শুল্ক প্রত্যাহারের ঘোষণায়
পাইকারী বাজারে তেল চিনির দর নি¤œমুখী, প্রভাব পড়েনি খুচরা বাজারে
বেড়েছে চালের দাম
গত ক’দিনে অস্থির হয়ে ওঠা ভোজ্য তেলসহ চিনির দাম গতকাল পাইকারি বাজারে কিছুটা নি¤œমুখী হলেও খুচরা বাজারে এর প্রভাব পড়েনি। সরবরাহের দোহাই দিয়ে খুচরা বাজারে একেক দোকানে একেক দামে বিক্রি হচ্ছে তেল, ডাল, চিনি, চাউলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। যে যেভাবে পারছে সে সেভাবেই বিক্রি করছে এ সকল পণ্য। তবে তেল, চিনি ও সয়াবিনের দাম সহনীয় রাখতে ভ্যাট প্রত্যাহার করে নিচ্ছে সরকার এ তথ্য বাজারে আসার পর অতি প্রয়োজনীয় তেল, চিনির দাম কিছুটা কমতে দেখা গেছে পাইকারী বাজারে।
জানা যায়, সয়াবিন তেলের ক্ষেত্রে উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ এবং ভোক্তা পর্যায়ে ৫ শতাংশ ভ্যাট মওকুফ করা হয়েছে। অর্থাৎ তেলের ক্ষেত্রে সব মিলিয়ে ২০ শতাংশ পর্যন্ত ভ্যাট মওকুফ করা হয়েছে। যা আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত বহাল থাকবে। বর্তমান বাজারে সয়াবিন তেলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য ১৬৮ টাকা। শুল্ক প্রত্যাহার হলে সয়াবিন তেলের মূল্য লিটারে কমতে পারে ৩০ টাকা। চিনিতে ১০ শতাংশ শুল্ক ছাড় দেয়া কার্যকর হলে বর্তমান বাজার মূল্য থেকে অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে আসবে চিনির দাম।
গত ১২ মার্চ শনিবার আমদানি নির্ভর চাঁদপুরের পাইকারী বাজার পুরাণবাজার গিয়ে দেখা যায় সয়াবিন তেল বিক্রি হচ্ছে ১৬৮ টাকা, যা গত এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ১৭৩ থেকে ১৭৫ টাকা। চিনি বিক্রি হচ্ছে ৭৪/৭৫ টাকা, যা এক সপ্তাহ আগে বিক্রি হয়েছে ৭৮ থেকে ৮০ টাকা। দোকানদারদের ভাষ্য মতে তেল, ডাল, আটা, ময়দা, চিনিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় বেশ কিছু পণ্যের দামই কিছুটা নি¤œমুখী। তবে ভ্যাট বা শুল্ক প্রত্যাহারের ঘোষণায় বাজার কতটা নি¤œমুখী হবে তা এখনই বলা সম্ভব নয়। আমদানিকারকরা যদি পণ্য আমদানিতে নিরুৎসাহী হন আর ভোজ্য তেলের মিল মালিকরা যদি চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না করেন তাহলে বাজারে এর প্রভাব পড়বে এবং আমদানি কম হওয়ার কারণে পণ্যের বাজার আরো বেশি করে অস্থির হয়ে পড়বে।
তারা আরো বলেন, সরকার যদি আরো আগে শুল্ক প্রত্যাহারপূর্বক তেল, গম আমদানি করতেন তাহলে এখন আর বাজারে তেল নিয়ে বা খাদ্য সামগ্রীর বাজার বৃদ্ধির এই তেলেসমাতি ঘটনা ঘটতো না। এখন আন্তর্জাতিক বাজারেই তেল, ডাল, গম, চিনির বাজার মূল্য অনেকটা বেশি। আর আমদানিকৃত পণ্য দেশে আসতেও বেশ কিছুদিন সময় অতিবাহিত হবে। ফলে এখনই পুরোপুরি বাজার নিয়ন্ত্রণ করা কতটুকু সম্ভব তা বলা সম্ভব নয়। তবে শুল্ক প্রত্যাহারের ঘোষণায় হঠাৎ বেড়ে যাওয়া তেল, চিনি, আটা, ময়দাসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সামগ্রীর দাম কমে যাওয়ার ভয়ে অনেকটা বেকায়দায় রয়েছে এসকল পণ্য মজুদকারী কিছু ব্যবসায়ী। যারা রোজাকে পুঁজি করে বাড়তি মুনাফা করার আশায় ছিল তৎপর। শুল্ক প্রত্যাহারের ফলে মজুদদাররা আর সে সুযোগ পাবে না বলেই কেউ কেউ মনে করেন। তারা বলেন, শুল্ক বা ভ্যাট কমানোর ফলে আগামী এপ্রিলে দেশে যে পণ্য আমদানি হবে তাতে রোজার বাজার অনেকটাই স্থিতিশীল থাকবে। প্রতি বছরই রোজাকে সামনে রেখে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার অস্থির হয়ে পড়ে। কিন্তু এ বছর হয়েছে এর ব্যতিক্রম। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অজুহাতে পণ্য আমদানি কম দেখিয়ে তেল চিনিসহ নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য রাতারাতি বাড়তে থাকে। আর বেশি দামে পণ্য কিনতে গিয়ে নাভিশ্বাস দেখা দেয় ক্রেতাসাধারণের মাঝে। রান্নার তেল নিয়ে দেখা দেয় বাজারে তেলেসমতি। ব্যবসায়ীদের অভিযোগের তীর বিঁধে মিল মালিকদের প্রতি। আর মিল মালিকদের অভিযোগ, তারা নিয়মিত সরবরাহ দিয়ে যাচ্ছে ডিলারদেরকে। এই অভিযোগের রশি টানাটানিতে পিষ্ট হয়েছে ক্রেতাসাধারণ, আর পকেট পুরেছে অসাধু ব্যবসায়ীগণের। বাজারে মূল্যবৃদ্ধির ক্ষোভের মুখে পড়েছে সরকার। অথচ সরকারের হিসেব অনুযায়ী দেশে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে অপরিশোধিত চিনি আমদানি হয়েছে চার লাখ ৮৮ হাজার টন, যা আগের বছরের তুলনায় দুই লাখ ৬০ হাজার টন বেশি। অপরিশোধিত চিনির আমদানি মূল্য প্রতি কেজি গড়ে ১১ টাকা বেড়ে প্রায় ৩৯ টাকা দাঁড়িয়েছে। প্রতি কেজিতে শুল্ক কর দিতে হয়েছে ১৯ টাকা। খুচরা বাজারে এখন চিনির কেজি ক্ষেত্র বিশেষ ৭৮ থেকে ৮০ টাকা। অথচ গত বছরে তা বিক্রি হয়েছে ৬০ থেকে ৬২ টাকা।
দেশে ২০২২ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে সয়াবিন ও পাম তেল মিলিয়ে ভোজ্য তেল আমদানি হয়েছে তিন লাখ ৮৮ হাজার টন। এটি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ৬০ হাজার টন বেশি। সয়াবিন তেল উৎপাদনের কাঁচামাল সয়াবীজও ৩৯ হাজার টন বেশি আমদানি হয়েছে। ফলে সরকারি হিসেব অনুযায়ী আমদানিতে কোনো সংকট না থাকার পরও তেলের হঠাৎ মূল্য বৃদ্ধিতে কোনো কোনো ব্যবসায়ী ডিও ব্যবসাকে দায়ী করেছেন। তাদের অভিমত, তেল ডাল চিনিসহ নিত্যপণ্য ব্যবসায়ী ছাড়াও অঘোষিত অনেক ব্যবসায়ী রয়েছেন, যারা অন্য ব্যবসার সাথে জড়িত হয়েও পর্দার অন্তরালে থেকে তেল চিনির ডিও ব্যবসা করে যাচ্ছেন নির্বিঘেœ। কামিয়ে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। থাকেন প্রশাসনের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার পেছনে এসকল ডিও ব্যবসায়ীরও রয়েছে বিরাট কারসাজি। তারা খাতাপত্রে ডিও কেনাবেচা করেন, কিন্ত মিল থেকে মাল আমদানি করেন না। বাজারের ক্রাইসিস মুহূর্তে দাম বৃদ্ধি পেলে সুযোগ বুঝে মাল আমদানিপূর্বক তা বিক্রি করে হাতিয়ে নেন বাড়তি মুনাফা।
গতকাল পাইকারী বাজারে খেসারি ডাল ৬৩ টাকা, মসুরি মোটা ৯১ টাকা, দেশী মসুরি ১১৫ থেকে ১২০ টাকা, মুগ ডাল ৮০ থেকে ১০৮ টাকা, অ্যাংকর ডাল ৪৮ থেকে ৪৯ টাকা, ছোলা ডাল ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা, সাদা গম ৩৩ থেকে ৩৪ টাকা, সরিষার তেল ২১০ টাকা, সয়াবিন ১৬৮ টাকা, পাম তেল ১৫৪ টাকা, আটা ১ কেজির প্যাকেট ৪০ টাকা, তীর ময়দা ১ কেজির প্যাকেট ৫০ টাকা আর লুজ ৩৫ টাকা, চিনি ৭৪/৭৫ টাকা, বোতলজাত সয়াবিন দুই লিটার ৩৩০ টাকা, ৫ লিটার ৭৯০ টাকা, ভালোমানের চিনিগুড়া চাল ৯০ টাকা, ভালো মানের কাটারি ভোগ চাল ৫৮ টাকা, আলু ১২ টাকা, পেঁয়াজ ৩৫ টাকা থেকে কোয়ালিটি অনুযায়ী ৪০ টাকা, রসুন ৪৫/৫০ টাকা, আদা ৫০/৬০ টাকা দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে। তবে তেল, চিনি, চালের দাম বাড়লে যেভাবে ভোক্তা সাধারণের মাঝে প্রভাব বিস্তার করে সেভাবে প্রচার পায় না অন্যান্য সামগ্রীর মূল্য বৃদ্ধিতে। দেখা যায়, তেল চিনির মত সকল পণ্যেরই দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে এক এক করে। ১০০ গ্রাম ওজনের যে সাবান বিক্রি হয়েছে ৩৫ টাকায় তা এখন বিক্রি হচ্ছে ৪০ টাকায়। ৩০০ টাকার জিরা বিক্রি হচ্ছে পাইকারি বাজারে ৩৮০ টাকা। এমনিভাবে সকল পণ্যই বিক্রি হচ্ছে আগের চেয়ে বেশি দামে। গত ৪/৫ দিনে চিকন চালের দাম বেড়েছে কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা আর মোটা চালের ক্ষেত্রে কেজিতে বেড়েছে ১ টাকা। তবে শুল্ক প্রত্যাহারের সংবাদে পুরাণবাজারের পাইকারি বাজারে কেনা-বেচা হয়েছে কিছুটা কম-এমনটাই জানিয়েছেন কয়েকজন মহাজন। তারা অভিমত প্রকাশ করে বলেন, বাজার কমে যাওয়ার ভয়ে পাইকারি বিক্রিতে কিছুটা ভাটা পড়েছে।