ফরিদগঞ্জে ওরসের তবররুক খেয়ে অসুস্থ হওয়ার ঘটনায় তোলপাড় ॥ স্বাস্থ্য বিভাগের বিশেষ টিম ঘটনাস্থলে
মতলব কলেরা হাসপাতালে রোগীদের লাইন
ফরিদগঞ্জ উপজেলার ৩নং সুবিদপুর পূর্ব ইউনিয়নের উভারামপুরে ওরস মাহফিলের তবররুক খেয়ে সহ¯্রাধিক লোক অসুস্থ হওয়ার ঘটনায় তোলপাড় চলছে। চাঁদপুর কণ্ঠে গতকাল শনিবার এ সংক্রান্ত প্রকাশিত রিপোর্টের পর শনিবার বিকেলে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ জাহাঙ্গীর আলম শিপনের নেতৃত্বে স্বাস্থ্য বিভাগের একটি বিশেষ টিম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে। এ টিম অসুস্থ হওয়া রোগীদের আতঙ্কিত না হয়ে দ্রুত সুস্থ হওয়ার পরামর্শ প্রদান করে। শনিবার বিকেলে স্বাস্থ্য বিভাগের বিশেষ টিম দুইশ’ লোককে চিকিৎসা দিয়েছে। এছাড়া রোববার ও সোমবার পার্শ¦বর্তী মুন্সীরহাট উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে বিশেষ চিকিৎসা সেবা দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়।
সংবাদ পেয়ে ফরিদগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আলী আফরোজ ও থানার অফিসার ইনচার্জ হারুনুর রশিদ চৌধুরী গতকাল শনিবার বিকেলে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। এদিকে গতকাল শনিবারও মতলব আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রে (মতলব কলেরা হাসপাতালে) মাহফিলের তবররুক খেয়ে অসুস্থ হওয়া রোগীদের চিকিৎসা নেয়ার জন্যে ভিড় করতে দেখা গেছে।
জানা যায়, গত ৭৬ বছরের ন্যায় এ বছরও গত ৯ জানুয়ারি বুধবার উভারামপুর পাটওয়ারী বাড়ির আয়োজনে স্থানীয় উভারামপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে বার্ষিক ওরস ও দোয়ার মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। এ মাহফিলে ফরিদগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী হাজীগঞ্জ উপজেলাসহ কয়েকটি উপজেলার প্রায় ২/৩ হাজার লোক অংশগ্রহণ করে। রাতে মাহফিল শেষে পরদিন বৃহস্পতিবার সকাল থেকে তবররুক বিতরণ করা হয়। আর এ তবররুক খেয়ে মাহফিলে অংশগ্রহণকারী সহ¯্রাধিক নারী পুরুষ ও শিশু অসুস্থ হয়ে পড়ে। এদের মধ্যে গত দু’ দিনে মতলব দক্ষিণ উপজেলাস্থ আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্রে (মতলব কলেরা হাসপাতাল) তিন শতাধিক লোক চিকিৎসা সেবা নেয়। যার মধ্যে ফরিদগঞ্জ উপজেলারই শতাধিক লোক চিকিৎসা নেয় বলে উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন।
অসুস্থরা জানায়, ওই তববরুক ছিলো তেহেরী (ডাল, গরুর মাংস, মসলা) জাতীয় খাবার। এ খাবার খাওয়ার ৪/৫ ঘন্টা পর থেকে অনেকেরই বমি ও পাতলা পায়খানা হতে শুরু করে। এদের মধ্যে বেশিরভাগ নারী, পুরুষ ও শিশু প্রাথমিকভাবে হাসপাতালে ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় চিকিৎসা নিয়েছে। চিকিৎসা নেয়াদের মধ্যে ফরিদগঞ্জ উপজেলার মূলপাড়া গ্রামের মাইন উদ্দিন (৫৫), রাবেয়া (১৮), সালমা (২৪), মহসীন (৫৫), হোসনা (১৮), মর্জিনা (২২), মুক্তা (২৬), সুলতান (৮), বাছির (৪), মারজান (৩), জহির (৩৫), জাকির সর্দার (৩৩), গিয়াস উদ্দিন (৪৫), পশ্চিম বাসারা গ্রামের আনোয়ার হোসেন (৪০), আফিজ (৪৪), নূরে আলম (৩০), হাশিম (৩৫), নাফিস (২২), হুমায়ুন কবির (৩৭), মজিবুর রহমান (২৪), হাজীগঞ্জের বলাখাল এলাকার শাহিনুর (২২), মাইসা (২২), শফিকুল ইসলাম (৪০), ফরিদগঞ্জের উভারামপুরের হাজেরা বেগম (৩৬), তামান্না (২১), শিরিন (১৮), আব্দুল্যা আল নূর (১৩), তানভীর হোসেন (২২), মারজান (১১), বশির (২২), মিজান (৪০), নাছির (১২), নাজমুন নাহার (১৪), আনোয়ার হোসেন (৩৫), মরিয়ম (৭), তাছলিমা (৩৫), রাখি (৩৪) প্রমুখ।
তবররুক খেয়ে অসুস্থ হওয়া রোগীদের বহন করা সিএনজি স্কুটার চালক আবুল কাশেম জানান, গত দু’ দিনে তিনি নিজেই তবররুক খেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়া অন্তত ৩০জন রোগীকে মতলব কলেরা হাসপাতালে এনেছেন। একই কথা জানিয়ে অপর ক’জন সিএনজি স্কুটার চালক বিল্লাল, সোহাগ ও মোর্শেদসহ আরো অনেকে জানান, গত দু’ দিনে আমরা ওরসের তবররুক খেয়ে অসুস্থ হওয়া লোকজনকে বহন করেছি।
স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক আবুল সাদেক কাশেম জানান, তিনি গত দু’ দিনে অন্তত তিন শতাধিক রোগীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়েছেন। মাহফিল কমিটির সভাপতি নূরুল ইসলাম পাটওয়ারীর পরিবারের লোকজন জানান, মাহফিলে তেহেরী রান্নায় ব্যবহৃত পানি ও অন্যান্য উপকরণ পরীক্ষা করা হবে। তিনিও একই কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মাওঃ শারাফাত উল্লাহ জানান, গত ৭৬ বছর ধরে উভারামপুরে এই ঐহিত্যবাহী মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। এবারই প্রথম তবররুক খেয়ে অসুস্থ হওয়ার ঘটনা ঘটলো। প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করা হচ্ছে।
তবররুক খেয়ে অসুস্থ হওয়ার ঘটনায় স্বাস্থ্য বিভাগের বিশেষ টিম নিয়ে ঘটনাস্থলে যাওয়া উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. জাহাঙ্গীর আলম শিপন জানান, খাবার প্যাকেটজাত থাকায় খাদ্যে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। স্বাস্থ্য বিভাগের টিম আক্রান্ত রোগী ছাড়াও স্থানীয় লোকজনকে প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদান করছেন।
মতলব আইসিডিডিআরবির চিকিৎসক ডাঃ চন্দ্র শেখর জানান, শুক্রবার ও শনিবার দু’ দিনে বমি, পাতলা পায়খানা ও জ্বর নিয়ে ফরিদগঞ্জ এবং হাজীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে রোগীরা হাসপাতালে আসতে থাকে। গত দু’ দিনে তিন শতাধিক রোগীকে তারা চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। সুনির্দিষ্টভাবে শনিবার বিকেল পর্যন্ত ফরিদগঞ্জ উপজেলার ১৯৪জন ও হাজীগঞ্জ উপজেলার ৭৬জনকে তারা চিকিৎসা দিয়েছেন। তবে আশঙ্কাজনক হওয়ায় রাসেল (২২) ও রিমা (২৪) নামে দু’ জন আইসিডিডিআরবিতে ভর্তি হলেও তাদেরকে দ্রুত চাঁদপুর সদর হাসপাতালে রেফার করা হয়েছে। খাদ্যে বিষক্রিয়াজনিত কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে বলে তিনি জানান।
উভারামপুর ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আসা ফরিদগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আলী আফরোজ জানান, তবররুক খেয়ে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়লেও আতঙ্কে মানুষ আরো বেশি ভীত হয়ে পড়েছে। আমরা সেখানে গিয়ে তাদের আতঙ্ক দূর করার চেষ্টা করেছি। শনিবার স্বাস্থ্য বিভাগের লোকজন চিকিৎসা সেবা দিয়েছেন। এলাকা থেকে আতঙ্ক দূর করতে রোববার ও সোমবার দিনও পার্শ্ববর্তী উপস্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসার ব্যবস্থার নেয়া হয়েছে।