• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

ফরিদগঞ্জে এক বছরে অপমৃত্যুর ঘটনা ৪৩টি

প্রকাশ:  ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০, ১১:১৫
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

ফরিদগঞ্জ উপজেলায় আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে অস্বাভাবিক বা অপমৃত্যুর ঘটনা। প্রায় প্রতি মাসে কোথাও না কোথাও অপমৃত্যুর শিকার হচ্ছে নারী-শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ। সড়কেও ঝরছে মানুষের প্রাণ। পানিতে ডুবে মরার মিছিলও দীর্ঘ হচ্ছে, শ্বাসরোধ করে হত্যার মতো ঘটনাও ঘটছে। এ ছাড়াও বিষপান করে, ফাঁসিতে ঝুলে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়ায় ঠেকানো যাচ্ছে না অপমৃত্যুর মিছিল। পিটিয়ে এবং কুপিয়ে হত্যা করার মতো বর্বর ঘটনাও ঘটেছে ২০১৯ সালে। এছাড়াও ভ্রুণ হত্যাসহ চিকিৎসায় অবহেলায়ও একাধিক মৃত্যু হয়েছে। অপমৃত্যুর ঘটনা বেড়ে যাওয়ায় এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, সারাদেশে প্রতিদিন গড়ে ২৮ নারী-পুরুষ ও শিশু আত্মহত্যা করছে। বয়স্ক নারী-পুরুষের পাশাপাশি স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাও আত্মহত্যার দিকে ঝুঁকছে। তবে ফরিদগঞ্জে তরুণীদের আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি।

সূত্র অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থাৎ গত ১ বছরে ৪৩টি অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ফরিদগঞ্জ থানার তথ্য মতে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে ১২জন আর পত্রিকার সূত্রমতে ৬জন। ২ জন বিষপানে বেছে নেন আত্মহত্যার পথ। আত্মহত্যার যে ক'টি ঘটনা ঘটেছে তার অধিকাংশই তরুণী। পরীক্ষায় অকৃতকার্য, প্রেম, পরকীয়াসহ দাম্পত্য কলহের জের ধরে তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেন বলে জানিয়েছে পুলিশ। পুলিশের রেকর্ডের বাহিরেও একাধিক মৃত্যুর ঘটনা রয়েছে। এ ছাড়াও বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে ২জন, সড়ক দুর্ঘটনায় ১০জন, পানিতে ডুবে ৬ জন, শরীরে আগুন লাগিয়ে ১ জন, কোপে ও প্রহারে ৩জন, চিকিৎসা অবহেলায় ৩জন, ছাদ থেকে পড়ে ১ জন মৃত্যুবরণ করেছে। অন্যান্য অপমৃত্যু ৮। উপজেলার বাইরের অগ্নিকাণ্ডে মারা গেছে ২ জন। অনাগত শিশু হত্যা ১ জন। যদিও দৃষ্টির অন্তরালে প্রায় প্রতিদিনই ভ্রুণ হত্যা হচ্ছে। বিশেষ করে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের ফলে সৃষ্ট ভ্রুণ নষ্ট করা হচ্ছে অহরহ। আশার কথা হলো, গত বছর বজ্রপাতে, সাপের কামড়ে, ধর্ষণ পরবর্তী হত্যা এবং অগ্নিকাণ্ডে কেউ অপমৃত্যুর শিকার হয়নি। তবে ফরিদগঞ্জের বাইরে অগ্নিকাণ্ডে ২জন মারা যায়। এদিকে গত বছর ফরিদগঞ্জ থানা পুলিশ ১শ' ৭ জন নিখোঁজ ব্যক্তিকে উদ্ধার করে।

ফরিদগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ আবদুর রকিব বলেন, 'গ্রামের মেয়েরা অনেক সময় আবেগপ্রবণ হয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। নারীদেরকে অপমৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে হলে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। আমরা অপমৃত্যুর মামলাগুলো গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করি। এছাড়া অপমৃত্যু আগের তুলনায় কমে এসেছে। আমি বিভিন্ন স্কুল কলেজে এবং মাহফিলগুলোতে গিয়ে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলছি।'
পত্র-পত্রিকা খুললেই চোখে পড়ছে আত্মহত্যার খবর। প্রতিদিন সারাদেশে যে অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটছে তার একটি বড় অংশই আত্মহত্যাজনিত মৃত্যু। অপমৃত্যুর এই মিছিল যেন ক্রমেই বেড়ে চলছে। ফরিদগঞ্জে গত বছর অপমৃত্যুর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ঘটনা হলো : ৫ মার্চ উপজেলার গুপ্টি ইউনিয়নের মান্দারতলী গ্রামের নূরের রহমান বাবু (২২) সিলিং ফ্যানের সাথে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে। ১৯ মে ঘনিয়া থেকে সালমা বেগম (২৪) নামের এক গৃহবধূর হাতের রগ কাটা ও ঝুলন্ত অবস্থায় লাশ পুলিশ উদ্ধার করে। ২১ মে পাইকপাড়ায় বিয়ের ১ মাস পর স্বামীর সাথে ঝগড়া করে তাহমিনা আক্তার (২২) নামের এক নববধূ গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহনন করে। ৮ জুন উপজেলার বিষকাটালী এলাকা থেকে নিশি আক্তার (১৯) নামের অন্তঃসত্ত্বা গৃহবধূর লাশ উদ্ধার করা হয়। ৪ জুলাই বালিথুবায় পঞ্চায়েতকে কেন্দ্র করে মোঃ হানিফ তপাদার (৩৫) নামে একজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। চরমঘুয়ায় সাবেক প্রেমিকা জাহেদা আক্তার মিশু (২০) (অন্যের স্ত্রী) বিয়ে করতে রাজি না হওয়ায় তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ১১ সেপ্টেম্বর বাছপাড় গ্রামে একাদশ শ্রেণির ছাত্রী নাদিয়া আক্তার ফারহানকে প্রেমিকের সাথে বিয়ে না দিয়ে অন্যত্র বিয়ের আয়োজন করায় সে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করে। ৭ অক্টোবর উপজেলা সদরস্থ ৪ সন্তানের জননী ভাড়াটিয়া পারভীন (২৮) কে লাথি মেরে হত্যা করে বাড়িওয়ালার স্ত্রী খুকি বেগম। ১৪ অক্টোবর গুপ্টি থেকে আয়শা আক্তার মুক্তা (১৯) নামের ২ সন্তানের জননীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। ১৯ অক্টোবর সাহাপুর গ্রাম থেকে হাসমত উল্লাহ (২৩) নামের একজনের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়। ৩ নভেম্বর উপজেলার সেকদীতে ফাতেমা আক্তার সাথী (১৬) নামের এক কিশোরী গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে। জানা যায়, সে চান্দ্রা আবদুল হাকিম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০২০ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিলো। আর্থিক দুরবস্থার কারণে তার ফরম ফিলাপ করা সম্ভব হয়নি। তাই তার পরিবার তার বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৪ নভেম্বর উপজেলা সদরে মায়ের সাথে অভিমান করে তানিয়া আক্তার টুম্পা (১৪) নামের এক কিশোরী আত্মহত্যা করে। ১৮ নভেম্বর চরঃদুখিয়ায় তাসলিমা আক্তার নামের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করে। ২২ নভেম্বর হর্ণিদূর্গাপুরে শ্রাবণী আক্তার পেয়ারা (১৪) নামের জেএসসি পরীক্ষার্থী আত্মহত্যা করে।

সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, এসব আত্মহত্যার পেছনের কারণ হলো পারিবারিক কলহ, যৌতুক বা অন্য কারণে স্বামী বা স্বামীর পরিবারের নির্যাতন, পরকীয়া, কন্যাসন্তান জন্ম নেয়ায় স্ত্রীকে ভর্ৎসনা, ধর্ষণ, বখাটেদের অত্যাচার, আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব। যারা আত্মহত্যা করছে তাদের বেশির ভাগেরই বয়স ৩০ বছরের নিচে।

আত্মহত্যার যে সব কারণ সমাজবিজ্ঞানীরা নির্ধারণ করেছেন ফরিদগঞ্জ উপজেলা তা থেকে কিছুটা হলেও উন্নত করেছে। যেমন গত বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এখানে যৌতুক, কন্যাসন্তান জন্ম নেয়ায় স্ত্রীকে ভর্ৎসনার কারণে কোনো অপমৃত্যুর ঘটনা ঘটেনি।

সমাজের সাধারণ মানুষ ছাড়াও আত্মহত্যার প্রবণতায় উচ্চ ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে মাদক গ্রহণকারীরা। এর কারণ নিয়ন্ত্রণ বহির্ভূত মাদক গ্রহণে বিষণ্নতা, অতিমাত্রায় মাদক গ্রহণের কারণে সিদ্ধান্তহীনতা বা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে না পারা, চিকিৎসার পরও মাদকমুক্ত থাকতে ব্যর্থ হওয়া।

বুয়েটের অ্যাঙ্েিডন্ট রিসার্চ সেন্টারের (এআরসি) গবেষণায় জানা গেছে, অপমৃত্যু সংক্রান্ত অধিকাংশ মামলার তদন্তে পুলিশের দায়সারা ভাব লক্ষণীয়। মাঝেমধ্যে কিছু ঘটনার তদন্তে মৃত্যুর কারণ বেরিয়ে এলেও ধামাচাপা পড়ে যায় অনেক আত্মহত্যার রহস্য। প্ররোচনার অভিযোগে হাজতবাস করতে হয়েছে এমন নজির সংখ্যায় অতি নগণ্য। ফলে অনেক ক্ষেত্রে পার পেয়ে যাচ্ছে প্ররোচনাকারী অপরাধীরা। এদিকে কোনো কোনো ঘটনায় খুন করে আত্মহত্যা কিংবা দুর্ঘটনাজনিত কারণে মৃত্যু হয়েছে বলে ঘাতকচক্র চালিয়ে দিচ্ছে। এ ধরনের খুনের ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে রহস্য উদ্ঘাটন করা যাচ্ছে না। মাঝে মধ্যে কিছু ঘটনার তদন্তে মৃত্যুর কারণ বেরিয়ে এলেও ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে অনেক রহস্যজনক মৃত্যু। তাৎক্ষণিকভাবে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে নিশ্চিত না হলে অস্বাভাবিক মৃত্যু (ইউডি) মামলা নেয় পুলিশ। ফলে ঘটনার কিছুদিন পরই অধিকাংশ ঘটনারই রহস্য ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে।

সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক পরিবেশগত দুরবস্থা থেকেই মানুষ মানসিক অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়ে থাকে। আর দুরবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার পথ না পেলেই আত্মহননের পথ বেছে নেয়। যারা আত্মহত্যা করে বা আত্মহত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করেছে, তাদের বেশিরভাগই কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত। কাউন্সেলিং এবং যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে আত্মহত্যার পথ থেকে তাদের ফেরানো সম্ভব। তাই আত্মহত্যার প্রবণতারোধে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

আত্মহত্যার প্রবণতা উদ্বেগজনক হারে বেড়েই চলেছে। স্বামীর সাথে পারিবারিক কলহের জের ধরে অভিমানে অনেক নারী আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। তার মধ্যে বেঁচে থাকার কোনো ইচ্ছা থাকে না। সংসারে অভাব-অনটন, চাওয়া-পাওয়ার সংমিশ্রণ না ঘটলে আত্মহত্যা করে থাকেন। কাঙ্ক্ষিত কোন কিছু না পেলেই তাদের মধ্যে নিজেকে শেষ করে দেওয়ার ইচ্ছা হয় এবং সেই ইচ্ছা থেকেই তারা আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। আত্মহত্যার মতো ঘটনার জন্য শুধু যিনি আত্মহত্যা করেন তিনিই দায়ী নন, এর জন্য সংশ্লিষ্ট পরিবারগুলোও দায়ী বলে অভিমত দেন বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। আত্মহত্যার মত ঘটনাগুলোকে কমিয়ে আনতে হলে ব্যক্তির পাশাপাশি সমাজকেও অনেক ভূমিকা পালন করতে হবে।


থানা এবং পত্রিকার তথ্য ছাড়াও আরো অনেক নারী-পুরুষ আত্মহত্যা করে থাকে। যে ঘটনাগুলো পত্রিকার পাতায় আসে না। যা অজানাই রয়ে যায়। সকলের সমন্বিত প্রচেষ্ট ছাড়া এ থেকে উত্তরণ সম্ভব নয় বলেও সচেতন মহল মনে করেন।