গ্রামগুলোতেও সব নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে চাই: প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশে পরিকল্পিত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে মাস্টার প্ল্যান প্রস্তুতের প্রয়োজনীয়তার ওপর গুরুত্বারোপের পাশাপাশি জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে জলাধার, ফসলি জমি ও পরিবেশ রক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন।তিনি বলেন, একটি মাস্টার প্ল্যান প্রস্তুত করার পর আমাদের জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ে সুপরিকল্পিতভাবে উন্নতি ঘটাতে হবে। আমরা গ্রামগুলোতেও সব ধরনের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে চাই। প্রধানমন্ত্রী রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেন রোড এলাকায় সোমবার এমপি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক ভবনসহ ৭টি প্রকল্প উদ্বোধনকালে এসব কথা বলেন।
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে এ সাতটি প্রকল্পের মধ্যে গণপূর্ত বিভাগ চারটি ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষ ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) তিনটি প্রকল্প সম্পন্ন করে। শেখ হাসিনা বলেন, মানুষকে একটি মানসম্মত জীবনযাত্রা উপহার দেয়ার জন্য আমরা স্কুল, কলেজ, রাস্তাঘাট, আবাসন, কলকারখানা যা-ই নির্মাণ করি না কেন, তা সুপরিকল্পিত উপায়ে সম্পন্ন করতে চাই। আমরা এলোমেলোভাবে কোনো নির্মাণ কাজের অনুমতি দিতে চাই না।’দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ুর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করার জন্য স্থপতি ও পরিকল্পনাবিদদের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, যে কোনো পরিকল্পনা করার সময় আপনাদের জলাশয়গুলোর কথা মাথায় রাখতে হবে।
কারণ এগুলো পানির আধার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। বর্ষা মৌসুমে এগুলো পানি ধরে রাখে, যা জলাবদ্ধতা হ্রাসে সহায়তা করে। প্রয়োজনে সড়কগুলো যেন বাড়ানো যায় তা মাথায় রেখেই পরিকল্পনা করার জন্য শেখ হাসিনা স্থপতিদের প্রতি আহ্বান জানান।শেখ হাসিনা ভবন নির্মাণে পুকুর, খাল ও জলাশয়গুলো ভরাট করার মানসিকতা পরিবর্তনের জন্য সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানান। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, এ ধরনের মনমানসিকতার জন্যই এখন আর ঢাকা শহরের খাল ও পুকুর দেখা যায় না। আমরা ইতিমধ্যেই জলাশয়গুলো রক্ষায় পরিকল্পনা করার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছি।
বিগত ১০ বছরে সরকারের ব্যাপক উন্নয়নমূলক কাজের কথা তুলে ধরে তিনি বাংলাদেশকে ২০২১ সাল নাগাদ একটি উন্নয়নশীল ও ২০৪১ সাল নাগাদ একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করতে তার সরকারের দৃঢ় অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।এ ব্যাপারে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা এরই মধ্যে বাংলাদেশকে একটি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছি এবং এখন আমরা ২০২০ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের আগেই এ দেশকে একটি উন্নত ও সমৃদ্ধ দেশে পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, আমরা শুধু কেন্দ্রীয় নগরীগুলোকেই উন্নত করতে চাই না, বরং গ্রামগুলোতেও সব ধরনের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে চাই।পরে প্রধানমন্ত্রী রাজধানীর ইস্কাটন গার্ডেন রোডের গ্রেড-ওয়ান সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য নির্মিত তিনটি ভবনের মধ্যে আবাসন প্রকল্প ঘুরে দেখেন।গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম ও মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. শহীদ উল্লাহ খন্দকার অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে সাতটি প্রকল্পের একটি প্রামাণ্য ভিডিও চিত্রও প্রদর্শন করা হয়।
শেখ হাসিনা সাতটি প্রকল্প উদ্বোধন করে বলেন, আমরা মন্ত্রিসভার সদস্য, সচিব, অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সংবলিত ১৬৭১টি ফ্ল্যাটের উদ্বোধন করেছি। আমি মনে করি, সুন্দর পরিবেশে প্রকল্প এলাকায় আবাসিক সুবিধা পেয়ে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের দায়িত্ব পালনে আরও মনোযোগী হবেন।তিনি বলেন, ইতিমধ্যেই ঢাকায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসিক সুবিধা বাড়িয়ে ৪০ শতাংশ করার নির্দেশনা দিয়েছি। ২০১৪ সালে শুধু ৮ শতাংশ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর ঢাকায় আবাসন সুবিধা ছিল।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ১৬টি প্রকল্পের অধীন ৬৩৫০টি ফ্ল্যাট তৈরি করেছি এবং ১৩টি প্রকল্পের অধীন আরও ১৬৭৪টি ফ্ল্যাট তৈরির জন্য বরাদ্দ দিয়েছি। পাশাপাশি গুলশান, ধানমণ্ডি ও মোহাম্মদপুর এলাকায় ২০টি পরিত্যক্ত বাড়িতে ৩৯৮টি ফ্ল্যাট এবং চট্রগ্রামে পরিত্যক্ত বাড়িতে ১৮২৪টি ফ্ল্যাট ও ৬৪টি জেলায় ৬৪টি ডরমেটরি নির্মাণ করা হচ্ছে। আরও ১৫টি পরিত্যক্ত বাড়িতে ৩১৭টি ফ্ল্যাট নির্মাণের উদ্যোগ ইতিমধ্যেই নেয়া হয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি ও সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আমরা ইতিমধ্যেই ১৫১২টি ফ্ল্যাট নির্মাণ করেছি। তিনি বলেন, সরকার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আবাসিক সুবিধা বৃদ্ধি করতে ৬৪টি জেলায় ২৮১৬টি আবাসন ভবন নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী সবার জন্য আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে তার সরকারের কাজ করে যাওয়ার কথা উল্লেখ করে বলেন, আমরা স্বল্প ও মধ্য আয়ের লোকদের মাঝে বিক্রি করার জন্য ইতিমধ্যেই ৩৩৫২৬টি প্লট ও ৮৯২২টি ফ্ল্যাট তৈরি করেছি। এর মধ্যে উত্তরা অ্যাপার্টমেন্ট প্রকল্পের তৃতীয় ধাপের অধীন ৬৬৩৬টি ফ্ল্যাট বিতরণ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৮০৫টি ফ্ল্যাটের উন্নয়ন ও ৮০৩৯টি ফ্ল্যাটের নির্মাণ কাজ চলছে। তিনি আরও জানান, সারা দেশে আরও ১৮১৪৮ প্লট উন্নয়ন এবং ১ লাখ ৪১ হাজার ও ৬৮৭ ফ্ল্যাট নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছি। তিনি বলেন, ফ্ল্যাট নির্মাণকাজ শেষ হলে নগরবাসীর আবাসন সংকট অনেকটা কমে যাবে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা চাই না কোনো নাগরিক বস্তিতে বসবাস করুক। সুতরাং আমরা বস্তিবাসীদের জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ করছি। মিরপুরে ৫৩৩টি ফ্ল্যাটের নির্র্মাণ কাজ চলছে। তাদের জন্য ১৬ হাজারের বেশি ফ্ল্যাট নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা সুপরিকল্পিত নগরায়নের জন্য আইন করেছি এবং ‘হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইন্সটিটিউট’ অধ্যাদেশকে সময়োপযোগী করে আইন প্রণয়ন করেছি। অনুষ্ঠানে ৭টি প্রকল্পের প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন করা হয়।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতের হাইকমিশনারের সাক্ষাৎ : ভারতীয় হাইকমিশনার রীভা গাঙ্গুলী দাশ সোমবার সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার বাসভবন গণভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। বৈঠকের পরে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
প্রেস সচিব বলেন, বৈঠকে দু’দেশের অভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আলোচনা হয়। তিনি বলেন, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দু’দেশের মধ্যে নৌপথের কানেকটিভিটি বাড়িয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমান এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
মিয়ানমারকে অবশ্যই রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে দিতে হবে -প্রধানমন্ত্রী : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু করার জন্য মিয়ানমারের প্রতি তার আহ্বান পুনর্ব্যক্ত করে বলেছেন, মিয়ানমারকে অবশ্যই তাদের নাগরিকদের বাংলাদেশ থেকে ফেরত নিতে হবে।
তিনি বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া অবশ্যই শুরু করতে হবে। আমরা আর কতদিন এ বোঝা বহন করব? রোহিঙ্গাদের যত তাড়াতাড়ি প্রত্যাবাসন করা হবে, তা সবার জন্য হবে মঙ্গলজনক।’
বাংলাদেশে নিযুক্ত ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত মারি-এনিক বুর্দিন সোমবার বিকালে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এ কথা বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও জাতিসংঘ সংস্থাগুলোকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের পুনর্বাসনে তাদের জন্য ঘরবাড়ি নির্মাণসহ মিয়ানমারের ভেতরে কাজ করতে হবে। কক্সবাজারে ১১ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের সংখ্যা স্থানীয়দের সংখ্যা ছাড়িয়ে গেছে। এরই মধ্যে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোয় ৪০ হাজার রোহিঙ্গা শিশু জন্ম নিয়েছে।
জবাবে ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত তার দেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে সহায়তা অব্যাহত রাখবে উল্লেখ করে বলেন, ‘আমরা এই ইস্যুতে শুরু থেকেই বাংলাদেশকে সহায়তা করছি। এটি অব্যাহত থাকবে।’
তবে মারি-এনিক বুর্দিন বলেন, বর্তমানে মিয়ানমারের অবস্থা রোহিঙ্গাদের ফিরে যাওয়ার অনুকূল নয়। রাষ্ট্রদূত জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে ফ্রান্সের ভূমিকা অব্যাহত থাকবে বলেও উল্লেখ করেন। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়ন হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ কার্বন নিঃসরণে খুব দায়ী না হলেও দেশটি জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম। তিনি বলেন, ‘দেশের উপকূলীয় জেলাগুলো জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।’
শেখ হাসিনা বিদায়ী রাষ্ট্রদূতকে বাংলাদেশে সফলভাবে তার দায়িত্বের মেয়াদ সম্পন্ন করার জন্য অভিনন্দন জানান এবং দু’দেশের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার ও সম্প্রসারিত করার ক্ষেত্রে তার প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন।
রাষ্ট্রদূত উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের জনগণ ও কর্মকর্তারা খুবই আন্তরিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ। প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. নজিবুর রহমান এ সময় উপস্থিত ছিলেন।যুগান্তর