• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০
  • ||
  • আর্কাইভ

সংকটে চাঁদপুরের ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষিরা

প্রকাশ:  ২৮ জুলাই ২০২২, ১৪:১৭
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

খাদ্যের দাম বৃদ্ধি এবং ডাকাতিয়া নদীর পানি দূষণের কারণে বিলুপ্তির পথে হাঁটছে চাঁদপুরের ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ প্রকল্প। এরই মধ্যে পুঁজি হারিয়ে অনেক চাষি বন্ধ করে দিয়েছেন এই চাষাবাদ। চাষিদের দাবি, পানি দূষণের ফলে চাষ করা মাছ মারা যাচ্ছে। এতে আর্থিকভাবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তারা।
সংকট মোকাবিলায় দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হলে অচিরেই বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে সম্ভাবনাময় এই খাতের। তাই দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি তাদের। অপরদিকে মৎস্য অধিদপ্তর বলছে, সমস্যা সমাধানে কাজ চলছে। পানির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে।
২০০২ সালে দেশে সর্বপ্রথম চাঁদপুরের ডাকাতিয়া নদীতে শুরু হয় ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ পদ্ধতি। চাঁদপুরে নদীতে শুরু হওয়া এই পদ্ধতিকে বলা হয় বাংলাদেশের মডেল। অন্য সব পদ্ধতির চেয়ে বেশি সাশ্রয়ী, সুবিধাজনক এবং লাভজনক হওয়ায় অনেক উদ্যোক্তাই শুরু করেন এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ।
জানা যায়, ২০১০ সালের ২৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চাঁদপুর এলে তিনি হেলিকপ্টার থেকে ডাকাতিয়া নদীতে খাঁচায় মাছ চাষ প্রকল্প দেখেন। এভাবে মাছ চাষের সম্ভাবনা ও লাভজনক দিকগুলো সম্পর্কে তাৎক্ষণিক অবহিত হন তিনি। এর পরপরই দেশের সব নদী অঞ্চলে খাঁচায় মাছ চাষের বিস্তার ঘটানোর জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন।
জেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০০২ সালে ডাকাতিয়া নদীতে ১২টি খাঁচায় পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হয় এই চাষাবাদ পদ্ধতি। এতে ব্যাপক সাফল্য পেয়ে ২০০৫ সাল থেকে বিস্তার ঘটে মাছ চাষের এই পদ্ধতির। এর পরেই চাঁদপুরকে মডেল ধরে নরসিংদী, সিরাজগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় শুরু হয় খাঁচায় মাছ চাষ কার্যক্রম। তবে চাঁদপুরের সেই মডেল চাষাবাদ এখন হুমকির মুখে।
সদর উপজেলার রঘুনাথপুর এলাকার বাসিন্দা আলমগীর গাজী বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চাকরি শেষে ২০০৫ সালে সাতটি খাঁচা দিয়ে নিজ এলাকায় ডাকাতিয়া নদীতে শুরু করেন ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ। শুরুতে ভালো লাভ পান তিনি। লাভজনক হওয়ায় বাড়ান খাঁচার সংখ্যা। ২০১০ সালের মধ্যে তার মাছের খাঁচার সংখ্যা বেড়ে হয় দুই শতাধিক। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে মাছের খাদ্যের দাম কয়েক ধাপে বৃদ্ধি ও ডাকাতিয়ার পানি দূষণে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন তিনিসহ অন্য চাষিরা।
আলমগীর গাজী বলেন, প্রথম দিকে ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ করে ভালো লাভবান হয়েছিলাম। আমার দেখাদেখি এই এলাকার অনেকেই এই পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু করেন। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে নদীর পানি দূষণের ফলে চাষ করা মাছ মারা যাচ্ছে। একটি খাঁচায় যে পরিমাণ মাছের পোনা দেওয়া হয় তার অর্ধেক মাছও এখন বাঁচে না। তাছাড়া মাছের খাদ্যের দামও বেড়েছে কয়েকগুণ। এতে লাভের বদলে আমাদের লোকসান গুণতে হচ্ছে অনেক। লোকসান দিয়ে অনেক চাষিই বন্ধ করে দিয়েছে মাছ চাষ। আমি নিজেও কমিয়েছি খাঁচা। আমার ২০০ খাঁচার মধ্যে বর্তমানে খাঁচা আছে মাত্র ৬৫টি। বাকিগুলো নদী থেকে তুলে ফেলেছি। এভাবে লোকসান হলে সামনে হয়তো সেগুলোও তুলে ফেলে বন্ধ করে দিতে হবে চাষাবাদ।
মৎস্য চাষিরা জানান, ড্রামের ওপর লোহার পাইপ ও জাল দিয়ে তৈরি বিশেষ খাঁচায় চাষ হচ্ছে মনোসেক্স তেলাপিয়া। দিনদিন তেলাপিয়ার চাহিদা বাড়ায়, এ পদ্ধতির মাছ চাষে ঝোঁকেন অনেক বেকার যুবক। স্বল্প খরচে অধিক লাভ হওয়ায় দ্রুত প্রসার ঘটে এই খাতের। এক পর্যায়ে ডাকাতিয়া নদীর দীর্ঘ ১০ কিলোমিটার এবং মেঘনা-ধনাগোদা নদীর তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দুই পাড়ে চার শতাধিক চাষি প্রায় সাত থেকে আট হাজার ভাসমান খাঁচায় মাছ চাষ করতেন। কিন্তু মাছ চাষে এখন আর লাভ না হওয়ায় বর্তমানে খাঁচার সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই হাজারে।
বাচ্চু গাজী, মেহেদী হাসান ও কবিরসহ ডাকাতিয়ার এমন কয়েকশ’ চাষির মধ্যে পুঁজি হারিয়েছেন অনেকেই। আর বর্তমানে যারা চাষাবাদ করছেন, তাদেরও অবস্থা নাজুক। চাষি কবির বলেন, আমার আগে ১২০টি খাঁচা ছিল, বর্তমানে আছে ৬০টি। এভাবে চলতে থাকলে আগামীতে সব খাঁচা নদী থেকে তুলে ফেলবো। কারণ এরই মধ্যে খাদ্যের দোকানে লাখ টাকা দেনা হয়েছে, আর পারছি না।
রঘুনাথপুর এলাকার চাষি বাচ্চু গাজী বলেন, খাদ্যের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি পানি দূষণের ফলে এখন বিশেষ করে বর্ষায় মাছ মারা যায় বেশি। এতে অনেক টাকা লোকসান হয় আমাদের।
তিনি বলেন, ১০ ফুট বাই ২০ ফুট প্রতিটি খাঁচায় ৫০০ পিস মনোসেক্স তেলাপিয়া মাছের পোনা ছাড়া হয়। প্রতি পিস মাছের পোনার দাম পড়ে ১০ থেকে ১৫ টাকা করে। এসব মাছ ৭ থেকে ৮ মাসের মধ্যে ৬০০ থেকে ৭০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়ে থাকে। এই সময়ে প্রতিটি খাঁচায় ৩৫ থেকে ৪০ হাজার টাকার খাদ্য খাওয়ানো হয়। কিন্তু বিক্রি করার উপযুক্ত সময় পর্যন্ত এসে মাছ মরে আমরা পাই ২০০ থেকে আড়াইশো পিস মাছ। আগে যেখানে ১ কেজি তেলাপিয়া উৎপাদন করতে আমাদের খরচ পড়তো প্রায় দেড়শ টাকা, এখন খরচ পড়ছে প্রায় ১৮০ টাকা। আমরা বিক্রিও করছি কেজিপ্রতি ১৭০ থেকে ১৮০ টাকায়। এতে আমাদের লোকসান গুণতে হচ্ছে। তাই অনেক চাষিই তাদের খাঁচা তুলে নিয়েছে।
চাষিরা জানাচ্ছেন, আগে যেখানে ২০ কেজি ওজনের খাবারের বস্তার দাম ছিল ১০৫০ টাকা, তা এখন ১৩০০ টাকা হয়েছে। আর ২৫ কেজি ওজনের খাবারের বস্তা ছিল ১৪৪০ টাকা যা এখন কিনতে হচ্ছে ১৭০০ টাকায়। গত ছয় মাসেই কয়েক ধাপে কেজিপ্রতি খাবারের দাম বেড়েছ ১৫ থেকে ১৬ টাকা।
এদিকে, খাবারের দাম কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেলেও মাছের দাম আগের মতোই আছে। তার ওপর মাছ মারা যাচ্ছে। এতে তারা এখন আর লাভের দেখা পাচ্ছেন না।
চাষিরা আরও বলেন, আগে যেখানে চার শতাধিক চাষি আট সহস্রাধিক খাঁচায় মাছ চাষ করতো। এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫০ থেকে ৬০ জনে। খাঁচাও আছে মাত্র দুই হাজারের মতো। এভাবে চলতে থাকলে অচিরেই তাও বন্ধ হয়ে যাবে। এখনই কোনো কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা না হলে বিলুপ্ত হয়ে যাবে এই চাষাবাদ পদ্ধতি। এতে দেশে আমিষ উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি অনেকেই বেকার হয়ে পড়বেন।
খাঁচায় কাজ করা শ্রমিক বাতেন মিয়া বলেন, আমরা অর্ধশতাধিক শ্রমিক মাছের খাঁচায় কাজ করে সংসার চালাতাম। কিন্তু বর্তমানে খাঁচায় মাছ চাষে চাষিরা লাভবান না হওয়ায় অনেকেই বন্ধ করে দিয়েছেন চাষাবাদ। এতে অনেক শ্রমিক কর্মসংস্থান হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। এখন আমরাও বেকার হওয়ার শঙ্কায় রয়েছি।
এ বিষয়ে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. গোলাম মেহেদী হাসান বলেন, বর্তমানে মাছের খাদ্যের দাম কিছুটা বেশি। এই কারণে আগের মতো লাভবান হতে পারছেন না চাষিরা। তবে অন্যান্য জায়গার নদী দূষণের মতো চাঁদপুরের পানি এত দূষিত নয়। চাষাবাদকালে বিভিন্ন কারণে কিছু মাছ মারা গেলেও তা খুব বেশি নয়। তবে চাষিদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ও চাঁদপুর নদী কেন্দ্রের বিশেষজ্ঞ দল ডাকাতিয়ার পানির নমুনা সংগ্রহ করেছি। রিপোর্ট আসলে বোঝা যাবে মূল কারণ কী। তিনি আরও বলেন, বর্তমানে লাভ কিছুটা কম হওয়ায় সাময়িকভাবে কিছু চাষি খাঁচা তুলে রাখছেন।
খাঁচায় মাছ চাষ কার্যক্রম টিকিয়ে রাখতে চাষিদের কম সুদে ঋণ দেওয়ার জন্য ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।
জেলা মৎস্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য মতে, বর্তমানে চাঁদপুরে দুই হাজার ভাসমান খাঁচায় বছরে উৎপাদিত হচ্ছে প্রায় সাড়ে পাঁচশো মেট্রিক টন তেলাপিয়া মাছ। যা চাঁদপুরের স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে পাশের কুমিল্লা, লক্ষ্মীপুর, নোয়াখালী, শরীয়তপুরসহ বিভিন্ন জেলায় বিক্রি করা হয়। সূত্র : জাগো নিউজ।

 

 

সর্বাধিক পঠিত