• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

করোনা : এক মহা মানবিক বিপর্যয়

প্রকাশ:  ১১ মে ২০২০, ১৪:২০
এএইচএম আহসান উল্লাহ
প্রিন্ট

আদম সন্তান পৃথিবীতে আসার একটা দিন ক্ষণ থাকে, কিন্তু চলে যাওয়ার কোনো দিন ক্ষণ থাকে না। কে কখন কোন্ অবস্থায় এই পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমাবে তা আগাম কেউ বলতে পারেন না। সবই অদৃষ্টের লিখন। তবে মানুষ মারা যাবার পর প্রতিবেশী এবং আত্মীয়-স্বজনদের উপর দায়িত্ব পড়ে যায় মৃত ব্যক্তিকে যথাযথ সম্মানের সাথে ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সমাহিত করা। মরদেহের উপর কোনো রকম অসম্মান বা অশ্রদ্ধা করা কোনোভাবেই মানবিক কাজ হতে পারে না। স্রষ্টা যার ভাগ্যে যেভাবে মৃত্যু লিখেছেন, তার মৃত্যু সেভাবেই হবে। কেউ কলেরায় মারা যাবে, কেউ মহামারীতে মারা যাবে, কেউ আত্মহত্যা করবে, কেউবা হত্যার শিকার হবে। কিন্তু মৃত্যুর পর সেই মানুষটির সাথে কোনোরূপ শত্রুতা পোষণ, তাকে নিয়ে ভয় পাওয়া বা ঘৃণা প্রদর্শন করা খুবই গর্হিত কাজ। এ রূপ কাজ যারা করছে তারা কখনো মানুষের সংজ্ঞায় পড়তে পারে না। অথচ বর্তমান করোনাভাইরাসের মহামারীকালে কী এক মহা মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে, যা শুনলে গা শিউরে ওঠার মতো। 'করোনায়' মারা গেছে বা 'করোনার উপসর্গ' নিয়ে মারা গেছে এমন ধুয়া তুলে লাশের কাছেও যাচ্ছে না কেউ। কী আত্মীয়-স্বজন, কী প্রতিবেশী। সবাই যেনো একাট্টা হয়েছে, কেনো সে এই করোনার মহা দুর্যোগকালে মারা গেলো, এটা তার অপরাধ। তাই তার লাশের কাছেও কেউ যাবে না। কী নির্দয় ! কী নিষ্ঠুরতা ! কী অমানবিকতা ! এমনই কিছু নিষ্ঠুরতম ঘটনা সারাদেশে কিছু কিছু ঘটলেও চাঁদপুরেও এসব ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে।


গত বৃহস্পতিবার হাজীগঞ্জে এমন একটি অমানবিক ঘটনা ঘটেছে। এর আগেও একই ধরনের অমানবিক ঘটনা ঘটেছিল এই হাজীগঞ্জ উপজেলাতেই। পরে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হাজীগঞ্জ সার্কেল) মোঃ আফজাল হোসেনের হস্তক্ষেপে ফজরের আজানের সময় ওই নারীর দাফন কাজ সম্পন্ন হয়। গত বৃহস্পতিবার হাজীগঞ্জে যে ঘটনাটি ঘটেছে তা সত্যিই হৃদয়বিদারক। পৌরসভার ৮নং ওয়ার্ডস্থ টোরাগড় গ্রামের দক্ষিণ পাড়া ফকির বাড়ির মৃত জয়নাল আবেদিনের ছেলে সিরাজুল ইসলাম। বয়স হবে ষাটোর্ধ্ব। সিরাজুল ইসলাম মারা যান বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা আনুমানিক ৭টার দিকে নিজ বাড়ির বসতঘরে।

মরহুমের ভাই জানান, তার ভাই ডায়াবেটিসসহ নানা রোগে অনেকদিন যাবৎ আক্রান্ত ছিলেন। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় আগের অসুস্থতায় তিনি মারা যান। এদিকে ভাই মারা যাওয়ার পর এলাকার কে বা কারা গুজব উঠিয়ে দেয় তিনি করোনাভাইরাসে মারা গেছেন। এরপর আর কেউ লাশের ধারেকাছেও কেউ আসে না। সন্ধ্যা ৭টা থেকে প্রায় ৬/৭ ঘণ্টা লাশ পড়ে রয়েছে। লাশ গোসল দেয়ার মতো কোনো লোক খুঁজে পাওয়া যায় নি। অথচ আমার ভাই জীবদ্দশায় বহু মৃত মানুষকে গোসল দিয়েছেন এবং নিজ হাতে দাফন কাফনের ব্যবস্থা করেছেন। আজ আমার ভাইয়ের লাশ পড়ে আছে। কেউ কাছেও আসে না।


প্রায় একই রকম ঘটনা ঘটে আরো কয়েকদিন আগে হাজীগঞ্জের পূর্ব রাজারগাঁও গ্রামে ফাতেমা বেগম নামে দুই সন্তানের জননীকে কবর দেয়া নিয়ে। এই নারী চাঁদপুর শহরের বিষ্ণুদী মাদ্রাসা রোডস্থ মুন্সী বাড়িতে ভাড়া বাসায় থাকতেন। শুক্রবার রাত ৮টায় তিনি চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে করোনার উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হন, দেড় ঘণ্টার মাথায় রাত সাড়ে নয়টা তিনি মারা যান। এই নারীর স্বামী মারা গেছে অনেক আগে। মৃতের ভাই-বোনরা খবর পেয়ে আসেন। ফাতেমার লাশ গ্রামের বাড়িতে নিতে জটিলতা দেখা দেয়। রাজারগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান এবং ফাতেমার বাবার বাড়ির লোকজন তার লাশ বাড়িতে নিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তার কারণ হচ্ছে ফাতেমা করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছে। কয়েকদিন পরে অবশ্য ফাতেমার রিপোর্ট পজিটিভ আসে। পরে হাজীগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের হস্তক্ষেপে ফাতেমার লাশ তার বাবার বাড়িতে নিয়ে দাফন করা হয়। এমনিভাবে আরো কিছু ঘটনা গ্রামগঞ্জে ঘটছে।

 


মৃত মানুষ নিয়ে স্বজন ও প্রতিবেশীদের এমন আচরণে হতবাক বিবেকবান মানুষ। এভাবে মৃত মানুষের সাথে নির্দয় আচরণকে মানবিক বিপর্যয় হিসেবেই দেখছে বিবেকবান মানুষেরা। তারা বলছেন, মানুষগুলোকে কোনো কঠোরতাতেই বাসা-বাড়িতে আটকে রাখা যাচ্ছে না, তারা রাস্তায় অযথা বের হচ্ছে, বাজারে আড্ডা দিচ্ছে, ঘোরাফেরা করছে। অথচ কেউ মারা গেলে তাকে করোনা আখ্যায়িত করে লাশের প্রতি নির্দয় আচরণ করছে। এ বিষয়ে এখনই পদক্ষেপ না নিলে এটি একটি মহা মানবিক বিপর্যয় হিসেবে দেখা দিবে।


এ বিষয়ে কথা হয় চাঁদপুরের সিভিল সার্জন ডাঃ মোঃ সাখাওয়াত উল্লাহর সাথে। তিনি একেবারে পরিষ্কারভাবে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতামত হচ্ছে, মৃত ব্যক্তি থেকে করোনা ছড়ায় না। তারপরও সাবধানতা অবলম্বন করে লাশ দাফন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু এখন যে সব ঘটনা ঘটছে, তা খুবই দুঃখজনক। সামনে করোনা পরিস্থিতি যদি আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করে, তখন তো লাশ নিয়ে আরো বেশি মানবিক বিপর্যয় দেখা দিবে।

সার্বিক বিষয় চিন্তা করে এখন থেকেই প্রশাসন, স্বাস্থ্য বিভাগ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে এ বিষয়ে জনগণকে বুঝানো এবং বিভ্রান্ত দূর করতে পদক্ষেপ নেয়া জরুরি বলে মনে করেন সচেতন মহল।