বিএনপি-জামায়াতকে চাপে রাখতে আ.লীগের কৌশল
৫ জানুয়ারি চার বছরে পা দিচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত বিএনপি-জামায়াতবিহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। সে সময় সমালোচনা হলেও পরিস্থিতি এখন অনেকটাই ক্ষমতাসীন দলের অনুকূলে। তার পরও বর্ষপূতি উপলক্ষে সরকারবিরোধী জোট যাতে কোনো ধরনের ‘বিশৃঙ্খলা’ সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য এখন থেকেই হার্ডলাইনে থাকবে আওয়ামী লীগ। চলতি মাস থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত টানা তিন মাস বিএনপি-জামায়াতকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকরা।
আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক নেতা জানান, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, বিএনপির জোটসঙ্গী জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের আটক, বিভিন্ন জেলায় ছাত্রদল, যুবদলের নেতাদের আটক সবকিছুই একই পরিকল্পনার অংশ। ৫ জানুয়ারিকে ঘিরে আবার সারা দেশে তাণ্ডব চালানোর একটা ছক কষছে বিএনপি-জামায়াত ও সরকারবিরোধীরা। মূলত তাদের পরিকল্পনা নস্যাৎ করতেই এ কৌশল হাতে নেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনীহা জানিয়ে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীর এক সদস্য বলেন, রাজনীতি এখন পুরোটাই আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া চিকিৎসার নামে লন্ডনে বসে ষড়যন্ত্র করবে আর আমরা দেশে বসে একের পর এক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করব, তা হয় না। উল্টো বিএনপি-জামায়াত এখন দৌড়ের ওপর থাকবে।
দলটির আরেক প্রভাবশালী নেতা বলেন, চলতি বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচন কেন্দ্র করে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা বিশ্বের দেশগুলোর নেতিবাচক মনোভাব ছিল আমাদের সম্পর্কে। কিন্তু আগস্টের পর থেকে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়ে, তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়ে শেখ হাসিনা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হয়েছেন। এবারের জাতিসংঘের অধিবেশনে বিশ্বের প্রায় সব দেশ রোহিঙ্গা ইস্যুতে শেখ হাসিনার সাহসী ভূমিকার প্রশংসা করেছে।
আওয়ামী লীগের ওই নেতারা আরো বলেন, ছুটিতে যাওয়া প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে দিয়ে সরকারবিরোধী চক্ররা দেশে একটি ঝামেলা পাকাতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রধান বিচারপতি ছুটিতে যাওয়ায় তাদের সেই সাধ পূরণ হয়নি। শুধু তাই নয়, লন্ডনে বসে বাংলাদেশে সরকারের উৎখাতের আরও একাধিক পরিকল্পনা করেন খালেদা জিয়া। সরকারের নীতিনির্ধারকদের তৎপরতায় তাদের সেই প্রচেষ্টাও আপাতত নস্যাৎ করা গেছে। সামনের দিনে যাতে এ ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়, সে জন্য এখন থেকেই অনেকটা হার্ডলাইনে থাকবে আওয়ামী লীগ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দুদিন থেকেই জামায়াত-বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু হয়েছে সারা দেশে। বিরোধী শিবিরের রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘিরে কঠোর অবস্থান নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সোমবার রাতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে জামায়াতের আমির, সেক্রেটারিসহ কেন্দ্রীয় আট নেতাকে। তাদের ১০ দিনের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে। পরদিন মঙ্গলবার চট্টগ্রামে ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক লেবার দলের সভাপতি মোস্তাাফিজুর রহমান ইরানকে দলীয় একটি অনুষ্ঠান থেকে আটক করার পর ছেড়ে দেওয়া হয়। পৃথক কর্মসূচি থেকে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের অন্তত ৩০ নেতাকর্মীকে আটকের কথা জানিয়েছে চট্টগ্রাম বিএনপি।
বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, কেন্দ্র ঘোষিত কর্মসূচি পালন করতে গিয়ে গত মঙ্গলবার গ্রেপ্তার হয়েছেন দলটির অর্ধশতাধিক নেতাকর্মী। এ ছাড়া বিভিন্ন জেলায় জামায়াতের বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কুমিল্লার আদালতে গত সোমবার বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর সারা দেশে কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি। এসব কর্মসূচি ঘিরে কঠোর অবস্থান নিয়েছে সরকার। জামায়াত নেতাদের গ্রেপ্তার ও রিমান্ডের প্রতিবাদে আজ সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল আহ্বান করেছে দলটি।
আওয়ামী লীগের নেতারা জানিয়েছেন, জামায়াতের এই হরতাল দেশের মানুষ মানে না। হরতালের মধ্যেই বৃহস্পতিবার ঢাকার বাইরে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিতে যাবেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ।
জামায়াতের হরতালের বিষয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, বৃহস্পতিবার জামায়াতের ডাকা হরতাল সহিংস রূপ নিলে উপযুক্ত জবাব দেওয়া হবে। জামায়াতের হরতাল সহিংস রূপ নিলে জবাবও হবে সে রকম। তাদের সহিংসতার কোনো পজিটিভ রেজাল্ট (ইতিবাচক ফল) নেই।
ধরপাকড়ের অভিযোগ অস্বীকার করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, বিএনপির কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। জামায়াতের যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল বলে পুলিশ কমিশনার আমাকে জানিয়েছেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেছেন, নেতাকর্মীদের দলীয় কর্মকা- থেকে দূরে রাখতেই সারা দেশে ধরপাকড় শুরু হয়েছে। জামায়াতের পক্ষ থেকেও একই অভিযোগ করা হয়েছে। দলটির নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেন, জামায়াতকে নেতৃত্বশূন্য করার যে প্রক্রিয়া সরকার শুরু করেছে, এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নামে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ‘আক্রোশমূলক’ ও ‘গভীর ষড়যন্ত্রমূলক’ মন্তব্য করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, মহাজোট সরকার কোনো সমালোচনা, বিরোধিতা বা প্রতিবাদ সহ্য করতে পারে না। সে কারণে তারা দেশে কোনো বিরোধী দল রাখতে চায় না। দেশের ‘ব্যাপক জনপ্রিয় নেত্রী’ খালেদা জিয়াকে প্রধান প্রতিপক্ষ মনে করে বলেই তার বিরুদ্ধে একের পর এক ‘হয়রানিমূলক মামলা’ দিয়ে বিপর্যস্ত করার ব্যর্থ চেষ্টায় লিপ্ত সরকার।
তবে কুমিল্লায় বাসে পেট্রলবোমার মামলায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির ঘটনায় কোনো রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র নেই বলে মন্তব্য করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। তিনি বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সরকারের নয়, আদালতের। এখানে কোনো রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র নেই।