বিলুপ্তির পথে তালের নৌকা ॥ আয়-ব্যয়ে বিস্তর ফারাক
গ্রামের বহুল প্রচলিত তালের নৌকা এখন বিলুপ্তির পথে। নৌকা তৈরি কারিগররা শ্রম-ঘামের সাথে নৌকা বিক্রির কোনো মিল না থাকায় এ পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছেন। সরকারি প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোকতা আর অর্থ সহায়তা পেলে এ পেশায় লাভবান হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলো। অনেক কারিগর তাদের পৈত্রিক এ ব্যবসা ধরে রাখার বৃথা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এক কথায় একান্তাই কষ্টে দিনাতিপাত করছে তালের নৌকার কারিগরসহ তাদের পরিবারবর্গ। আসছে বছর নৌকা তৈরির কারিগর পরিবারগুলোকে সরকারি সহায়তার আশ^াস দিয়েছে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ। হাজীগঞ্জ উপজেলার বাকিলা ইউনিয়নের চতন্তর গ্রামে তালের নৌকা তৈরির প্রায় অর্ধশত কারিগর পরিবারের বসবাস।
সরেজমিনে চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক মহাসড়কের বাকিলা ইউনিয়নের চতন্তর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বেশ কিছু তালের নৌকা তৈরি করছে কারিগরগণ। বর্ষা মৌসুমে কৃষি মাঠে পানি থাকা সময়ে গ্রামে কৃষকের কৃষি কাজে, লোক পারাপারে কিংবা এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়িতে অথবা গো-খাদ্য সংগ্রহের জন্য একসময় তালের নৌকার বেশ প্রচলন ছিলো। কাঠের তৈরি ছোট নৌকার বিকল্প হিসেবে এই তালের নৌকা ব্যবহার হতো। গ্রামীণ অবকাঠামোয় রাস্তাঘাট তৈরি হওয়ার কারণে তালের নৌকা প্রচলনে বেশ ভাটা পড়ে। যার কারণে গ্রামে এখন আর তেমন একটা তালের নৌকা চোখে পড়ে না। এছাড়া তালগাছ ক্রয় করে তা কেটে যথাস্থানে নিয়ে লোকবল দিয়ে নৌকা তৈরি করে তা বিক্রি করে যে লাভ হওয়ার কথা তা এখন পাওয়া যায় না। এক কথায়, এখন আর নৌকা তৈরিতে কোনো লাভ পাওয়া যায় না। নৌকা তৈরি বহু কারিগর তাদের পৈত্রিক ব্যবসায় ধরে রাখছেন অন্য কোনো কাজ না জানার কারণে। বর্তমান এই সময়ে দেশে তাল গাছের বেশ আকাল পড়েছে। খুঁজে কোনো রকমে একটি মধ্যম মানের তাল গাছ কিনতে হলে কমপক্ষে ১৫ হাজার টাকা লাগে। সেই গাছ কেটে নৌকা তৈরির স্থানে আনতে হলে আরো কমপক্ষে ৫ হাজার টাকা খরচ পড়ে। গাছের নিচের অংশকে মাঝখান বরাবর কেটে তা দুই ভাগ করা হয়। ২ জন কারিগর প্রায় ৫/৭ দিন টানা কাজ করে একটি নৌকা তৈরি করতে হয়। সব মিলিয়ে পূর্ণাঙ্গ নৌকা তৈরি শেষে একটি ভালো মানের নৌকা সর্বোচ্চ ১০/১২ হাজার টাকায় বিক্রি করতে হয়। এক এক মৌসুমে একজন কারিগর বড় জোর ৫/৭টি নৌকা তৈরি করতে পারেন। এতো কিছুর পরেও নৌকা তৈরির কারিগররা পায়নি কোন সরকারি বা বেসরকারি সহায়তা। যার কারণে দিন দিন তালের নৌকা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
চতন্তর গ্রামের বাসিন্দা তালের নৌকা তৈরির কারিগর আঃ হামিদ জানান, এখন আর নৌকা তৈরিতে কোনো লাভ নাই। পৈত্রিক ব্যবসায় বাবা-দাদার কাছ থেকে শিখেছি। অন্য কোনো কাজ না জানার কারণে বাধ্য হয়ে এই পেশায় পড়ে থাকতে হচ্ছে। নৌকা তৈরিতে কোনো সহায়তা পাননি বলে ক্ষোভ প্রকাশ করে কারিগররা বলেন, সরকার ও কোনোভাবে আমাদেরকে সহযোগিতা করছেন না।
উপজেলার রাজারগাঁও এলাকা থেকে চতন্তর এলাকায় তালের নৌকা ক্রয় করতে আসা আঃ রফিক জানান, ছোট বেলায় সাড়ে ৩ হাজার কিংবা ৪ হাজার টাকায় একটি তালের নৌকা নিলে তা ১০/১২ বছরে নষ্ট হতো না। এখন ১২ থেকে ১৫ হাজারে একটি নৌকা কিনলেও এখন আর আগের মতো স্থায়িত্ব পাওয়া যায়নি। কারণ এখন আর আগের মতো পুরানো তাল গাছ পাওয়া যায় আর নৌকা তৈরির কারিগর খরচ অনেক বেশি পড়ে।
বাকিলা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিলন জানান, আমার ইউনিয়নে তালের নৌকা তৈরির বেশ কয়েকটি পরিবার রয়েছে। এরা প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে তালের নৌকা তৈরি করে এই সৃষ্টিকে ধরে রেখেছে। আসছে বছর এই পরিবারগুলোকে আমার পরিষদ থেকে সরকারি সহায়তা দেয়া হবে।