করোনাভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে কোন ব্যাংক কত টাকা চলতি মূলধন ঋণ দিতে পারবে, তার সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সবচেয়ে বেশি ঋণ দেওয়ার অনুমতি পেয়েছে ইসলামী, সোনালী ও ন্যাশনাল ব্যাংক।
করেনাভাইরাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সেবা খাতকে সহায়তা দিতে ৩০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে সরকার। এরই অংশ হিসেবে সব ব্যাংক মিলে ঋণ দিতে পারবে ২৮ হাজার ৮৬৫ কোটি টাকা ও ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দিতে পারবে ১ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। ব্যাংকগুলোর চলতি মূলধন ঋণের ওপর ভিত্তি করে সীমা ঠিক করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে প্রয়োজনে এই সীমা হ্রাস বা বৃদ্ধি হতে পারে বলে জানা গেছে।
নীতিমালায় যা আছে
বাংলাদেশ ব্যাংক এ নিয়ে নীতিমালা প্রকাশ করে জানায়, যেসব প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে ব্যাংক থেকে চলতি মূলধন সুবিধা নিয়েছে, তারা সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ এই তহবিল থেকে চলতি মূলধন নিতে পারবে। শুধু ক্ষতিগ্রস্তরাই এ ঋণ পাবে। এ ঋণ আদায়ের সব দায়দায়িত্বও ব্যাংকের। যদি টাকা আদায় করতে না পারে, তা যথাযথ মানে শ্রেণীকরণ করে প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি সংরক্ষণ করতে হবে।
আর বাংলাদেশ ব্যাংকের তহবিল থেকে নেওয়া টাকা যথাসময়ে ফেরত না দিলে তা ওই ব্যাংকের হিসাব থেকে কেটে রাখবে বাংলাদেশ ব্যাংক। ফলে সরকার সুদ ভর্তুকি দিলেও ব্যাংকগুলোকে যথাযথ ঝুঁকি বিবেচনায় ঋণ দিতে হবে। যদিও প্রতিটি ঋণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে পৃথক অনুমোদন লাগবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতিমালা অনুযায়ী, ঋণখেলাপিরা এই তহবিল থেকে ঋণ নিতে পারবে না। শুধু ঋণখেলাপি নয়, তিনবারের বেশি ঋণ পুনঃ তফসিল করেছেন, এমন ব্যবসায়ীরাও এ তহবিল থেকে ঋণ পাবেন না। এ ঋণের মেয়াদ তিন বছর।
কার কত সীমা
ব্যাংকগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত কোন ব্যাংক কত টাকা চলতি মূলধন ঋণ দিয়েছে, তা জানতে চায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ভিত্তিতেই ঋণ প্রদানের সীমা নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
আবার অনেক ব্যাংকের বিতরণ করা ঋণ বেশি হলেও চলতি মূলধন দেওয়ার ক্ষেত্রে পিছিয়ে। ফলে প্যাকেজে ওই ব্যাংকগুলো বেশি ঋণ দিতে পারবে না। যেমন রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর মধ্যে জনতা ব্যাংক মাত্র ৪৩১ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে।
ব্যাংকগুলোর চলতি মূলধন ঋণের ওপর ভিত্তি করে সীমা ঠিক করে দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক
ব্যাংকগুলো সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে ব্যাংক খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঋণ বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংকের। ব্যাংকটি প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করেছে। এ জন্য অর্থনৈতিক ক্ষত মোকাবিলায় সবচেয়ে বেশি চলতি মূলধন ঋণ দিতে পারবে ইসলামী ব্যাংক, যার পরিমাণ ২ হাজার ৯৮২ কোটি টাকা। ব্যাংকটি থেকে যাঁরা ঋণ নিয়ে ব্যবসা করেন, তাঁরা ইতিমধ্যে যোগাযোগ শুরু করেছেন। অনেকে আবেদনও জমা দিয়েছেন।
ইসলামী ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু রেজা মো. ইয়াহিয়া বলেন, অনেক গ্রাহক আবেদন করেছে। পরিচালনা পর্ষদে অনুমোদন হলে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো হবে। অনুমোদন পেলেই গ্রাহক কম সুদের এই ঋণ পাবেন।
আমানতে ব্যাংক খাতের শীর্ষে অবস্থান করলেও সোনালী ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। এ জন্য ব্যাংকটি ১ হাজার ৬২২ কোটি টাকা চলতি মূলধন দেওয়ার সীমা পেয়েছে। যদিও এর মধ্যে বিমান বাংলাদেশকে ১ হাজার কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন করেছে ব্যাংকটি।
সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আতাউর রহমান বলেন, অনেকে ব্যবসায়ীই যোগাযোগ করছেন, যাচাই–বাছাই শেষে অনুমোদন হলে তা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো হবে।
অন্যান্য ব্যাংকের মধ্যে বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংকের ১ হাজার ৬১৩ কোটি টাকা, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের ১ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা ও ডাচ্–বাংলা ব্যাংকের ১ হাজার ৬৮ কোটি টাকা চলতি মূলধন ঋণ দেওয়ার সীমা নির্ধারণ হয়েছে।
ডাচ্–বাংলা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবুল কাশেম মো. শিরিন বলেন, গ্রাহকেরা যোগাযোগ শুরু করছেন। বিচার–বিশ্লেষণ করে প্রস্তাব কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠানো হবে।
এদিকে দি সিটি ব্যাংকের ১ হাজার ২৩ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার সীমা ঠিক হয়েছে। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের প্রায় সব গ্রাহকই যোগাযোগ করেছে। অনেকেই আবেদন করেছে। কিছু অনুমোদনও হয়েছে। এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষা।’
জানা গেছে, এক্সিম ব্যাংক ৯৯৪ কোটি টাকা, ইস্টার্ণ ব্যাংক ৯৮৫ কোটি, অগ্রণী ব্যাংক ৯১৪ কোটি, প্রাইম ৯১২ কোটি, ব্যাংক এশিয়া ৮১৯ কোটি, রূপালী ৭৮৭ কোটি, মার্কেন্টাইল ৭৭৪ কোটি, সাউথইস্ট ৭৬৬ কোটি ও ঢাকা ব্যাংককে ৭৫৮ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার সীমা দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
বিদেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যে স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক ৭২৪ কোটি টাকা ও কমার্শিয়াল ব্যাংক অব সিলনকে ৩৩৪ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার সীমা দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
আর নতুন ব্যাংকগুলোর মধ্যে মিডল্যান্ড ব্যাংক ২২৮ কোটি টাকা, মধুমতি ১৯০ কোটি টাকা, এনআরবি কমার্শিয়াল ১৭৫ কোটি টাকা, মেঘনা ১৪২ কোটি টাকা, সাউথ বাংলা এগ্রিকালচার অ্যান্ড কমার্স ব্যাংক ১৩০ কোটা, এনআরবি ১১১ কোটি, পদ্মা (সাবেক ফারমার্স) ১০৪ কোটি, এনআরবি গ্লোবালকে ৭৭ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার সীমা বেঁধে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুল ইসলাম বলেন, যেই ব্যাংক যত চলতি মূলধন দিয়েছে, তার ভিত্তিতেই এ সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ফলে কোনো ব্যাংকের ওপর অতিরিক্ত চাপ হবে না।