আজ ভিন্ন আমেজের পহেলা বৈশাখ
বাজারে ধস বিপাকে ব্যবসায়ীরা
আজ থেকে বাংলা নতুন বছর শুরু। ১৪২৭ বঙ্গাব্দ আজ পহেলা বৈশাখ। বাঙালির প্রাণের উৎসব পহেলা বৈশাখ। নববর্ষের এ প্রথম দিনে বাংলার সবকিছু যেনো সাজে নতুন সাজে। গ্রামগঞ্জ আর শহরের ফুটপাত থেকে শুরু করে অলি-গলির দোকান ও বিপণীবিতানে থাকে কেনাকাটায় উপচেপড়া ভিড়। বাহারি রঙের বৈশাখী পোশাক দেদার বিক্রি হয়। অনলাইনেও জমে ওঠে বেচাবিক্রি। বৈশাখকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য বড় পরিসরে ছড়িয়ে থাকে দেশজুড়ে। এ সময়ে সারাদেশের ন্যায় চাঁদপুরেও পহেলা বৈশাখে শুভ হালখাতা খোলা হয়। কয়েক কোটি টাকার বিভিন্ন পণ্য বেচাকেনা হয়। কিন্তু এবার! এবার ভিন্ন রকমের পহেলা বৈশাখ! এক করোনা নামের মহামারী সব কেড়ে নিয়েছে। পহেলা বৈশাখকে ঘিরে প্রতি বছর যে রকম জমজমাট প্রস্তুতি থাকতো, এবারে সে চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন
চীনের উহান শহর থেকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস বাংলাদেশেও হানা দিয়েছে। এর বিস্তার রোধে সরকার পহেলা বৈশাখের সব ধরনের অনুষ্ঠান ও কার্যক্রম স্থগিত করেছে।
এ বছর দেশব্যাপী মহামারী করোনা ভাইরাসের প্রভাবে সবকিছু থমকে গেছে। চাঁদপুর জেলাজুড়ে চলছে লকডাউন। চাঁদপুর জেলায় এ পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত ৫ জন। করোনা ভাইরাস ঠেকাতে সরকারি নির্দেশে অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কারখানা, যানবাহন, জনসমাগম সব বন্ধ রয়েছে। বন্ধ করা হয়েছে পহেলা বৈশাখের সকল কার্যক্রম। ফলে এ পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে যারা তাদের স্বপ্ন বাঁধে, সেই সব উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের এবার মাথায় হাত।
বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি নির্দেশনায় বাংলা নববর্ষের সকল অনুষ্ঠানে জনসমাগম বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে। ঘরে বসে 'ডিজিটাল পদ্ধতিতে' পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের জন্যে বলা হয়েছে সরকারের তরফ থেকে। এবারের কার্যত লকডাউন পরিস্থিতিতে বর্ষবরণকে ঘিরে কোনো আয়োজনই থাকছে না। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা।
চাঁদপুরের মার্কেট ও বিপণীবিতানের দোকানীরাসহ সব ধরনের ব্যবসায়ী প্রতি বছর পহেলা বৈশাখের আগে মালিক-কর্মচারী, মিল-কারখানার শ্রমিক কিংবা ফ্যাশন হাউজের কারিগর কারোই দম ফেলার সময় হতো না। এবারো প্রাণে বাঁচার লড়াইয়ে সব কিছু থমকে গেছে। সব পেশার মানুষ বিপাকে পড়েছেন, আছেন বিপদে। তারা না পারছেন ঋণ পরিশোধ করতে, না পারছেন শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন মজুরি দিতে। মার্কেট, বিপণীবিতান, দোকানপাট দিনের পর দিন লকডাউনের মুখে বন্ধ থাকায় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছেন তারা।
সরজমিনে গতকাল সোমবার সকালে চাঁদপুর শহরের সার্বিক পরিস্থিতিতে দেখা যায়, জরুরি প্রয়োজনে অনেক মানুষ রাস্তায় নেমেছে। ঔষধের দোকান, মুদি দোকান আর ফুটপাতে কাঁচা পণ্য বিক্রির হকার ছাড়া শহরের প্রায় সব দোকানপাট, মার্কেট, শপিং মল বন্ধ। চৈত্রসংক্রান্তি বা পহেলা বৈশাকের কোনো কিছুই চোখে পড়েনি। মিষ্টির দোকানগুলোও বন্ধ রাখা হয়েছে।
চাঁদপুর কোর্টস্টেশনের মিষ্টিমেলা দোকানের পরিচালক জানান, এ সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে বহু মানুষ আসতো। লকডাউনের কারণে মানুষের যাতায়াত বন্ধ। মানুষ নাই, বেচা-কেনাও নাই।
শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সড়কের হাকিম প্লাজার কুয়াশা দোকানের মালিক জানান, পহেলা বৈশাখের দিনগুলো দ্বিতীয় ঈদের মতো বেচাকেনা হতো। নববর্ষ উপলক্ষে অনেক আয়োজন থাকতো। এবার পরিস্থিতি ভিন্ন।
গত ২৪ মার্চ থেকে করোনার কারণে মার্কেট প্রায় ২২ দিন বন্ধ। এ মার্কেটের ৮৬টি দোকানদার ব্যবসায় ক্ষতির সম্মুখীন।
মীর শপিং সেন্টারের মমতা ক্লথ স্টোরের মালিক মেরাজ চোকদার জানান, লকডাউনের কারণে মার্কেট, দোকান, বেচাকেনা সবই বন্ধ। দোকান ভাড়া, ৪/৫ কর্মচারীর বেতন কীভাবে পরিশোধ করবো চিন্তায় আছি।
পুরাণবাজারস্থ সুনন্দা কেবিনের পরিচালক দেব প্রসাদ ঘোষ জানান, আমরা মিষ্টি ব্যবসায়ীরা জিরো পয়েন্টে আছি। প্রচুর টাকা দেনা রয়েছি। চৈত্র মাসের পাওনা টাকাও পাইতেছি না। বৈশাখের মিষ্টি যাদের কাছে বিক্রি করতাম তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও বন্ধ। দোকানের অবস্থা একদম ফাঁকা।
তবে এ দুঃসময়ে নিত্যপণ্যের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের অবস্থা রমরমা। বেচাকেনা কয়েকগুণ বেড়ে যাওয়ায় চৈত্রের হিসাব চুকাতেও সময় পাচ্ছে না তারা। কেবল চিন্তিত বৈশাখের চাহিদা অনুযায়ী পণ্য আমদানি হবে কিনা তা নিয়ে।
চাঁদপুর চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সহ-সভাপতি তমাল কুমার ঘোষ জানান, এখন বেঁচে থাকা হলো বড় কথা। এবার হালখাতার আনুষ্ঠানিকতা নেই। ব্যবসায়ীরা দেনা-পাওনার সমন্বয় করতে পারেনি। মহামারীর মধ্যেও প্রশাসনের সহযোগিতায় পণ্যের আমদানি ও সরবরাহ ধরে রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। তবে লকডাউনে অন্য ব্যবসায়ীদের আর্থিক অবস্থা খারাপ যাচ্ছে।
পুরাণবাজার বেঙ্গল ট্রেডিংয়ের পরিচালক নেপাল সাহা বলেন, দেশের যে অবস্থা, মানুষের পহেলা বৈশাখ নেই। মানুষ সুস্থ থাকলে আগামী বছর পহেলা বৈশাখ হবে। মোকামে লেবার সঙ্কটের কারণে পণ্যের সরবরাহ কম।
বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মতে, বর্ষবরণকে ঘিরে চাঁদপুরের অর্থনীতিতে বড় অঙ্কের লেনদেন হয়। চারিদিকে কত আয়োজন। এবার সবকিছুই স্তব্ধ। প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বের হচ্ছে না মানুষ। নিম্ন ও মধ্যবিত্তদের খুবই দুরবস্থা। এ সংঙ্কট চলতে থাকলে এর ধকল আগামী ছয় মাস এক বছরেও সামাল দেয়া যাবে না। শহরের চেয়ে গ্রামের অবস্থা আরো খারাপ।
তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে এ অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধস নামতে যাচ্ছে বলে মত দিয়েছেন অর্থনীতিবিদ নাজনিন আহমেদ। 'এবারে পহেলা বৈশাখে যে ক্ষতিটা হচ্ছে সেটার প্রভাব কিন্তু গ্রামের ওই পুতুল বানানোর কারিগর থেকে শুরু করে শহরের বিলাসবহুল বিপণীবিতানের ওপরও পড়েছে। কারণ তাদের বিক্রির একটা বড় উৎস হচ্ছে এ পহেলা বৈশাখ।'
প্রতিবছরই দেশের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে পহেলা বৈশাখ এক ধরনের স্বপ্ন থাকে। যে এই দিনকে কেন্দ্র করে একটা ভালো বেচাকেনা হবে। আর এর জন্যে উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা প্রতি বছরই নানা ধরনের কর্মসূচি ও উদ্যোগ হাতে নেয়। এবার সেটাও গেলো। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে যারা পণ্য তৈরি করে রেখেছিলেন, তাদের এখন কী হবে! তাদের প্রায় সবাই এই উৎসবের বিক্রিবাট্টা থেকে ঋণের অংশ পরিশোধ করেন।
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা বলছেন, এ পরিস্থিতিতে তাদের ব্যবসায় টিকে থাকাই অসম্ভব হয়ে পড়বে। সরকারের কাছে সহায়তা চেয়েছেন তারা। সরকার যদি কোনো সহযোগিতা না করে তাহলে তাদেরকে বড় ধরনের বিপদের সম্মুখীন হতে হবে।