জ্বালানি সংকটে দীর্ঘ বছর পর অস্বাভাবিক লোডশেডিং
গত কদিন বিদ্যুতের যে পরিমাণ লোডশেডিং হচ্ছিল, তাতে মানুষজন একেবারে হাঁফিয়ে উঠেছিল। প্রায় এক যুগের মতো হবে মানুষ লোডশেডিংয়ের সাথে তেমন একটা পরিচিত না হওয়ায় হঠাৎ করে অস্বাভাবিক লোডশেডিংয়ে নাভিশ্বাস উঠে গেছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গড়ে মাত্র ৯/১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকতো। একেকবার বিদ্যুৎ চলে গিয়ে দেড় দুই ঘণ্টা বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় থাকতো। যখন আসতো আঘা ঘণ্টার মতো থাকতো, আবার চলে যেতো। এভাবে দিনে-রাতে ৮-১০ বার লোডশেডিং হয়েছে। বিদ্যুতের এমন ভয়াবহ অবস্থা হয়েছিল ২০০৭-০৮ থেকে ২০০৯-১০ সাল এবং তারও আগে। দীর্ঘ ১৩-১৪ বছর পর আবারো এমন ভয়াবহ লোডশেডিং দেখল চাঁদপুর জেলাবাসী। শুধু চাঁদপুর নয়, সারাদেশেই একই অবস্থা বিরাজ করছিল গত ক’দিন। গত রোববার থেকে এমন ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কবলে ছিল দেশের জনগণ। আর এ সমস্যা জাতীয়ভাবেই। তবে স্বস্তির খবর হচ্ছে- গতকাল সন্ধ্যা থেকে পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে।
গত এক সপ্তাহ যাবত হঠাৎ করে বিদ্যুতের লোডশেডিং দেখা দেয়। রোববার থেকে এটি প্রকট আকার ধারণ করে। দিনে-রাতে মিলে ৮-১০ বার লোডশেডিং হয়েছে। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গড়ে ১৪-১৫ ঘণ্টাই বিদ্যুৎ থাকতো না। এ অবস্থা ছিল শহরের। গ্রামের অবস্থা ছিল আরো ভয়াবহ। পল্লী বিদ্যুতের আওতায় গ্রামে গড়ে ৪-৫ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকতো। একেকবার বিদ্যুৎ চলে গিয়ে ৩-৪ ঘণ্টায়ও আসতো না। এক দুর্বিষহ অবস্থায় কাটিয়েছে গ্রাহকরা। গরমের অসহ্য যন্ত্রণার পাশাপাশি মানুষের স্বাভাবিক কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হতে লাগলো। বিদ্যুৎ নির্ভর কাজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। হঠাৎ এমন দুর্বিষহ অবস্থায় মানুষ যেনো দিশা হারিয়ে ফেলেছিল। কী কারণ থাকতে পারে এমন ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের? এমন প্রশ্ন ছিলো মানুষের মুখে মুখে। বিষয়টি সোমবার রাতে এবং গতকাল জানাজনি হয় যে, জাতীয়ভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে। জ¦ালানি তথা গ্যাস সঙ্কটে দেশের বেশ কিছু বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। যেগুলো চালু রয়েছে সেগুলোতেও উৎপাদন হচ্ছে অর্ধেকেরও কম। চাঁদপুরের তিনটি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রেও এ প্রভাব পড়েছে।
চাঁদপুর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ মিজানুর রহমান জানান, চাঁদপুরের দেড়শ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন যে সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি রয়েছে, সেখানে গত এক সপ্তাহ যাবত মাত্র ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে। এছাড়া অন্য দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র যে রয়েছে, সেগুলোতেও অনেক কম উৎপাদন হচ্ছে। দুই শ' মেগাওয়াটের দেশ এনার্জি বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ১৪ মেগাওয়াট, আর ১১৫ মেগাওয়াটের ডরিন বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন হচ্ছে ৯৪ মেগাওয়াট। তিনি আরও জানান, জাতীয়ভাবে এক হাজার থেকে দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি ছিলো গত ক’দিন। যার প্রভাবে চাঁদপুরসহ সারাদেশে এই লোডশেডিং।
বিদ্যুতের এই ঘাটতির কারণ হিসেবে তিনি গ্যাস সঙ্কটকে উল্লেখ করে বলেন, আমাদের দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় ন্যাচারাল গ্যাস, জ্বালানি তেল এবং কয়লা থেকে। গ্যাসের একটা অংশ খঘএ ( লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস) দিয়ে পূরণ হয়। আর এই খঘএ পুরোটাই আমদানি করতে হয়। সম্প্রতি আকস্মিক খঘএ আমদানিতে সমস্যা হয়। যার কারণে দেশের বেশ কিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায় এবং অনেকগুলোতে উৎপাদন অনেক কমে যায়। এ অবস্থা চাঁদপুরের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোরও। এখানকার বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উৎপাদন পুরোপুরি বন্ধ না হলেও অনেক কমে যায়। যার প্রভাব পড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহে। তিনি জানান, চাঁদপুর জেলায় বিদ্যুৎ চাহিদা হচ্ছে দেড় শ' মেগাওয়াট। গত কদিন আমরা পেয়েছি সর্বোচ্চ মাত্র ৭০ মেগাওয়াট। তিনি আরো জানান, চাঁদপুর পিডিবি এবং পল্লী বিদ্যুতের সদর অংশে বিদ্যুতের চাহিদা হচ্ছে ৭০ মেগাওয়াট। তার মধ্যে আমরা পেয়েছি মাত্র ৩০ মেগাওয়াট। এই ৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকে ২৪ ঘণ্টায় সার্ভিস দিতে গিয়ে এতো লোডশেডিং করতে হয়েছে।
এদিকে গতকাল বিকেলে যখন বিদ্যুৎ বিভাগের এই কর্মকর্তার সাথে এই প্রতিবেদকের কথা হচ্ছিল, তখন ঢাকা থেকে তাঁর কাছে ফোন আসে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টা থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। এ খবর পেয়ে তিনি স্বস্তি প্রকাশ করেন এবং এই প্রতিবেদকের মাধ্যমে জেলাবাসীকে এ খবর জানান। তাঁর এই স্বস্তিদায়ক খবরের সত্যতাও মিললো। গতকাল সন্ধ্যা থেকে বাস্তবেই পরিস্থিতির উন্নতি হতে দেখা যায়। সন্ধ্যায় নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ মিজানুর রহমানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আমরা এখন পুরো লোড পাচ্ছি। সাড়ে ছয়টা থেকেই পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে। চাঁদপুর পিডিবির চাহিদা ২২ মেগাওয়াট, তার পুরোটাই আমরা পাচ্ছি।