• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

মতলবের ঐতিহ্যবাহী সোলেমান লেংটার মেলা

পাগল ও নেশাখোরদের আস্তানা, চলছে চাঁদাবাজি

প্রকাশ:  ০৪ এপ্রিল ২০১৯, ১৩:৪৭
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

মতলব উত্তর উপজেলার বদরপুর (বেলতলী) গ্রামে ঐতিহ্যবাহী শাহ্সূফী সোলেমান লেংটার মাজারে ৭ দিনব্যাপী ওরছ ও মেলা চলছে। গত রোববার মেলা শুরু হয়েছে। ৭ দিনের এ মেলা আগে-পরে একমাস স্থায়ী থাকে। এ মেলা উপলক্ষে মাজার কমিটি ও আশপাশের লোকদের কয়েক কোটি টাকার বাণিজ্য হয়। মেলার আশপাশে পাগল ও নেশাখোররা আস্তানা গেঁড়ে বসেছে। চলছে অশ্লীলতা, অবাধে মাদক বিক্রি ও সেবন। আর নৌপথে চলছে চাঁদাবাজি।
সোলেমান লেংটা উপ-মহাদেশের একজন খ্যাতিমান আউলিয়ার দাবিদার। বাংলা ১২৩০ সনে কুমিল্লা জেলার মেঘনা উপজেলার গোবিনাদপুর ইউনিয়নের আলীপুর গ্রামে এক দরিদ্র পরিবারে শাহ্সূফী সোলেমান লেংটা জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম আলা বক্স ভূঁইয়া। তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময়ই কাটিয়েছেন মতলবের বিভিন্ন অঞ্চলে। সোলেমান লেংটা সাধারণত পোশাক পরিধান করতেন না। তাই তার মাজারটি লেংটার মাজার হিসেবেই পরিচিত। লেংটা ১৮ বছর বয়সে প্রথম বিয়ে করেন। সোলেমান শাহ নারায়ণগঞ্জের বক্তগুলির রাধানগরে এক নারীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। এখন সেখানে তার আওলাদরা আছে বলে দাবি উঠেছে এবং তারা প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সময় ওরছের ডাক দিচ্ছে।
শাহ্সূফী সোলেমান লেংটার ফকিরি লাভ সম্পর্কে জানা যায়, ইমাম উদ্দিন মিয়ারা ছিলো তিন ভাই। তিন ভাই নৌকা করে ভাদ্র মাসের এক অমাবস্যা রাতে সোনারগাঁয়ে তাদের পীরের সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। নৌকার মাঝি ছিলেন সোলেমান শাহ। পথিমধ্যে বৃষ্টি হয়। তিন ভাই আরাম করে নৌকার ভেতর। সোলেমান শাহ ভিজে ভিজে নৌকা চালান এবং গন্তব্যে হাজির হয়ে যান। নির্দিষ্ট সময় পর পীর সাহেব আসেন এবং এ দৃশ্য দেখে রাগ হন। পীর সাহেব তখন তিন ভাইকে উলঙ্গ হয়ে আসতে বলেন। তিন ভাই চিন্তায় পড়ে যান। আপন মায়ের পেটের তিন ভাই কীভাবে উলঙ্গ হবে একে অপরের সামনে। পীর সাহেব মাঝি সোলেমানকে উদ্দেশ্য করে কাছে আসতে বলেন। সোলেমান কাছে যান। পীর তাকে হা করতে বলেন এবং মুখে ফুঁক দেন। সেখান থেকেই সোলেমান লেংটা হয়ে বাড়ি ফিরেন। সোলেমান লেংটা কখনও পোশাক পরিধান করতেন না বলেই তিনি লেংটা নামে পরিচিত। এ মাজারটিকে সবাই লেংটার মাজার নামেই চিনে।
সোলেমান লেংটার অনেক অলৌকিক ঘটনা রয়েছে। একদিন সোলেমান লেংটা কালিপুর রমিজউদ্দিন প্রধানীয়ার বাড়িতে যান। দেখেন মহিলারা নদী থেকে ঘট পুরিয়ে ঘর, উঠোন লেপছে। তিনি তাদের পানি আনার কষ্ট দেখে তাদেরকে চোখ বন্ধ করতে বলেন। তারা চোখ বন্ধ করলে লেংটা তার নফস টেনে প্রায় ২/৩ হাত লম্বা করে পুরো উঠোন পানিতে ভিজিয়ে দেন। এ ঘটনা তিনি বিভিন্ন গ্রামে করেছেন। এক সময় মানুষ হজ্বে যেতো জাহাজে কিংবা পায়ে হেঁটে। অনেক দিন লাগতো। হজ্বে যাওয়ার সময় অনেকেই লেংটাকে বদরপুর দেখে গেছে, হজ্ব পালন করার সময় অনেকেই তাকে কাবা শরীফে দেখেছেন নামাজ আদায় করতে। এমন অসংখ্য অলৌকিক ঘটনা রয়েছে বলে জানা যায়।
সোলেমান লেংটার বোনের বাড়ি বদরপুরে মাজারটি অবস্থিত। ১৩২৫ বাংলা সনের ১৭ চৈত্র শাহ্সূফী সোলেমান লেংটা তার বোনের বাড়ি বদরপুর গ্রামে মৃত্যুবরণ করলে সেখানে কবর দিয়ে মাজার স্থাপন করা হয়। প্রতি বছর চৈত্র মাসের ১৭ তারিখে তার মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ৭ দিনব্যাপী ওরছ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে এবং মেলা বসে। ওরছ শুরু হওয়ার কয়েক দিন আগে ও পর পর্যন্ত মেলা স্থায়ী হয়। এছাড়া প্রতি বছর ভাদ্র মাসে ও সপ্তাহের বৃহস্পতিবার মাজারে ভক্তদের আগমন ঘটে। চৈত্র মাসের ১৭ তারিখের মেলায় দেশের বিভিন্ন স্থানসহ পার্শ্ববর্তী দেশ থেকে প্রতিদিন লক্ষাধিক ভক্ত, আশেকান ও সাধারণ জনগণ আসা-যাওয়া করেন। ওরছকে কেন্দ্র করে কয়েক কিলোমিটার জুড়ে মেলায় বসে রকমারি দোকান ও বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা ভক্তদের আস্তানা। মেলায় বিভিন্ন প্রকার পণ্য বিক্রয় ও ক্রয় হয়। কেউ কেউ মাদক ও অশ্লীলতার মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে রাখে।
৭ দিনের এ মেলায় আগত দোকান থেকে অনুপাতে ২ থেকে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়। মাজারে মানত মানতে দেয়া হচ্ছে গরু, ছাগল, নগদ অর্থ, আগরবাতি ও মোমবাতি। মাজারে প্রতিদিন উঠছে লাখ লাখ টাকা। সব মিলে এখানে বাণিজ্য হচ্ছে কয়েক কোটি টাকা। এ টাকার কোনো রাজস্ব পাচ্ছে না সরকার। এ টাকায় অনেকেই আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ বনছেন। সারা বছর এ মাজারটি অর্থ পাওয়ার সেক্টরে পরিণত হয়েছে। এ টাকা ভাগাভাগি নিয়ে সংঘর্ষ ও মামলা হয়েছে। কমিটির কয়েকজনকে দেখে মনে হয় মাজারের আয়ের টাকায় তারা ভালোই আছে।  
সরজমিনে দেখা যায়, প্রতি বছরের ন্যায় এখানে  চলছে মাদক বিক্রি, সেবন ও অশ্ল¬ীলতা। মেলার শুরু আগেই নেশাখোররা মাজারের চারপাশে আস্তানা গেঁড়ে বসেছে। জানা যায়, সকল প্রকার মাদকদ্রব্যই পাওয়া যায় এ মেলায়। নেশাখোরদের দেখলেই মনে হয় মেলা প্রাঙ্গণ যেনো নেশার স্বর্গরাজ্য ও নিরাপদ স্থান। দলে দলে আস্তানা বেঁধে সেবন করছে মাদকদ্রব্য। মেলা প্রাঙ্গণের বাতাসে বইছে গাঁজার গন্ধ। লেংটার মেলাকে গাঞ্জিকাসেবীদের মেলা হিসেবে অনেকেই মন্তব্য করেছেন।
মেলাকে কেন্দ্র করে নৌপথে চাঁদাবাজির অভিযোগ পাওয়া গেছে। অভিযোগে জানা যায় বিভিন্ন নৌযান করে যারা মেলায় আসছেন তারা বেলতলী লঞ্চঘাটের আশেপাশে নৌযানগুলো রাখলে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা চাঁদা দিতে হচ্ছে। যাত্রীদের লঞ্চ উঠতে ও নামতে প্রতিবারই দিতে হচ্ছে ১০ টাকা করে। অথচ সরকারি নিয়ম অনুযায়ী উঠতে ও নামতে একবার যাত্রীদের দেওয়ার কথা ৩ টাকা।
এ ব্যাপরে কয়েক জনের সাথে কথা হলে তারা নাম প্রকাশ না করে বলেন, মতলবে মাদক নিয়ন্ত্রণ করার অন্তরায় হচ্ছে লেংটার মাজারকে পুঁজি করে অবাধে মাদক বিক্রি ও সেবন। বাৎসরিক মেলা ছাড়াও সপ্তাহের বৃহস্পতিবার মাজারে ভক্তদের আগমন ঘটে। এ দিনগুলোতেও মাদক বিক্রি ও সেবন অবাধে চলে।
মতলব উত্তর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোঃ মিজানুর রহমান জানান, মেলায় সকল প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা এড়ানোর জন্যে পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। মাদক বিক্রি ও সেবনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণ করা হচ্ছে। মাদক বিরোধী অভিযান অব্যাহত থাকবে।
মতলব উত্তর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শারমিন আক্তার বলেন, মেলায় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট আছে। তারা সব ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।
উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মনজুর আহমদ বলেন, সরকার মাদকের ব্যাপরে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছে। এখানে মাদকের বিষয়ে প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ নেয়া জরুরি।

 

সর্বাধিক পঠিত