জেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে দুর্নীতি প্রতিরোধ বিষয়ক মতবিনিময় সভা
অন্যান্য জেলার চেয়ে চাঁদপুর জেলায় দুর্নীতির অভিযোগ তুলনামূলকভাবে কম : দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, শুধু মানুষকে গ্রেফতার করে জেলে ঢোকানো দুদকের কাজ নয়, বরং দুর্নীতি ঘটার আগেই সতর্ক করা দুদকের অন্যতম কাজ। আমার কর্মকালের প্রথম বছরেই দুর্নীতির মামলার অনেক আসামীকে গ্রেফতার করা হয়। আমরা একটা বার্তা দিতে চেয়েছিলাম যে, কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। সে বার্তা আমরা দিয়েছি এবং এটা প্রমাণ হয়েছে, আইনের ঊর্ধ্বে কেউ নয়। তিনি গতকাল ১৯ মে রোববার সকাল সাড়ে দশটায় চাঁদপুরের জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে জেলা পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে দুর্নীতি প্রতিরোধ বিষয়ক মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন।
সভায় আরো বক্তব্য রাখেন দুদকের মহাপরিচালক সারোয়ার মাহমুদ। জেলা প্রশাসক মোঃ মাজেদুর রহমান খানের সভাপ্রধানে বক্তব্য রাখেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান ও ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডাঃ একেএম মাহবুবুর রহমান। উন্মুক্ত আলোচনায় বক্তব্য রাখেন পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের উপ-পরিচালক ডাঃ মোঃ ইলিয়াছ, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার সাহাব উদ্দিন, সাংবাদিক গোলাম কিবরিয়া জীবন, ইকবাল হোসেন পাটওয়ারী, বিএম হান্নান, আলম পলাশ প্রমুখ।
নৌ-পুলিশের এসপি শমসের আলী, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা ও আইসিটি) মঈনুল হাসান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ মাহমুদ জামান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক রাজস্ব মোঃ জামাল হোসেন, চাঁদপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ ড. এএসএম দেলওয়ার হোসেন, চাঁদপুর প্রেসক্লাব সভাপতি শহীদ পাটওয়ারী, সাধারণ সম্পাদক লক্ষ্মণ চন্দ্র সূত্রধরসহ জেলার বিভিন্ন সরকারি অফিসের কর্মকর্তাবৃন্দ উক্ত সভায় উপস্থিত ছিলেন।
দুদক চেয়ারম্যান তাঁর বক্তব্যে আরো বলেন, উন্নয়ন এবং দুর্নীতি একে অপরের ভাই-বোন। শুধু উন্নয়ন করলে হবে না, টেকসই উন্নয়ন করতে হবে। শতভাগ শিশুকে প্রাথমিক শিক্ষায় এনরোলমেন্ট যেমন উন্নয়ন, তেমনি ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা শূন্যে নামিয়ে আনাও টেকসই উন্নয়ন।
চাঁদপুর জেলায় বিগত ২০১৭ ও ২০১৮ সালে প্রাপ্ত অভিযোগের পরিসংখ্যান তুলে ধরে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, অন্যান্য জেলার তুলনায় চাঁদপুর জেলায় দুর্নীতির অভিযোগ তুলনামূলকভাবে কম। ২০১৯-২০ সালে চাঁদপুরকে দুর্নীতিমুক্ত অথবা সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায় কি না এমন প্রশ্ন রেখে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, এজন্যে জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ‘দুর্নীতিমুক্ত জেলা বাস্তবায়ন কমিটি’ গঠন করা যেতে পারে। এছাড়া প্রতিটি সরকারি দপ্তরে ‘আমার অফিস দুর্নীতিমুক্ত’ এ জাতীয় বিলবোর্ড/সাইন বোর্ড স্থাপন করার আহ্বান জানান তিনি। এ প্রসঙ্গে তাৎক্ষণিকভাবে জেলা প্রশাসক মোঃ মাজেদুর রহমান খান জানান, শীঘ্রই সুনির্দিষ্ট কর্মপরিধি সংযোজন করে এই কমিটি গঠন করা হবে।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, বিভিন্ন জেলায় যেভাবে দুর্নীতি হয়, সে তুলনায় চাঁদপুর জেলায় দুর্নীতি কম। আমি যেহেতু এ জেলার সন্তান, এ মাটিতেই আমার জন্ম। আমার জেলা যদিও আপাতত দুর্নীতিমুক্ত জেলা না, তবে কম দুর্নীতিগ্রস্ত জেলা। আমার জেলায় দুর্নীতি কমেছে এটা যেন বলতে পারি সেই উদ্দেশ্যেই আমার এখানে আসা।
তিনি বলেন, দেশের দুর্নীতির চেয়েও শিক্ষা ব্যবস্থা বড় সমস্যা। অনেকে বলেন, ব্যাংকের টাকা নিয়ে গেলো আপনি কিছু বলেন না, শিক্ষা নিয়ে সব সময় ব্যস্ত থাকেন। এক্ষেত্রে আমার জবাব পরিষ্কার, ব্যাংকের টাকা যারা লোপাট করছেন তাদের যদি সঠিক শিক্ষা থাকতো তাহলে হয়তো টাকা লোপাট হতো না। তাই এই চুরি ঠেকাতে হলে নৈতিক শিক্ষায় সক্ষম মানব সম্পদ সৃষ্টি করতে হবে। এজন্যে প্রয়োজন মানসম্মত শিক্ষা।
তিনি জেলা পর্যায়ের কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, আপনারা নিজেরা দুর্নীতিমুক্ত থাকলে জেলা পর্যায়ে দুর্নীতি করা অত্যন্ত কঠিন। স্ব স্ব কর্মপ্রক্রিয়া সংস্কার করে সুনির্দিষ্ট টাইম লাইন স্থাপন করে সরকারি সেবা প্রদান করলে দুর্নীতি কমে আসবে এবং জনহয়রানি লাঘব পাবে বলে তিনি জেলা কর্মকর্তাদের কার্যপ্রক্রিয়া সংস্কারের আহ্বান জানান। সময়মতো সরকারি সেবা প্রদান করতে না পারলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বেতন থেকে জরিমানা আদায়ের ব্যবস্থা করা হলে প্রশাসন জনগণের কাছে যেতে বাধ্য হবে। এখন যেভাবে প্রশাসন চলছে এটাকে দোকান চালানোর মতো অবহিত করে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, প্রশাসনকেই জনগণের কাছে গিয়ে সেবা দিতে হবে। এটাই আধুনিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা।
সরকারি সেবা প্রদানের নামে মানুষের কাছ থেকে যারা অর্থ নিবেন তাদের প্রতি দুদকের নজর আছে জানিয়ে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে আইন প্রয়োগে দুদকের কোনো অনুমতির প্রয়োজন নেই। দুদক স্বাধীনভাবে এ দায়িত্ব পালন করছে। বিগত ৩ বছরে দুদককে কেউ চাপ দেয়ার সাহস পায়নি। যা করেছি আমরা নিজেরা চিন্তাভাবনা করে করেছি। ভুল করলে আমরা করেছি, ঠিক করলেও আমরা করেছি। এখানে কাউকে চাপ বা হস্তক্ষেপ প্রদানের সুযোগ দেয়া হয়নি।
পুলিশের বিদ্যমান সেবা প্রক্রিয়াকে জনবান্ধব করার লক্ষ্যে তিনি বলেন, পুলিশ শুধু আসামী গ্রেফতার করতে নাগরিকের বাড়িতে যাবে তা নয় বরং নাগরিকদের বাড়িতে যাবে তাদের কুশলাদি এবং সুবিধা-অসুবিধা জানার জন্যে। যদি কোনো অসুবিধা থাকে তাহলে এর সমাধান করবে। এমন পুলিশ হলে তাদের প্রতি মানুষের ভয় থাকবে না। পুলিশ হবে জনবান্ধব। মানুষ পুলিশকে তখন ভয় পাবে না।
উল্লেখ্য, দুর্নীতি দমন কমিশনে চাঁদপুর জেলায় ২০১৭ সালে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের ৫৪টি এবং ২০১৮ সালে ৫৯টি অভিযোগ ছিল। দেশের অন্যান্য জেলার তুলনায় দুর্নীতির এই অভিযোগ কম।
পরে দুদক চেয়ারম্যান দুপুরে জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলা পরিষদ অডিটরিয়ামে উপজেলার সকল মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসা এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকবৃন্দের সাথে দুর্নীতি প্রতিরোধ বিষয়ক সভায় যোগদান করেন এবং বক্তব্য রাখেন।