• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ

প্রকাশ:  ০৭ মার্চ ২০১৯, ১১:২৮
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

আজ ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। যে দিনটি কার্যত বাঙালির স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণার দিন হিসেবে ধরে নেয়া হয়। ১৯৭১ সালের এ দিনে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে উত্তাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধুর সেই জ¦ালাময়ী ভাষণে ধ্বনিত হয়েছে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম। মূলত জাতির জনকের এ ভাষণের পর থেকেই বাঙালি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্যে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে থাকে। তাই এ দিনটি বাঙালি জাতির ইতিহাসে অবিস্মরণীয় ও তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন। গত বছর থেকে এ দিনটির গুরুত্ব ও তাৎপর্য বিশ^ব্যাপী। তার কারণ হচ্ছে, বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণ গত বছর তথা ২০১৮ খ্রিঃ ইউনেস্কোতে ‘মেমোরী অব দ্যা ওয়ার্ল্ড’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। এটি বাঙালির জন্যে বিশাল প্রাপ্তি এবং অত্যন্ত গৌরবের।    ১৯৭১ সালের এদিনে স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানি সামরিক জান্তার শোষণ, বঞ্চনা ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে দীর্ঘ প্রায় ২৪ বছরের ধারাবাহিক আন্দোলন-সংগ্রামের পর বাঙালি জাতির চূড়ান্ত মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন। অর্থাৎ এ দিনেই তৎকালীন ঢাকার রেসকোর্স ময়দান বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো জনতার সমাবেশে পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য আর শোষণের বিরুদ্ধে সর্বপ্রকার শিকল ভাঙ্গার আনুষ্ঠানিক ডাক আসে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বর থেকে। এদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ের সূচনা হয়।    

প্রসঙ্গত, ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সংসদ এবং ১৭ ডিসেম্বর এমএলএ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। ওই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করায় জনসাধারণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ-অসন্তোষ সৃষ্টি হয়। সেই ক্ষোভের আগুনে বাঙালি রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটে একাত্তরের ২৬ মার্চ।
    প্রকৃতপক্ষে ১৯৭০ সালের ফেব্রুয়ারি থেকেই দেশজুড়ে শুরু হয় মিছিল-সমাবেশ, আন্দোলন ও প্রতিরোধ। এ আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ৭১-এর এই দিনে তথা ৭ মার্চ পুরো জাতি বঙ্গবন্ধুর ঘোষণায় কী আসে তার জন্যে উন্মুখ হয়ে অপেক্ষা করছিল। একটি দৃঢ় সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় ছিলো এ দিন বাঙালি জাতি।
    একাত্তরের ৭ মার্চ ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম জনসমাবেশ ঘটেছিলো বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে। অগণিত মুক্তিকামী মানুষের পদভার ও আকাক্সক্ষার কথোপকথনে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিলো চারপাশ। আর এ জন্যেই সেদিন রেসকোর্স ময়দানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে লাখ লাখ মানুষ সমবেত হয়েছিলো, যাদের কণ্ঠে ছিলো শোষণ-বঞ্চনা থেকে মুক্তির দৃপ্ত শ্লোগান। এদিন ঢাকার রাজপথ উত্তেজনায় টানটান হয়ে উঠেছিলো মুক্তিপাগল মানুষের বিক্ষোভ মিছিলে। আর রেসকোর্স ময়দানের সেই জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন বাঙালির জাতীয় মুক্তির ঐতিহাসিক মহাকাব্যের সেই অমর বাণী ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণের সঙ্গে সঙ্গেই প্রবল ঢেউ উঠে রেসকোর্স ময়দানের সেই উত্তাল জনসমুদ্রে। বঙ্গবন্ধু তাঁর এ ঐতিহাসিক ভাষণে সবাইকে দিকনির্দেশনা দিলেন ‘তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।’ ঘোষণা করলেন স্বাধীনতার রূপরেখা। সেখানে জাতীয় মুক্তির চূড়ান্ত ঘোষণাসহ আন্দোলনের কর্মপন্থা সুনির্দিষ্ট করে দিলেন বঙ্গবন্ধু। মূলত এদিন থেকেই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি।
    ঐতিহাসিক এ দিনটি স্মরণে চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগ নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। আজ সকাল সাড়ে ৭টায় জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে (অস্থায়ী কার্যালয়, টাউন হল মার্কেটের দ্বিতীয় তলা) জাতীয় ও দলীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ৮টায় বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে মাল্যদান এবং বিকেল ৫টায় একই স্থানে আলোচনা সভা ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এসব কর্মসূচিতে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের সর্বস্তরের নেতা-কর্মীকে উপস্থিত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাছির উদ্দিন আহম্মেদ ও সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটওয়ারী দুলাল।
    পূর্ণাঙ্গ ভাষণ : ‘ভায়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়, বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কী অন্যায় করেছিলাম? নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় ২৩ বৎসরের করুণ ইতিহাস, বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বৎসরের ইতিহাস মুমূর্ষু নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস-এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল’ জারি করে ১০ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনে ৭ই জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯-এর আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন-আমরা মেনে নিলাম। তারপরে অনেক ইতিহাস হয়ে গেলো, নির্বাচন হলো।
আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি শুধু বাংলা নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাকে অনুরোধ করলাম, ১৫ই ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন, প্রথম সপ্তাহে মার্চ মাসে হবে। আমরা বললাম, ঠিক আছে, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসবো। আমি বললাম, অ্যাসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করবো-এমনকি আমি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজনও যদি সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেবো। জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন, আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরো আলোচনা হবে। তারপরে অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, তাদের সঙ্গে আলাপ করলাম-আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করবো। তিনি বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে অ্যাসেম্বলি। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলে দেয়া হবে। যদি কেউ অ্যাসেম্বলিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম, অ্যাসেম্বলি চলবে। তারপরে হঠাৎ ১ তারিখে অ্যাসেম্বলি বন্ধ করে দেওয়া হলো।
ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসেবে অ্যাসেম্বলি ডেকেছিলেন। আমি বললাম, আমি যাবো। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। ৩৫ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপর হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো, দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। বন্ধ করে দেয়ার পরে এদেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল।
আমি বললাম, শান্তিপূর্ণভাবে আপনারা হরতাল পালন করেন। আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সব কিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিলো। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো, তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্যে স্থির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো।
কী পেলাম আমরা? আমার পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্যে, আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুঃখী নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে-তার বুকের ওপরে হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু-আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।
টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তাঁকে আমি বলেছিলাম, জেনারেল ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কীভাবে আমার গরিবের ওপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের ওপর গুলি করা হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে, কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি বললেন, আমি নাকি স্বীকার করেছি যে, ১০ তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে। আমি তো অনেক আগেই বলে দিয়েছি, কীসের রাউন্ড টেবিল, কার সঙ্গে বসবো? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে, তাদের সঙ্গে বসবো? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার ওপরে দিয়েছেন, বাংলার মানুষের ওপরে দিয়েছেন।
ভায়েরা আমার, ২৫ তারিখে অ্যাসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি ১০ তারিখে বলে দিয়েছি, ওই শহীদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মজিবর রহমান যোগদান করতে পারে না। অ্যাসেম্বলি কল করেছেন, আমার দাবি মানতে হবে। প্রথম, সামরিক আইন-মার্শাল ল' উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরৎ নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখবো, আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারবো কি পারবো না। এর পূর্বে অ্যাসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না।
আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট-কাচারী, আদালত-ফৌজদারী, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্যে বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে সেইজন্যে যে সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো আছে সেগুলোর হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়ারগাড়ি, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে-শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোর্ট, হাইকোর্ট, জজকোর্ট, সেমি গভর্নমেন্ট দপ্তরগুলো, ওয়াপদা কোনো কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপরে যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তা-ঘাট যা যা আছে সবকিছু-আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মারবো, আমরা পানিতে মারবো। তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের ওপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না। আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগ থেকে যদ্দুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করবো। যারা পারেন আমাদের রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা-পয়সা পৌঁছে দেবেন। আর এই সাতদিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইয়েরা যোগদান করেছে, প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌঁছে দেবেন।
সরকারি কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এই দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো-কেউ দেবে না। মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-ননবাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আপনাদের ওপর, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন, রেডিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোন বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমাদের নিউজ না দেয়, কোন বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না। ২ ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মায়না-পত্র নেবার পারে। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাম আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সঙ্গে নিউজ পাঠাতে হলে আপনারা চালাবেন। কিন্তু যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেসুঝে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল। এবং তোমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।

এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।