• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

চাঁদপুরে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে অপমৃত্যু

প্রকাশ:  ২০ জুলাই ২০২২, ০৯:২২
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

চাঁদপুরে সম্প্রতি অপমৃত্যুর হার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই এ জেলার কোনো না কোনো উপজেলায় আত্মহত্যা কিংবা দুর্ঘটনার কবলে পড়ে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এমন অস্বাভাবিক মৃত্যুর ঘটনায় সাধারণ মানুষ উৎকণ্ঠিত।
    পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদভাষ্য থেকে জানা যায়, চাঁদপুর জেলায় গত ১২ দিনে অন্তত ১০ জনের অপমৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন ৪ জন, দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেছেন অন্তত ৩ জন এবং ৩ জনের রহস্যজনক ও অপমৃত্যু হয়েছে। আত্মহত্যাকারী ব্যক্তিদের মধ্যে যেমন বৃদ্ধ রয়েছেন, তেমনি রয়েছে এক কিশোরও রয়েছে।
    সর্বশেষ গতকাল ফরিদগঞ্জে পারিবারিক কলহের জের ধরে আজগর আলী (১৬) নামে এক কিশোর বিষপানে আত্মহত্যা করে। সে গুপ্টি পূর্ব ইউনিয়নের শ্রীকালিয়া এলাকার বাসিন্দা। পুলিশ তার লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্যে চাঁদপুর মর্গে প্রেরণ করে। এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যু মামলা দায়ের করা হয়েছে। ফরিদগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ শহীদ হোসেন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
    এর আগে গত ৮ জুলাই হাজীগঞ্জের উত্তরপাড়ায় মাহবুব আলম (৪৫) নামে এক ব্যক্তি স্ত্রীদের সাথে অভিমান করে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। তিনি দেনা-পাওনা নিয়েও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ছিলেন বলে জানা যায়। গত ১৭ জুলাই মতলব দক্ষিণের কাজিয়ারা গ্রামে পারিবারিক কলহের জেরে ফজলু মিয়া (৬০) নামে এক বৃদ্ধ বিষপানে আত্মহত্যা করেন। পারিবারিক অশান্তি ও ধার দেনাসহ বিভিন্ন চিন্তায় হতাশাগ্রস্ত হয়ে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে দাবি স্বজন ও এলাকাবাসীর। জানা যায়, উপজেলার কাজিয়ারা এলাকার মৃত ছেরু মিয়া প্রধানের ছেলে ফজলু মিয়া রোববার সকালে পরিবারের লোকজনের অগোচরে কীটনাশক (কেরির ট্যাবলেট) খায়। পরে তার ভাগ্নী দেখতে পেয়ে ডাকচিৎকার দিলে আশপাশের লোকজন এসে তাকে উদ্ধার করে প্রথমে মতলব দক্ষিণ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে যায়। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে উন্নত চিকিৎসার জন্যে চাঁদপুর সদর হাসপাতালে নেয়ার পথে তিনি মারা যান।
    এছাড়া গত ১৮ জুলাই মতলব উত্তরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন ওবায়েদ উল্লাহ (২৩) নামে এক যুবক। তিনি উপজেলার ৬নং কলাকান্দা ইউনিয়নের লতুরদী গ্রামের গোলাম রসুলের ছেলে। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, সোমবার ভোর রাতে পরিবারের সবার অজান্তে নিজের ঘরে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন ওবায়েদ উল্লাহ। তার আত্মহত্যার কারণ জানা যায়নি। তবে তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ ছিলেন বলে জানিয়েছে পরিবার।  এ ঘটনায় ওবায়েদ উল্লাহর পিতা গোলাম রসুল সোমবার সকালে বাদী হয়ে মতলব উত্তর থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করেছেন। মতলব উত্তর থানার থানার এসআই হারুন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
    গত ১০ জুলাই পবিত্র ঈদুল আজহার দিন রাতে মতলব দক্ষিণ উপজেলার বাড়ৈগাঁও গ্রামের ফারুক মিয়া নামে ৩ সন্তানের জনকের রহস্যজনক মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। পরিবারের দাবি, পরিকল্পিতভাবে ওই যুবককে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় নিহতের মা জাহানারা বেগম বাদী হয়ে গত ১২ জুলাই মতলব দক্ষিণ থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার প্রেক্ষিতে একই
বাড়ির অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক ওসমান গণি এবং অটোরিকশা চালক আল-আমিনকে আটক করা হয়েছে। ঘটনার দুদিন পর গত বুধবার সকালে আদালতের নির্দেশে ময়নাতদন্তের জন্যে কবর থেকে লাশ উত্তোলন করে পুলিশ। নিহত ফারুক মিয়া মতলব দক্ষিণ উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের বাড়ৈগাঁও গ্রামের জলেমান্দ বাড়ির মোঃ বাচ্চু ভাণ্ডারীর বড় ছেলে।
    এদিকে সড়ক দুর্ঘটনায় গত ক’দিনে একাধিক ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বেলা সাড়ে ১১টায় চাঁদপুর সদর উপজেলার চান্দ্রা ইউনিয়নের মদিনা মার্কেট-ফরিদগঞ্জ সড়কে বালু-বোঝাই ট্রাক চাপায় ঘটনাস্থলেই অটোবাইক চালক নিহত হয়েছেন। চালকের পরিচয় জানা যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শী সূত্রে জানা গেছে, হরিণা থেকে বালু বোঝাই একটি পিকআপ মিনি ট্রাক ফরিদগঞ্জ যাবার সময় হঠাৎ চাকা বিস্ফোরণ (বাস্ট) হলে চালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি অটোবাইককে চাপা দেয়। এতে অটোবাইকটি পুরোপুরি দুমড়ে-মুচড়ে ঘটনাস্থলেই চালক মারা যায় এবং তিন যাত্রী গুরুতর আহত হয়।
    জানা যায়, গত ১৩ জুলাই চাঁদপুর সদর উপজেলার মির্জাপুর গ্রামে বড়পোলের কাছে ট্রেনের ধাক্কায় বাকি বিল্লাহ বাক্কু ছৈয়াল (৪০) নামে এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। এদিন রাত দশটার দিকে চাঁদপুরগামী মেঘনা এক্সপ্রেস ট্রেনটি মির্জাপুর এলাকা অতিক্রমকালে এ দুর্ঘটনা ঘটে। তিনি ওই এলাকার ছৈয়াল বাড়ির মৃত রশিদ ছৈয়ালের ছেলে। চাঁদপুর রেলওয়ে (জিআরপি) থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ মুরাদ উল্যাহ বাহার এ ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ময়নাতদন্ত শেষে বাকি বিল্লাহর মরদেহ পরিবারের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। এ ঘটনায় একটি অপমৃত্যু মামলা রুজু করা হয়।
    গত ১৫ জুলাই বিকেলে হাজীগঞ্জ উপজেলার কৈয়ারপুল রেলক্রসিং এলাকায় আব্দুল লতিফ (৪৫) নামে আরো এক ব্যক্তি ট্রেন দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন। জানা যায়, চট্টগ্রাম থেকে চাঁদপুরগামী ঈদের বিশেষ ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে তিনি ঘটনাস্থলেই মৃত্যুবরণ করেন। তিনি চাঁদপুর পৌরসভার ১১নং ওয়ার্ডস্থ মধ্য ইচলীর আব্দুস
সাত্তারের ছেলে। রেলওয়ে চাঁদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ মুরাদ উল্যাহ বাহার ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেছেন।
    এছাড়া ১৭ জুলাই ফরিদগঞ্জের সাফুয়া গ্রামের পুকুর থেকে লোকমান হোসেন খোকা (৪০) নামে এক ব্যক্তির লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। জানা যায়, তিনি মানসিক ভারসাম্যহীন ছিলেন। গত ১৮ জুলাই ফরিদগঞ্জ ডায়াবেটিক হাসপাতালে ৩ সন্তানের জননী বিউটি বেগম (৪০)-এর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। ক্ষুব্ধ স্বজনরা এ ঘটনায় হাসপাতালের এক কর্মচারীকে মেরে আহত করেছেন। তাদের দাবি, অবহেলায় রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
    চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের ডাঃ মুহাম্মদ রফিকুল হাসান ফয়সাল বলেন, আজকাল অনেক বাবা-মা সন্তানদের সময় দেন না। সামাজিক অবক্ষয় বেড়েছে। ইন্টারনেট ও সোস্যাল মিডিয়ায় আসক্ত হয়ে পড়ছেন অনেকে। মানুষের মধ্যে হতাশা, অস্থিরতা ও অসহিষ্ণুতা বেড়েছে। ফলে মানুষ আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকেছে। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
    তিনি বলেন, এ বিষয়ে পরিবারকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে। পরিবারের কোনো সদস্য হতাশাগ্রস্ত হলে তাকে উৎসাহ-উদ্দীপনা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে হবে। সমস্যা বেশি হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।

ছবি-১৯
ফরিদগঞ্জে প্রাইভেট হাসপাতালে রোগীর অস্বাভাবিক মৃত্যু
স্টাফ রিপোর্টার ॥ ফরিদগঞ্জের একটি প্রাইভেট হাসপাতালে ১৮ জুলাই রাত ৮টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় এক রোগীর অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। উপজেলা সদরে ডায়াবেটিক হাসপাতালে এই দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে রোগীর স্বজনরা হাসপাতালের কর্মচারীকে মারধর করেছে। খবর পেয়ে ফরিদগঞ্জ থানা পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে।
সরেজমিনে গিয়ে জানা যায়, পৌরসভা এলাকার কেরোয়া গ্রামের পাটওয়ারী বাড়ির মাসুদ পাটওয়ারীর স্ত্রী ৩ সন্তানের জননী বিউটি বেগম (৪০) সোমবার সকালে পেটের ব্যথা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। ডাক্তারের পর্যবেক্ষণে ওই হাসপাতালের একটি আবাসিক ওয়ার্ডে বিউটি বেগম চিকিৎসাধীন ছিলেন। রাত ৮টার সময় রোগীর পরিবারের লোকজন রোগীকে ছটপট করতে দেখে চিকিৎসককে খবর দেয়। কিন্তু চিকিৎসক পৌঁছানোর পূর্বেই রোগী মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
এ ঘটনার জন্যে রোগীর স্বামী মাসুদ পাটওয়ারী চিকিৎসকের অবহেলাকে দায়ী করেন। খবর পেয়ে বিউটি বেগমের মরদেহ গ্রহণ করার সময় স্বজনরা হাসপাতালের কর্মচারী জাহাঙ্গীর (৫৫)কে মারধর করে। এ সময় উৎসুক জনতাকে হাসপাতালে ভিড় করতে দেখা যায়।
বিষয়টি নিয়ে হাসপাতালের পরিচালক ও চিকিৎসক সাদেকুর রহমান বলেন, আমরা বিউটি বেগমকে ভর্তির পর থেকে চিকিৎসা দিয়ে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি। সন্ধ্যায় রোগীর স্বজনরা তাকে শোয়ানো অবস্থায় খাবার খাওয়ালে তার খাদ্যনালিতে ওই খাবার আটকে তিনি তাৎক্ষণিক মারা যান। আমি খবর পেয়ে দু’মিনিটের মধ্যে ঘটনাস্থলে পৌঁছেও বিউটিকে জীবিত পাইনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চিকিৎসকের শত্রু একমাত্র রোগ। আমাদের সাধ্যমত রোগীকে চিকিৎসা দিয়েছি। তার মৃত্যুতে দুঃখ প্রকাশ করছি।
থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ শহীদ হোসেন বলেন, কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটার আগেই পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়েছে। মৃত রোগীর স্বজনদের লিখিত কোনো অভিযোগ পাওয়া যায়নি। অভিযোগ পেলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
বিষয়টি নিয়ে উপজেলা পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা আশরাফ আহামেদ চৌধুরী বলেন, কোনো চিকিৎসক দ্বারাই রোগীর অস্বাভাবিক মৃত্যু কাম্য নয়। অভিযোগ পেলে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

 

সর্বাধিক পঠিত