• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

চাঁদপুর সিএসডি গোডাউন থেকে বিভিন্ন খাতে বরাদ্দকৃত চাল পাচার ॥ বস্তা বদল করে সরকারের কাছে বিক্রি!

সিন্ডিকেট চক্রের সদস্য প্রদীপসহ অনেকেই এখন কোটিপতি ॥ ৪শ’ বস্তা আটক চাল পুলিশের বলে রক্ষা

প্রকাশ:  ১০ জুলাই ২০১৮, ০১:৪০
বিশেষ প্রতিনিধি ॥
প্রিন্ট

 চাঁদপুর সরকারি খাদ্য গুদাম থেকে প্রতিদিনই শত শত বস্তা কাবিখা-টিআর-ভিজিএফ-ভিজিডি-এফএফডব্লিউ নামে বরাদ্দকৃত চাল অবৈধভাবে পাচার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। সরকারি খাদ্য গুদামের চাল চিহ্নিত কিছু ব্যবসায়ীর গোডাউনে ও পুরাণবাজারে চিহ্নিত কিছু রাইচ মিলে নিয়ে বস্তা বদল করে স্থানীয় মিলের নাম ব্যবহার করে সরকারের কাছে উচ্চ দামে বিক্রি করার অভিযোগ উঠেছে। চাঁদপুর সিএসডি গোডাউন এলাকার শক্তিশালী একটি সিন্ডিকেট চক্রের সদস্য প্রদীপসহ অনেকেই সরকারি গোডাউনের চাল অবৈধ পন্থায় ক্রয়-বিক্রয় করে এখন কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে। অবৈধ পন্থায় চাল বিক্রি করে কোটিপতি হওয়া এসব বড়-বড় কালোবাজারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারির তালিকায় নিজেদের নাম লিপিবদ্ধ করেছেন কালোবাজারির অপবাদ থেকে নিজেকে রক্ষা করে সমাজে প্রতিষ্ঠার জন্যে। এসব কালোবাজারি অন্তরালে থেকে অন্যদের দিয়ে তাদের এ ব্যবসা পরিচালনা করছেন বলে একাধিক সূত্রে জানা গেছে।
    গত ২৭ জুন পুরাণবাজারের পৌর কমিউনিটি সেন্টারের নিচের মার্কেটে জাহিদ ট্রেডার্সের মালিক জাহিদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আটক হয় ৪শ’ বস্তা কাবিখার চাল। এ চালকে পুলিশ সুপারের কার্যালয়ের সামনে পুকুর খননের বরাদ্দকৃত পুলিশের চাল বলে মিথ্যা তথ্য দিয়ে তখন রক্ষা পেয়েছে জাহিদ ও চালের মালিক দাবিদার প্রদীপ ঘোষ নামে অসাধু ব্যক্তি। অথচ পরে খবর নিয়ে জানা যায়, প্রায় ৩ মাস পূর্বে বরাদ্দ পেয়ে ওই চাল বিক্রি হয়ে যায়। চাঁদপুরের পুলিশ সুপারকে মিথ্যা ও ভুল তথ্য দিয়ে পুরাণবাজার পুলিশ ফাঁড়ির এসআই জাহাঙ্গীর কাবিখার ৪শ’ বস্তা চাল অন্যত্র পাচার করার সুযোগ করে দিয়েছে। এ বিষয়ে চাঁদপুর সিএসডি গোডাউনের ব্যবস্থাপক সালমা আক্তার জানান, সরকারি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বরাদ্দ ছাড়া কোনো সংস্থাকে চাল গোডাউন থেকে বের করে দেয়ার ক্ষমতা আমার নেই। যেসব সংস্থার বরাদ্দ হয় সে চাহিদাপত্র পাওয়ার পর গোডাউন থেকে চাল দিয়ে থাকি।
    একটি সূত্রে জানা যায়, চাঁদপুরে সরকারি খাদ্য গুদাম থেকে টিআর, কাবিখা, ভিজিডি, ভিজিএফ ও এফএফডব্লিউসহ বিভিন্ন প্রকল্পের নামে বরাদ্দ হওয়া হাজার হাজার বস্তা চাল অবৈধভাবে বিভিন্ন জায়গায় পাচার করা হচ্ছে। দীর্ঘ বছর যাবৎ সিএসডি গোডাউন ও নতুনবাজার এলাকার কয়েকটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে চাল পাচারকারী চক্র এ সরকারি গোডাউন থেকে শত শত বস্তা চাল ট্রাক বোঝাই করে গ্রাম গঞ্জে পাচার করে বিভিন্ন স্থানে তারা সে চাল পাঠিয়ে অধিক দামে বিক্রি করে থাকে। আর এসব করে রাতারাতি লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করে বড় ব্যবসায়ী ও ঠিকাদার বনে যাচ্ছে। সিন্ডিকেটটি ইউপি চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে টিআর, কাবিখা, ভিজিএফ, ভিজিডি ও এফএফডব্লিউসহ বিভিন্ন প্রকল্পের বরাদ্দ পাওয়া হাজার হাজার বস্তা চাল কম মূল্যে তথা তাদের নিজেদের নির্ধারিত মূল্যে ক্রয় করে। সেই চাল পরে তারা তাদের চক্রের মাধ্যমে জেলার বিভিন্ন বাজারে উচ্চমূল্যে বিক্রি করে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণœ করছে। এর বেশির ভাগ চাল শহরের পুরাণবাজারে চিহ্নিত কয়েকটি রাইস মিলে ও গোডাউনে আনা হয়ে থাকে বলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারের এক কর্মকর্তা জানান। আর সিন্ডিকেটের মূল হোতারা আড়ালে থেকে তাদের এক হোতা পুরাণবাজার ঘোষপাড়ার বাসিন্দা প্রদীপকে দিয়ে বেশ কয়েক বছর যাবৎ সিএসডি গোডাউন থেকে চাল পাচার করে পুরাণবাজারে বিক্রি করছে। এছাড়া সরকার চাঁদপুরের ১৩টি মিলের মধ্যে যে সকল মিল থেকে চাল সংগ্রহ করছে সেখানেও হচ্ছে বড় ধরনের দুর্নীতি। সেখানে এ সিন্ডিকেটের হোতা প্রদীপ পুরাণবাজারের বেশ কটি রাইস মিল থেকে চালের ডিও ক্রয় করে নিয়ে তাদের নামে চাল সরকারি খাদ্য গুদামে সরবরাহ করে থাকে। এই কালোবাজারি ও চোরাকারবারি প্রদীপ সরকারি খাদ্য গুদাম থেকে টিআর, কাবিখা, ভিজিএফসহ বিভিন্ন প্রকল্পের বরাদ্দকৃত হাজার হাজার বস্তা চাল কম মূল্যে ক্রয় করে ইউপি চেয়ারম্যান ও ডিওধারীদের কাছ থেকে। আর এসব চাল ট্রাক বোঝাই করে গোডাউন থেকে এনে কয়েকটি রাইস মিলে মজুদ করে। রাইস মিলের গোডাউনের ভেতরে টিআর, কাবিখা ও ভিজিএফ-এর চালগুলো শুধুমাত্র বস্তা পরিবর্তন করে সেই চাল পুনরায় সিএসডি গোডাউনে সরবরাহ করা হয়। এ বস্তা বদলের মধ্য দিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। অবৈধভাবে চাল সিএসডি গোডাউনের একদিকে দিয়ে বের হয়ে অপর দিকে পুনরায় অপর গোডাউনে সরবরাহ হয়। এই সিন্ডিকেটের হোতা প্রদীপ অল্প কয়েক বছরে হয়েছেন কোটিপতি। আর তাকে শেল্টার দিয়ে এ কাজ করার সুযোগ করে দিচ্ছেন সরকারি দলের নাম ও পদবী ব্যবহারকারী (চাঁদপুর পৌর কমিটি) এক ব্যক্তি।
    খোঁজ খবর নিয়ে জানা যায়, দীর্ঘদিন যাবৎ চাঁদপুরের একটি অসাধু চক্র সরকারের খাদ্য গুদাম হতে অবৈধ পন্থায় সরকারি চাল পাচার করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। দুঃস্থ, অসহায় ও গরিবদের জন্যে টিআর, কাবিখা, ভিজিএফসহ অন্যান্য চাল তারা সঠিকভাবে বিতরণ না করে সে চাল বাজারে বিক্রির জন্য পাচার করে যাচ্ছে। সরকার দেশের প্রচলিত নিয়ম মোতাবেক ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বরাদ্দ দিয়ে থাকে এসব চাল। সে চাল যথাযথভাবে অসহায়রা না পেয়ে তা চোরাই পথে বিক্রি হয়ে যায়। এ চাল জেলার খাদ্য বিভাগ থেকে সরবরাহ করার পূর্বে সিন্ডিকেট ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অথবা যেসব প্রতিষ্ঠান চাল বরাদ্দ পায় তাদের কাছ থেকে অর্ধেক মূল্যে ক্রয় করে নেয়। কোনো প্রতিষ্ঠান কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) প্রকল্পের চাল কাজ না করিয়ে বিক্রি করে সে টাকা অন্য খাতে ব্যবহার করার জন্য চাল বিক্রি করে দেয়। সে ক্ষেত্রে অন্য জায়গায় বেশি দামে চাল বিক্রি করতে পারলেও সিএসডি গোডাউনের সিন্ডিকেটের কারণে তা পারে না। আর এ চাল সিন্ডিকেটের বাইরে অন্য কেউ ক্রয় করার সাহস পায় না। এসব চাল পুরাণবাজার এলাকার কালোবাজারি প্রদীপ দীর্ঘদিন যাবৎ খাদ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের সাথে গোপন সমঝোতার মাধ্যমে ও ইউপি চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে কমমূল্যে ক্রয় করে পুরাণবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে পাচার করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়ে নিজে লাভবান হচ্ছে। পুরাণবাজার রয়েজ রোড এলাকায় তার একটি বহুতল ভবন রয়েছে। চাঁদপুর শহরের পালবাজার এলাকার এসব মাল ক্রয়কারী সিন্ডিকেটের একজন সদস্য নিজেই এ প্রতিনিধিকে বলেন, এ সব রিপোর্ট করবেন না। কেননা এ সব চাল বরাদ্দ ছাড়া আসে না। আপনি মসজিদ, মাদ্রাসার জন্য চাল পেলে সে চাল কী করবেন। বিক্রিতো করতে হবেই। সেহেতু এ কাজ কখনও বন্ধ হবে না। পুলিশ এসব সম্পর্কে অবগত রয়েছে।
    গত ২৭ জুন পুরাণবাজার এলাকার সরকার দলীয় একদল যুবক  জাহিদ ট্রেডার্সে গিয়ে চাল আটক করেছিল। এ চাল ক্রয়কারী অবৈধ ব্যবসায়ী জাহিদকে পাকড়াও করে পুলিশকে খবর পাঠায়। এ ঘটনাটি চাঁদপুরের পুলিশ সুপারকে স্থানীয় সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়। তিনি ঘটনা সম্পর্কে অবগত হয়ে পুরাণবাজার ফাঁড়িকে ঘটনার বিষয়ে তদন্তপূর্বক ব্যবস্থাগ্রহণ করার নির্দেশ প্রদান করেন। পুরাণবাজার ফাঁড়ির দায়িত্বরত  পুলিশ কর্মকর্তারা জাহিদ ট্রেডার্সে গিয়ে জাহিদের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে সুযোগ করে দেয় জাহিদকে। যার ফলে ঐদিন রাতে জাহিদ তার দোকান বন্ধ করে ভেতরে শ্রমিক দিয়ে সরকারি চালের বস্তা পরিবর্তন করে পরদিন  ট্রাক বোঝাই করে মহামায়া বাজারে বেশ কয়েকটি দোকানে বিক্রি করে। সে এসব চাল বিক্রি করে দিয়ে নিজে রক্ষা পায় ও চালের চালান রক্ষা করে।
    এ ব্যাপারে জাহিদ ট্রেডার্সের চাল ক্রয়কারী জাহিদের কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, পুলিশকে জানিয়ে আমার ভালো হয়েছে। পুলিশ আসার পর আমার টেনশন কমে যায়। পুলিশ সহযোগিতা করায় আমি চাল বস্তা বদল করে মহামায়া এলাকায় নিয়ে পুরাণবাজারের চাইতে বেশি দামে বিক্রি করে দিয়েছি। যেসব যুবক এ চাল বিক্রিতে বাধা দিয়েছে, তাদেরকে টাকা দেয়ার কথা ছিল। সে টাকা আর দিতে হয় না। আগামীতে কাজ করলে পুলিশের সাথে ও সংবাদপত্রের সাথে যোগাযোগ করে কাজ করবো। পুরাণবাজার ফাঁড়ির জাহাঙ্গীর আমার উপকার করেছে।
    এ ব্যাপারে সিন্ডিকেট সদস্য প্রদীপের কাছে জানতে চাইলে তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, আমার বিরুদ্ধে পত্রিকায় লেখলেও কিছুই হবে না। কারণ সব ম্যানেজ করে এই ব্যবসা করছি। পুলিশ সুপার কার্যালয়ের সামনের পুকুরের কাজের যে চাল ক্রয় করেছি, সে কাগজপত্র রয়েছে। এটিকে অবৈধ চাল বলা ঠিক না। সরকার থেকে যারা বরাদ্দ পায় তাদের কাছ থেকে ১ টাকা কমে চাল ক্রয় করি। খরচ গিয়ে আমি  কেজি প্রতি ২৫ পয়সা পাই। আমার চালান নাই। সাবেক এক পুলিশ কর্মকর্তার কাছ থেকে টাকা হাওলাত নিয়ে ব্যবসা করছি। আমার কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে পুরাণবাজারের বাড়িটি করা নিয়ে। এ বাড়িটি আমরা ৩ ভাই মিলে করছি। ২ ভাই চাকুরি করে অন্যের প্রতিষ্ঠানে। কয়েকটি রাইস মিলের চাল আমার মাধ্যমে সিএসডি গোডাউনে দেয়া হচ্ছে। যে পরিমাণ লাভ হয়, তার লাভের অংশ রাইস মিল মালিকসহ ভাগ করে নিচ্ছি।
    এ ঘটনায় চাঁদপুর সিএসডি গোডাউনের ব্যবস্থাপক সালমা আক্তারের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি  জানান, টিআর, কাবিখা, ভিজিএফ, ভিজিডি-এফএফডব্লিউসহ সরকারের বিশেষ বরাদ্দের চাল খাদ্য গুদাম থেকে সঠিকভাবে সরবরাহ করা হচ্ছে। যদি কেউ সে চাল এখান  থেকে নিয়ে বাজারে বিক্রি করে তাহলে সেখানে আমার কিছুই করার নেই। তবে সেটা সম্পূর্ণ অবৈধ। যদি এ ধরনের ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে তাদেরকে হাতেনাতে আপনারা ধরে পুলিশকে জানান। পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেবে।
    টিআর, কাবিখা, ভিজিএফ, ভিজিডি-এফএফডব্লিউ এসব সরকারের বিশেষ বরাদ্দের চাল খাদ্য গুদাম থেকে বের করে নিয়ে খোলাবাজারে বিক্রি করায় সাধারণ জনগণের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। চাঁদপুরে পুলিশের জন্যে প্রতি মাসে বরাদ্দ আসে ৩৩/৩৪ টন, আনসারের জন্যে ৭/৮ টন, জেলখানার কারারক্ষীদের জন্যে ৮/১০ টন, ফায়ার সার্ভিসের জন্যে ২ টন, ভিজিডির দুঃস্থ নারীদের চাঁদপুর সদর ও হাইমচরের জন্যে ৯৬ টন। প্রতিজন মহিলা পাবে প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল। এ বছর সরকার চাঁদপুরের ১৩টি মিল থেকে ৩১শ’ টন চাল ক্রয় করবে। প্রতি কেজি চাল ক্রয় করা হবে ৩৫ টাকা ৫০ পয়সা করে। তবে বিগত বছর ধান ক্রয় হলেও এবছর চাঁদপুর থেকে এখনো ধান ক্রয় হয় না। চাঁদপুরের সিএসডি এলাকায় যে সব সিন্ডিকেটের মূলহোতা রয়েছে, তাদের নাম ঠিকানা পরে প্রকাশ করা হবে।

সূত্র : চাঁদপুর কণ্ঠ

সর্বাধিক পঠিত