে পানি প্রবেশ করেনি। প্রতি বছর জানুয়ারির শুরুতে পানি আসলেও এ বছর তার ব্যতিক্রম ছিল।