• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪, ২৪ বৈশাখ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

নির্যাতনের শিকার শিশু গৃহকর্মী শাওন

প্রাণ রক্ষার্থে ১১ তলা থেকে পাইপ বেয়ে নিচে নেমে রক্ষা

প্রকাশ:  ২৩ জুন ২০১৮, ০৮:৩৬ | আপডেট : ২৩ জুন ২০১৮, ০৮:৪১
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

 চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার রূপসা দক্ষিণ ইউনিয়নের উত্তর সাহেবগঞ্জ গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম কালুর ছেলে মেধাবী ছাত্র জাহিদুল ইসলাম শাওন। কিন্তু কিছুটা চঞ্চল প্রকৃতির। তাই বেশ কয়েকটি মাদ্রাসায় পড়ার পর সর্বশেষ ২০১৭ সালের সাহেবগঞ্জ মাদ্রাসা থেকে বদরপুর আলিম মাদ্রাসা কেন্দ্রে পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। অল্পের জন্যে জিপিএ-৫ পায়নি। কিন্তু সেখানেই থেমে যায় পড়ালেখা। কারণ, পিতার দারিদ্র্য।  পিতা জাহাঙ্গীর আলম এক সময় মিস্ত্রির কাজ করেছেন, আবার এক সময় বগুড়ার দই বিক্রি করেছেন। এভাবেই তার নিকটাত্মীয়ের একটি বাড়িতে তিন সন্তান নিয়ে সংসার জীবন কাটাচ্ছিলেন। মেধাবী ছেলের পড়ালেখা বন্ধ। চোখেমুখে অন্ধকার। কী করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না। একই এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় জাহাঙ্গীর নারায়ণগঞ্জের মোজাম্মেল হোসেন বাহারের শ^শুরের তথা টিকুর পিতার দেখাশোনা করেছিলেন। সেই সূত্রে মোজাম্মেল হোসেন বাহারের ঢাকার ইস্কাটন গার্ডেনের ১২/এ, নম্বর বাড়ির ১১ তলার ১১০২ নম্বর ফ্ল্যাটে টুকটাক ঘরের কাজ করার পাশাপাশি পড়ালেখা করার শর্তে গত ৭ মাস পূর্বে তিনি তার পুত্র শাওনকে সেখানে পাঠান। এ ব্যাপারে স্থানীয় রুবেল খাঁ তাকে সহযোগিতা করেন। কিন্তু সে আশা নিরাশায় পরিণত হয় জাহাঙ্গীর আলম কালুর। অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়ে তার পুত্র জাহিদুল ইসলাম শাওন বাধ্য হয়ে বাথরুমের ভ্যান্টিলেটর দিয়ে বেরিয়ে ১১তলা থেকে বাথরুমের পাইপ বেয়ে নিচে নেমে এসে প্রাণে বাঁচে। বিষয়টি স্থানীয় এক বাসিন্দার নজরে এলে তিনি ‘৯৯৯’ নম্বরে ফোন দিয়ে সহায়তা চান। তাৎক্ষণিক এগিয়ে আসেন রমনা থানা পুলিশ। তারা অভিযান চালিয়ে ওই বাসার গার্ডরুম থেকে শাওনকে বন্দী অবস্থায় উদ্ধার করেন। রমনা থানা পুলিশ এ ঘটনায় তিনজনকে আটক করেছে। পরে গৃহকর্মী নির্যাতনের সত্যতা পাওয়ায় মামলা করে পুলিশ। আটককৃতরা হলেন গৃহকর্তা মোজাম্মেল হোসেন বাহারের স্ত্রী তামান্না খান মিলি, ছেলে তানজিলুর রহমান ও গৃহকর্তার ভায়রা ইকবাল হোসেন সোহাগ। ঘটনার পর থেকে গৃহকর্তা মোজাম্মেল হোসেন বাহার পলাতক রয়েছেন।
সরজমিনে শুক্রবার দুপুরে উত্তর সাহেবগঞ্জ গ্রামের দিঘিরপাড়ে শাওনদের বাড়ি গেলে কথা হয় তার মা হাফজা বেগমের সাথে। তিনি জানান, এক ছেলে দুই মেয়ের জননী তিনি। বাপের বাড়ি গোবিন্দপুর উত্তর ইউনিয়নের সরকার বাড়ি। স্বামী জাহাঙ্গীর আলম কালু একসময় নারায়ণগঞ্জের মোজাম্মেল হোসেন বাহারের শ^শুরের তথা টিকুর পিতার দেখাশোনা করেছিলেন। বৃদ্ধ মারা যাওয়ার পর এলাকায় এসে মিস্ত্রি কাজ শুরু করেন। পরে বগুড়ার দই বিক্রি করছেন দোকানে দোকানে। ওই সময়ও নারায়ণগঞ্জের টিকুর সাথে যোগাযোগ ছিলো। সেই সূত্র ধরে ছেলে শাওনকে ঢাকায় পড়ালেখা অব্যাহত রাখার সাথে সাথে তাদের নিকটাত্মীয় ঢাকার ইস্কাটনের বাসায় থাকার জন্যে কথা হয়। ছেলেও খুশি হয়ে রাজি হয়।
তিনি আরো বলেন, গত সাত মাস পূর্বে তাকে স্থানীয় রুবেল খাঁর সহযোগিতা নিয়ে ওই বাসায় দেয়া হয়। সেই থেকে আজ পর্যন্ত একটি বারের জন্যেও ছেলের মুখ দেখিনি। বেশ কয়েকবার তাকে বাড়ি আসার কথা বললেও ওই পরিবারের লোকজন বলেছে, ছেলে বাড়ি গেলে নষ্ট হয়ে যাবে। পড়ালেখার ক্ষতি হবে। আমাদের কাছে সে আদরেই রয়েছে। আমরাও সরল বিশ্বাসে ছিলাম। রমজান মাসে আমরা সিদ্ধান্ত নিই ১৫ রমজানের সময় ঢাকায় শাওনকে দেখতে যাবে তার বাবা এবং ঈদে যেনো তাকে বাড়িতে আসতে দেয় সেজন্যে বলে আসবে। ফোনে ঢাকা যাবেন বলে জানায় তার স্বামী। কিন্তু ১৭ রমজানে হঠাৎ করেই দৃশ্যপট পরিবর্তন হয়ে যায়। এক নাগাড়ে কথা বলে চুপ থাকেন হাফজা বেগম। একটু পর আবার কথা শুরু করেন। বিমর্ষ মুখে বলেন, ঢাকা থেকে তার মোবাইল ফোনে কল আসে শাওন মোজাম্মেল হোসেন বাহারের বাসা থেকে দেড় লাখ টাকা চুরি করে তার মায়ের বিকাশ একাউন্টে পাঠিয়েছে। এ সময় তারা বিষয়টি চ্যালেঞ্জ করে বলেন, আপনারা আমাদের ফোন তল্লাশি করে প্রমাণ নিন। পরদিন তার স্বামী জাহাঙ্গীর আলম টিকুর সাথে কথা বলে নারায়ণগঞ্জ গেলে সেখানে তাকে আটকিয়ে রেখে নির্যাতন করা হয়। এক পর্যায়ে নির্যাতনের মুখে তার স্বামীর মুখ থেকে দেড় লাখ টাকা চুরির কথা বের করার চেষ্টা করেন। তিনি দ্রুত রুবেল খাঁর কাছে গিয়ে কোনো কূলকিনারা না পেয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য খায়ের পাটওয়ারীর ভাই বাসু পাটওয়ারীর সহযোগিতা নেন। তিনি মোবাইল ফোনে ঢাকার মোজাম্মেল হোসেন বাহারের পরিবার ও নারায়ণগঞ্জের টিকুর সাথে কথা বলে মধ্যস্থতার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে তার সহযোগিতা নিয়ে স্বামী জাহাঙ্গীর আলমকে তার হাত থেকে মুক্ত করতে পারলেও ছেলেকে পারেননি। পরে গত ২০ জুন নির্যাতনের মুখে শাওন ১১ তলার পাইপ বেয়ে নেমে এসে স্থানীয় লোকজনের কাছে আশ্রয় পায়। তারা ‘৯৯৯’ নাম্বারে পুলিশের কাছে ফোন দিলে পুলিশ উদ্ধার করে নিয়ে যায় শাওনকে। বর্তমানে সে আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে।
হাসপাতালে শাওনের পাশে থাকা জাহাঙ্গীর আলম কালু শুক্রবার বিকেলে মোবাইল ফোনে জানান, নির্যাতনের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে মামলা দায়েরের পর তিন জনকে আটক করা হয়েছে। তাদেরকে রিমান্ড আবেদন করা হয়েছে। তিনি জানান, এখনো মোজাম্মেল হোসেন বাহারের লোকজন তাকে ফোনে হুমকি-ধমকি দিচ্ছে। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শাওন সাংবাদিকদের জানায়, ঢাকার ওই বাসায় পাঁচজন থাকতো। সবাই আমাকে মারধর করতো। একবার তাদের একটি স্যুটকেসের চাবি হারিয়ে যায়। তাদের ধারণা আমি চাবিটি চুরি করে টাকা নিয়েছি। এজন্যে কখনও আমাকে রড দিয়ে কখনও বৈদ্যুতিক ক্যাবল দিয়ে পেটাতো। একবার ইলেক্ট্রিক শকও দেয়। রড দিয়ে পিটিয়ে আমার পায়ের তালুও থেতলে দেয়া হয়।
স্যুটকেসের চাবি হারানের ঘটনায় তাকে হুমকি দেয় তারা। বলে ‘২০ তারিখের মধ্যে টাকা ফিরিয়ে না দিলে তোকে আগের মতো ইলেক্ট্রিক শক দেবো। গ্রামে লোক পাঠিয়ে তোর বাবাকে ধরে আনবো’। গৃহকর্তা মোজাম্মেল হোসেন বাহারের শ্যালক মোঃ ইকবালের এমন হুমকি-ধমকিতে মৃত্যুভয় প্রবেশ করে ১২ বছরের শিশু জাহিদুল ইসলাম শাওনের ভেতর। এ কারণে গত ২০ জুন আশ্রিত বাড়ি থেকে পালানোর সিদ্ধান্ত নেয় সে। তবে অ্যাপার্টমেন্ট থেকে বাড়িওয়ালা আর দারোয়ানের চোখ ফাঁকি দিয়ে বের হওয়া মুশকিল। তাই সন্ধ্যার পর বাথরুমে প্রবেশ করে ভ্যান্টিলেটর দিয়ে বের হয়ে প্লাস্টিকের পাইপ বেয়ে ১১তলা থেকে নিচে নেমে আসে সে। এলাকাবাসীর চিৎকার-চেঁচামেচিতে টের পেয়ে যান গৃহকর্তা মোজাম্মেল হোসেন বাহার। এসে শাওনকে গার্ডরুম আটকে মারধর শুরু করেন। বিষয়টি টের পেয়ে স্থানীয় একজন তাকে উদ্ধার করে।
শাওন জানায়, গত ৭ মাসে তাকে নানা কারণে নির্যাতন করা হতো। পুরো শরীরে রয়েছে নির্যাতনের দাগ। এক দিনের জন্যেও তাকে পড়ালেখার জন্যে বলেনি। অথচ এই জন্যে মাদ্রাসা থেকে সকল কাগজপত্র এনে দিয়েছিলো তার বাবা।  সে জানায়, আমাকে ঢাকায় পড়াশোনা করানোর কথা বলে আনা হয়। কিন্তু পড়াশোনা তো দূরের কথা, দিন-রাত ঘরের কাজ করতে বাধ্য করা হয়। প্রতিদিনের বাজার থেকে শুরু করে এমন কোনো কাজ নেই যা আমাকে দিয়ে করানো হয়নি। কাজের বিনিময়ে আমাকে কোনো টাকা দেয়া হতো না। একদিন দিলুরোড থেকে কাঁচাবাজার কিনে আনার পর আমাকে অনেক মারধর করা হয়। তামান্না আমাকে বলতো, গত সপ্তাহে কম দামে তরকারি এনেছিস্, এবার বেশি কেনো? বল্ কত টাকা মারছস্? শাওন জানায়, গৃহকর্তার ভায়রা তানজিলুর ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে চাকুরি করছে। সেও এই কথা শুনে বাড়ি ফিরে আমাকে অনেক মারে। চাবি হারানোর পর একদিন বলে, ১০ হাজার টাকা পাচ্ছে না, আরেকদিন বলে ২০ হাজার টাকা পাচ্ছে না। প্রতিদিনই আমাকে টাকার জন্যে মারধর করতো। ইকবাল একদিন সবাইকে ডেকে আমাকে ইলেক্ট্রিক শক দেয়। টাকা চুরির কথা স্বীকার না করলে আবারো শক দেয়ার হুমকি দেয়। আমি ভয়ে বলি যে, আমিই টাকা চুরি করেছি। ওই ঘটনার কয়েকদিন পর ইকবাল নিজেই স্যুটকেসের চাবি খুঁজে পায়। এরপর আর কিছু বলেনি। মারধরের ওই ঘটনার পর আমি মাঝে মাঝে ফোনে বাবার সঙ্গে কিংবা গ্রামের লোকজনের সঙ্গে কথা বলতাম। তখন আমি যাতে নির্যাতনের কথা না বলতে পারি সেজন্যে সবসময় আমার সামনে বসে থাকতো তানজিলুর। একদিন ফোনে কথা বলার আগে ছুরি এনে আমার গলায় ধরে রাখে। আমি যদি ফোনে মারধরের বিষয় বাড়িতে জানাই, তাহলে আমাকে হত্যা করবে বলে হুমকি দেয়। আমি ভয়ে বাড়িতে কিছুই বলিনি। রোজার শেষের দিকে তারা আমার বিরুদ্ধে আড়াই লাখ টাকা চুরির অভিযোগ আনে। যদিও আমি চুরি করিনি। ২০ জুনের মধ্যে টাকা ফিরিয়ে না দিলে আমাকে মারধর করবে আর বাবাকে পুলিশে ধরিয়ে দেবে বলে তারা হুমকি দেয়।
    এ ঘটনার ব্যাপারে মোবাইল ফোন কথা হয় রুবেল খাঁর সাথে। তিনি জানান, চুরির কথা শুনে তিনি চেষ্টা করেছেন তা নিরসনের। পরে তিনি জানতে পারেন শাওনকে নির্যাতনের কথা। এ সময় তিনি জাহাঙ্গীর আলমকে হুমকি দেয়ার কথা অস্বীকার করেন।
    ঢাকার রমনা মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ কাজী মাইনুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, শিশু গৃহকর্মী শাওন নির্যাতনের ঘটনায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করেছে (মামলা নং ৫৩)। রমনা মডেল থানার এসআই মোশাররফ হোসেন বাদী হয়ে এ মামলা করেন। আটক তিনজনকে মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন। আর শিশু শাওনের সুস্থতার জন্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
    ঘটনাস্থলে উপস্থিত হওয়া রমনা থানার এসআই মোশাররফ হোসেন সাংবাদিকদের জানান, আমি তাকে উদ্ধার করতে গেলে তারা আমাকে ভুল তথ্য দেয়। নির্যাতনের শিকার শিশুকে চোর বলে আটকে রাখে। পরে বাড়িতে থাকা তিনজনকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করলে তারা মারধরের কথা স্বীকার করে। শিশুটির হাতে-পায়ে, পায়ের তালুতে ও পিঠে নির্যাতনের দাগ রয়েছে। তাকে চিকিৎসার জন্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
    পুলিশের রমনা জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) এইচএম আজিমুল হক সাংবাদিকদের জানান, আসামীরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নির্যাতনের বিষয়টি স্বীকার করেছে। মামলা দায়ের করা হয়েছে। ওই ঘটনায় আরও যারা যারা পলাতক আছে তাদেরও গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।

সূত্র : চাঁদপুর কণ্ঠ