‘আমার দেশে আমার কোনো দাম নেই’
গায়ে বাংলাদেশের জার্সি, গলায় ঝলমল করছে সোনার পদক। গর্বের সঙ্গে বাংলাদেশের পতাকার দিকে স্যালুট জানাচ্ছেন রোমান সানা। যেকোনো বাংলাদেশির জন্যই দৃশ্যটা গর্বের। কিন্তু তাঁকে কি যোগ্য সম্মান দিতে পারছে দেশ? অনন্য এক অর্জনের দুই দিন পার হয়ে গেলেও রোমান সানা অন্তত টের পাননি দেশবাসীর ভালোবাসা।
গত শুক্রবার ছিল আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে বাংলাদেশের এক গৌরবের দিন। ফিলিপাইনে অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপ র্যাঙ্কিং টুর্নামেন্টে ব্যক্তিগত রিকার্ভ ইভেন্ট থেকে বাংলাদেশকে সোনা এনে দিয়েছেন রোমান। এশিয়ান মঞ্চে বাংলাদেশের পতাকা সবার ওপরে তুলে ধরতে ২৪ বছরের এই তরুণকে হারাতে হয়েছে চীনের শি ঝেনকিকে। বিশ্ব আর্চারির ওয়েবসাইট যাকে বলছে ক্রীড়াক্ষেত্রে বাংলাদেশের সেরা আন্তর্জাতিক সাফল্য।
সোনা জয়ের পর একই দিনে টুর্নামেন্টের দলীয় ইভেন্টটি থেকে রোমানের নেতৃত্বে রুপা জয় করেছে বাংলাদেশ। মিশ্র দ্বৈতেও পেয়েছেন ব্রোঞ্জ। স্বাভাবিকভাবে এই আর্চার আশা করেছিলেন এমন অর্জনে দেশে আলোড়ন তুলবেন। টের পাবেন সবার ভালোবাসা। সেটা হয়নি বলে মন খারাপ ২০২০ টোকিও অলিম্পিকে সরাসরি জায়গা করে নেওয়া এই আর্চারের। ফিলিপাইনের ক্লার্ক সিটি থেকে প্রথম আলোর সঙ্গে কথোপকথনে হতাশা লুকাননি রোমান, ‘বড় পর্যায়ের কারও কাছ থেকে কোনো শুভেচ্ছা পাইনি। এটা নিয়ে কষ্ট হচ্ছে। অথচ ক্রিকেটে জিম্বাবুয়েকে হারানোর পর আফিফ হোসেনকে কত শুভেচ্ছাবার্তা। আমার তো সে রকম সৌভাগ্য হলো না।’
এশিয়ান পর্যায়ে সোনা জয় করা মানেই পেছনে ফেলতে হয় এগিয়ে থাকা সব প্রতিযোগীকে। এর পরেই না দেশের লাল-সবুজ পতাকা জড়িয়ে দাঁড়ানোর সুযোগ হয় ওই পোডিয়ামে। কিন্তু দেশের মানুষ ফুটবল-ক্রিকেট ছাড়া কোনো সাফল্যকে মূল্য দেয় না বলে রোমানের অভিযোগ। আর এই দুই খেলার ক্রীড়াবিদ না বলে তাঁদের যে কোনো কদর নেই সেটা মেনেও কণ্ঠের কষ্ট লুকাতে পারেননি রোমান, ‘আমার বাংলাদেশে আমার তো কোনো দামই নেই। কতগুলো দেশের কতজন খেলোয়াড়কে পেছনে ফেলে একটি পুরস্কার জিততে হয়, তা আমাদের দেশের মানুষ বোঝে না। তাঁরা শুধু বোঝে ক্রিকেট। ফুটবল নিয়েও অনেকের আগ্রহ আছে। কিন্তু আমাদের মতো ছোট খেলার খেলোয়াড়দের মূল্য কারও কাছে নেই।’
দেশের মানুষের ভালোবাসা না পেলেও ভিনদেশিদের কাছ থেকেই প্রাপ্য বুঝে নিচ্ছেন রোমান, ‘নিজের দেশে আমার কোনো দাম না থাকলেও জার্মানিতে গেলে অনেকে আমার অটোগ্রাফ নেয়। সুইজারল্যান্ডে গিয়েছিলাম অনুশীলনের জন্য। সেখানে যখন আমাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছে, অনেক বাচ্চা আমার অটোগ্রাফ নিতে এসেছে। বাইরের দেশের মানুষ বোঝে এশিয়ান পর্যায়ে বা বিশ্ব পর্যায়ে পদক জয়ের গুরুত্ব। আমরা এক ম্যাচ হারলেই বাদ। কিন্তু ক্রিকেট বা ফুটবলে হারলেও পরবর্তী রাউন্ডে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। আমি কাকে বোঝাব, আমাদের পদক জিততে কত কষ্ট করতে হয়।’
বিশ্ব আর্চারিতে রোমানের নাম এখন জ্বলজ্বল করছে। চলতি বছর জুনে নেদারল্যান্ডসে হুন্দাই বিশ্ব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে ছেলেদের ব্যক্তিগত রিকার্ভে ব্রোঞ্জ জয় করে হইচই ফেলে দিয়েছিলেন রোমান। কোনো খেলার বিশ্ব প্রতিযোগিতায় সেটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম কোনো পদক। সে সঙ্গে ২০২০ সালে অনুষ্ঠেয় টোকিও অলিম্পিকে সরাসরি খেলার যোগ্যতা অর্জন করেছেন এই আর্চার। কিন্তু এত সব অর্জনের মূল্য কে বোঝে!
আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে রোমানের যত একক সাফল্য
পদক |
টুর্নামেন্ট |
সাল |
সোনা |
এশিয়া কাপ বিশ্ব র্যাঙ্কিং টুর্নামেন্ট, ফিলিপাইন |
২০১৯ |
ব্রোঞ্জ |
বিশ্ব আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপ, নেদারল্যান্ডস |
২০১৯ |
রুপা |
আইএসএসএফ সলিডারিটি বিশ্ব র র্যাঙ্কিং আর্চারি |
২০১৯ |
সোনা |
বিশকেক আন্তর্জাতিক আর্চারি |
২০১৭ |
সোনা |
প্রথম এশিয়ান আর্চারি গ্রাঁ প্রি, থাইল্যান্ড |
২০১৪ |