শ্রমবাজারের সন্ধানে টার্গেট ৭ দেশ
বিদেশে শ্রমবাজার সম্প্রসারণ করতে মধ্যপ্রাচ্যের বিকল্প খুঁজছে সরকার। বিশ্বে বাংলাদেশের শ্রমবাজার বাড়ানোর ব্যাপারে এবারের টার্গেটে আছে জাপানসহ ৭টি দেশ। জানা গেছে, এ ক্ষেত্রে ৭ ধরনের চ্যালেঞ্জ ও প্রতিবন্ধকতা রয়েছে।সরকারি সূত্র জানায়, এ প্রতিবন্ধকতাগুলো হচ্ছে বিদেশে গমনেচ্ছু কর্মীদের জন্য নির্ভুল ও শক্তিশালী ডেটাবেইস গড়ে তোলা, নারীকর্মীদের নিরাপদ অভিবাসন ও অভিবাসী কর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমবাজার সংকোচনের পরিপ্রেক্ষিতে নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান, বৈধপথে রেমিট্যান্স দেশে আসার উপায় নিশ্চিত করা, উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন ত্বরান্বিতকরণ এবং জনবল সংকট নিরসন করা।
এদিকে, গত বছরের হিসাবে বিদেশে কর্মী পাঠানোর হার কমেছে। তবে এ কারণে রেমিট্যান্সে কোনো প্রভাব পড়েনি; বরং বেড়েছে। এ বৃদ্ধির হার দুই লাখ মার্কিন ডলার। তবে, বিদেশে থাকা বাঙালিদের পাঠানো রেমিট্যান্সের প্রবাহ অব্যাহত রাখতে সরকার নতুন নতুন শ্রমবাজারের সন্ধানে নেমেছে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের সংকোচিত শ্রমবাজারের বিকল্প দেশ হিসেবে পোল্যান্ড ও আলজেরিয়ার মতো দেশ অগ্রাধিকার পাচ্ছে।এ ছাড়া দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বড় অবদান রাখছেন প্রবাসী বাঙালিরা। কিন্তু তাদের জন্য অভিবাসনব্যয় নির্বাহ করা কঠিন বাস্তবতা। অথচ রেসিট্যান্স পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখা হচ্ছে। অন্যান্য চ্যালেঞ্জের পাশাপাশি এ খাতে নিয়ন্ত্রিত অভিবাসন ব্যয়ই সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মন্ত্রণালয়ের এক নথি পর্যালোচনায় এ তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রাপ্ত তথ্য মতে, দেশ স্বাধীনের পরপরই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কূটনৈতিক তৎপরতায় মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলোর সঙ্গে সমঝোতা সৃষ্টি হয়। তারই আলোকে সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় বাংলাদেশি কর্মী পাঠানো শুরু হয়। আর ২০০১ সালের ২০ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুতনয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিদেশে কর্মী পাঠানোর বিশাল ক্ষেত্র তৈরি হয়। ধীরে ধীরে বিদেশে বাংলাদেশের কর্মীদের কর্মসংস্থান সুযোগ বাড়তে থাকে। এ মন্ত্রণালয়ের অধীন চলমান প্রকল্প রয়েছে আটটি, যার মধ্যে ছয়টি বিনিয়োগ প্রকল্প এবং দুটি কারিগরি প্রকল্প। এ ছাড়া শ্রম অভিবাসন বিষয় বর্তমানে ১৪টি দেশের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক ও চুক্তি হয়েছে।
শ্রম অভিবাসন-সংক্রান্ত এক তথ্য মতে, ১৯৭৬-২০১৮ পর্যন্ত মোট শ্রম অভিবাসনের সংখ্যা ১ কোটি ২২ লাখ এবং ওই সময় পর্যন্ত প্রাপ্ত রেসিট্যান্সের পরিমাণ ১৩ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা। আর অভিবাসনের জন্য গন্তব্য দেশ ১৭০টি। ২০১৮ সালে অভিবাসী কর্মীর সংখ্যা ছিল ৭ লাখ ৩৪ হাজার এবং নারী কর্মীর সংখ্যা ১ লাখ ১৬৯৫ জন। গত বছর প্রাপ্ত রেসিট্যান্সের অঙ্ক ছিল ১৫ দশমিক ৪৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। আর ২০১৭ সালে অভিবাসী কর্মীর সংখ্যা ছিল ১০ লাখ এবং রেসিট্যান্স ১৩ দশমিক ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ হিসেবে দেখা গেছে, শ্রমশক্তি খাতে বৈদেশিক কর্মসংস্থান থেকে আয় হয় ১২ শতাংশ এবং জিডিপির অংশ হিসেবে রেসিট্যান্সের পরিমাণ ৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ।
আর ২০০৯ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত কর্মী গমন ও রেমিট্যান্স পাঠানোর চিত্র থেকে জানা যায়, ২০০৯ সালে ৪ লাখ ৭৫ হাজার ২৭৮ জন এবং রেমিট্যান্স আসে ১০, ১৭১ দশমিক ৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১০ সালে কর্মী গমন কিছুটা কমে, যার সংখ্যা ৩,৯০,৭০২ জন এবং রেমিট্যান্স ১১,০০৪.৭৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১১ সালে বেগে দাঁড়ায় ৫,৬৮,০৬২ জন এবং রেমিট্যান্স ১২,১৬৮.০৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১২ সালে কর্মী গমন ৬,০৭,৭৯৮ জন এবং রেমিট্যান্স ১৪, ১৬৩.৯৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৩ সালে ৪,০৯,২৫৩ জন এবং রেমিট্যান্স ১৩,৮৩২.১৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৪ সালে ৪,২৫,৬৮৪ জন এবং রেমিট্যান্স ১৪,৯৪২.৫৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার, ২০১৫ সালে কর্মী গমন ৫,৫৫,৮৮১ জন এবং রেমিট্যান্স ১৫,২৭০.৯৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ২০১৬ সালে ৭,৫৭,৭৩১ জন এবং রেমিট্যান্স আয় হয় ১৩,৬০৯.৭৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
কর্মী গমন ক্রমান্বয়ে বাড়লেও রেসিট্যান্স সেই হারে বাড়েনি। এর কারণ হিসেবে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অবৈধ পন্থায় কিছু লোক রেমিট্যান্স পাঠানোয় শুরু থেকে এখন পর্যন্ত রেমিট্যান্স স্থিতিবস্থায় রয়েছে। তবে, বিদায়ী বছরে কর্মী গমন উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যের বাজার দেশের সংকোচিত হওয়ায় এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তবে, নতুন বাজার সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে বসে নেই মন্ত্রণালয়। এরই মধ্যে জাপানসহ ৭টি দেশে শ্রমবাজারের দরজা খুলেছে। বাকি দেশগুলো হচ্ছে— সিসেলস, ফিজি, সুদান, পালাও, পোল্যান্ড ও আলজেরিয়া।
এদিকে, বিদেশে কর্মী যাওয়ার ক্ষেত্রে অভিবাসনব্যয় একটা বড় ফ্যাক্টর। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের জন্য পাঁচ চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সেগুলো হচ্ছে— বিদেশে কর্মী পাঠানোর ব্যয় হ্রাস, নির্বাচনী ইশতেহার ২০১৮ অনুযায়ী প্রতি উপজেলা থেকে ১০০০ কর্মীর বিদেশে কর্মসংস্থান, এসডিজি, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং গ্লোবাল কমপ্যাক্ট ফর মাইগ্রেশনে ব্যক্ত অঙ্গীকার অনুযায়ী নিরাপদ, সুশৃঙ্খল, নিয়মিত ও দায়িত্বশীল অভিবাসন নিশ্চিত করা, শ্রম অভিবাসনে নিয়োজিত রিক্রুটিং এজেন্টদের কার্যক্রমে কার্যকর তদারকি এবং শ্রম অভিবাসনে নিয়োজিত মধ্যস্বত্বভোগী ও দালালদের জবাবদিহির কাঠামোতে আনা। এ ছাড়া বিদেশে নারী কর্মীদের নিরাপদ কর্মস্থল নিশ্চিত করা সরকার ও মন্ত্রণালয়ের জন্য চ্যালেঞ্জ।
সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বলেন, বিশ্ব শ্রমবাজারে জায়গা করে নিতে হলে দক্ষ জনশক্তি তৈরিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তিনি আরো বলেন, বিশ্ব শ্রমবাজারে বাংলাদেশের শ্রমিকের দক্ষতা নিয়ে যে ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে, সেটি মোকাবিলা করতে হবে। তবে সরকারের সামগ্রিক কাঠামোর মধ্যে সুশাসন আনতে না পারলে শ্রম অভিবাসন খাতে আমাদের লক্ষ্যই অর্জন করা দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে, যোগ করেন এই সাবেক রাষ্ট্রদূত।প্রতিদিনের সংবাদ