খোদ চাঁদপুর শহরে ভুয়া ডাক্তার দিয়ে চলছে চিকিৎসা কার্যক্রম
দি ইউনাইটেড হাসপাতাল বন্ধ করে দেয়ার সুপারিশ তিন মাসেও বাস্তবায়ন হয়নি
নেই কোনো মেডিকেল অফিসার, নেই ডিপ্লোমা নার্স, নেই ডিপ্লোমা টেকনিশিয়ান। সেবারও কোনো মান নেই। এতো না থাকার মাঝেও একটি হাসপাতাল চলছে। তাও খোদ চাঁদপুর শহরে। তদন্তে ব্যাপক অনিয়ম পেয়ে সিভিল সার্জন অফিস থেকে জেলা প্রশাসনের কাছে হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার সুপারিশ করা হলেও তিন মাসেও তা কার্যকর হয়নি। অনিয়মে ভরপুর এ হাসপাতালটি হচ্ছে চাঁদপুর শহরের তালতলা এলাকায় অবস্থিত দি ইউনাইটেড হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার। চারতলা ভবনে হাসপাতালটির কার্যক্রম চলছে দীর্ঘদিন যাবত। অথচ নিয়ম নীতির কোনো বালাই নেই। কাগজে কলমে ডাঃ ইফতেখার উল আলম নামে একজন মেডিকেল অফিসার থাকলেও মিন্টু কুমার দাস নামে এক ভুয়া ডাক্তারই হচ্ছেন হাসপাতালটির একমাত্র চিকিৎসক। ইনিই এ হাসপাতালে রোগীদের ভরসা ! ডাঃ ইফতেখার উল আলম আবার এই হাসপাতালের মালিকানার অংশীদার হিসেবে পরিচালকও বটে। এদিকে নিজেকে এমবিবিএস পাস করা ডাক্তার পরিচয় দেয়া মিন্টু কুমার দাস প্রথমে নিজেকে মেডিকেল অফিসার হিসেবে পরিচয় দিলেও পরবর্তীতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থেকেই জানা গেলো তিনি মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট। পরে জনতার রোষানলে পড়ার ভয়ে চোখের পলকে ওই ভুয়া ডাক্তার পালিয়ে যায়। পরে রোগীর লোক এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থেকে বহুবার ফোন করার পরও মিন্টু ফোন রিসিভ করেন নি এবং দুপুর ২টা পর্যন্ত হাসপাতালেও আসেন নি।গতকাল মঙ্গলবার সকালে এক রোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে হাসপাতালটিতে গিয়ে ওই ভয়াবহ চিত্র দেখা গেলো।
গত সোমবার সকাল ১০ টার দিকে ইব্রাহিমপুর ইউনিয়নের চরফতেজংপুর গ্রাম থেকে মাওঃ আহমদ উল্লাহ নামে এক বৃদ্ধ লোক প্রচ- পেট ব্যথা ও পাতলা পায়খানা অসুস্থতা নিয়ে চাঁদপুর শহরে এসে দি ইউনাইটেড হাসপাতাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ভর্তি হন। রোগীর স্বজনরা সে রাত প্রায় দশটার দিকে এই প্রতিবেদককে ফোন করে হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা এবং কোনো ডাক্তার এই সময় পর্যন্ত দেখেনি বলে জানান এবং রোগীর কোনো উন্নতি হয়নি বলেও জানান। পরদিন সকাল সাড়ে দশটার দিকে এই প্রতিবেদক হাসপাতালে গিয়ে ডিউটি ডাক্তারের সাথে কথা বলতে চাইলে হাসপাতালের এক স্টাফ ২০/২২ বছরের এক যুবককে দেখিয়ে দেয় ডিউটি ডাক্তার হিসেবে। তখন এই প্রতিবেদক তার কাছে গিয়ে পরিচয় জানতে চাইলে তিনি এখানকার মেডিকেল অফিসার বলে পরিচয় দেন। তার নাম বলেন মিন্টু কুমার দাস। তিনি আরো জানান, ২০১৭ সালে তিনি ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেছেন। বিষয়টি এই প্রতিবেদকের সন্দেহ হলে তিনি সত্যতা যাচাই করতে চাঁদপুর বিএমএ'র সাধারণ সম্পাদক ডাঃ মাহমুদুন্নবী মাসুমকে ফোন দেন। ডাঃ মাসুম তখন জানান, মিন্টু কুমার দাস নামে চাঁদপুরে কোনো ডাক্তার নেই। এরই মধ্যে বেশ কিছু সাংবাদিক হাসপাতালে চলে আসলে এবং কিছু লোকজন জড়ো হলে ওই মিন্টু কুমার দাস সটকে পড়ে। পরবর্তীতে তাকে বহু ফোন করেও পাওয়া যায়নি। অর্থাৎ সে পালিয়ে যায়। এরই মধ্যে নাহিদ সুলতানা সেতু নামে একজন মহিলা হাসপাতালে আসেন এবং নিজেকে এই হাসপাতালের পরিচালক বলে পরিচয় দেন। তখন তার কাছে হাসপাতালে কোনো ডাক্তার আছে কি না জানতে চাওয়া হয়। তখন তিনি ডাঃ ইফতেখার উল আলম নামে একজন ডাক্তার আছেন বলে জানান। অথচ তিনি তখন হাসপাতালে নেই। এরই মধ্যে সিভিল সার্জন কার্যালয়ে যোগাযোগ করে জানা গেছে আরো প্রায় তিন মাস আগে এই হাসপাতালের বিরুদ্ধে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ থাকায় হাসপাতালের কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার জন্যে জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি দেন সিভিল সার্জন। সেই চিঠির অনুলিপি চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরেও পাঠানো হয়।
সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ সাখাওয়াত উল্লাহ জানান, এই হাসপাতালের বিরুদ্ধে অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি গিয়ে ব্যাপক অনিয়ম পায়। যেমন মেডিকেল অফিসার তিনজন থাকার কথা থাকলেও একজনের কাগজপত্র পাওয়া গেছে। যার নাম ডাঃ ইফতেখার উল আলম। এছাড়া ৬জন ডিপ্লোমা নার্স থাকার কথা থাকলেও একজনও পাওয়া যায় নি। কোনো ডিপ্লোমা টেকনিশিয়ানও নেই। এতো অনিয়মের মাঝেও হাসপাতালটি চলছে। অপরদিকে এর লাইসেন্সের মেয়াদও ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে শেষ হয়ে গেছে। নবায়নও করা হয় নি। এমতাবস্থায় সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে জেলা প্রশাসককে চিঠি দেয়া হয় হাসপাতালটির কার্যক্রম বন্ধ করে দেয়ার জন্যে। এই চিঠি দেয়া হয়েছে আরো প্রায় তিন মাস আগে অর্থাৎ কোভিড-১৯ শুরু হওয়ারও আগে। অথচ জেলার স্বাস্থ্য বিভাগের সেই চিঠির কোনো কার্যকারিতা এখনো পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয় নি।
এদিকে গতকাল পরিস্থিতির আলোকে জেলা প্রশাসক মোঃ মাজেদুর রহমান খানের সাথে এ বিষয়ে কথা হলে তিনি জানান, করোনাকালে কোনো হাসপাতাল বন্ধ করা যাবে না। এ বিষয়টি পরে দেখা হবে বলে তিনি জানান।
এদিকে হাসপাতালে ২৪ ঘণ্টায় কোনো ডাক্তারের দেখা না মিললেও রোগী ছিলো আট জনের মতো ভর্তি। ডাক্তার নাই, অথচ এদের চিকিৎসা কীভাবে চলে জিজ্ঞেস করলে পরিচালক নাহিদ সুলতানা সেতু জানান, ডাঃ ইফতেখার উল আলম সাহেব আসেন আর জরুরি বিষয় হলে তিনি ফোনে চিকিৎসা দিয়ে থাকেন। অথচ ২৪ ঘণ্টাই একজন হলেও মেডিকেল অফিসার থাকতে হবে হাসপাতালে। যেটি এখানে একেবারেই শূন্য।
এদিকে দুপুর ১২ টার পর ডাঃ ইফতেখার উল আলম হাসপাতালে আসেন। তখন তিনি তাকে হাসপাতালের পরিচালক আবার মেডিকেল অফিসার বলেও দাবি করেন। মেডিকেল অফিসার হলে তাকে সার্বক্ষণিক হাসপাতালেই থাকার কথা। কিন্তু তাকে সোমবার সকাল থেকে মঙ্গলবার দুপুর ১২ টার পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
এদিকে সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ সাখাওয়াত উল্লাহ ভুক্তভোগীদের মৌলিক অভিযোগের ভিত্তিতে বিকেলে একটি তদন্ত টিম হাসপাতালে পাঠান। যার প্রধান ছিলেন চাঁদপুর সদর ইউএইচএফপিও ডাঃ সাজেদা বেগম পলিন। এই টিমের অন্য সদস্যরা হলেন আড়াই শ শয্যা বিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের এনেস্থলিওজিস্ট ডাঃ আবু সাদাত মোঃ সায়েম ও সদর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সহকারী সার্জন (বাগাদী) ডাঃ বেনজির আহমেদ।
সন্ধ্যায় এই তদন্ত টিমের প্রধান ডাঃ সাজেদা বেগম পলিনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, তারাও অনেক অনিয়ম পেয়েছেন। তিনজন মেডিকেল অফিসার থাকার কথা থাকলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একজনের (ডাঃ ইফতেখার উল আলম) কাগজ দেখাতে পেরেছেন। আর যে ছয়জন ডিপ্লোমা নার্স থাকার কথা তার একজনের কাগজপত্র দেখাতে পারে নি। এছাড়া লাইসেন্সের মেয়াদ ২০১৯ সাল পর্যন্ত দেখালেও মেয়াদ বৃদ্ধির কোনো কাগজ কর্তৃপক্ষ দেখাতে পারে নি। তবে লাইসেন্স নবায়নের আবেদন তারা অনলাইনে করেছেন বলে জানা গেছে। এদিকে সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, শর্ত পূর্ণ না করায় তাদের আবেদন খারিজ করা হয়েছে।
খোদ চাঁদপুর শহরে প্রশাসন এবং স্বাস্থ্য বিভাগের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের বলতে গেলে সার্বক্ষণিক বিচরণের জায়গায় ভুয়া ডাক্তার দিয়ে মানুষ জীবন নিয়ে এমন ছিনিমিনি খেলছে দেখে শহরবাসী হতবাক। সচেতন জনগণ চাচ্ছে স্বাস্থ্য বিধি এবং নিয়ম রক্ষা করে হাসপাতাল চালানো হোক।