জবাব দিলেন পররাষ্ট্র সচিব
রোহিঙ্গা ইস্যুতে পররাষ্ট্র নীতির ভূমিকা নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান বা টকশোতে সমালোচনার জবাব দিয়েছেন পররাষ্ট্র সচিব মো.শহীদুল ইসলাম। মঙ্গলবার বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজে আয়োজিত এক গোলটেবিল বৈঠকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির পূর্ণ ব্যাখা দিয়েছেন তিনি।
রোহিঙ্গা সমস্যাকে বাংলাদেশ কিভাবে দেখে, বিদেশিরা কিভাবে দেখে,বাংলাদেশের নীতি কী, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা কী এবং এর দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের পথ বিষয়ে তিনি বিস্তারিতভাবে আলোকপাত করেন।
তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যা নানাভাবে দেখা যায়। আমরা এটিকে বহুমাত্রিক ও বহুস্তরবিশিষ্ট জটিল একটি সমস্যা হিসাবে দেখছি।এরমধ্যে মানবিক বিপর্যয়, সীমান্ত সমস্যা ও নিরাপত্তা ইস্যু জড়িত। এ বিষয়ে আমরা অনেক আগে থেকেই কাজ করছি।
রোহিঙ্গা নীতি
পররাষ্ট্র সচিব বলেন,বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই এ ইস্যুতে ফোকাস করেছে।কেবিনেটে রোহিঙ্গা ইস্যুতে দুইবার আলোচনা হয়েছে।২০১২ সালে মন্ত্রিসভায় প্রথম রোহিঙ্গা নিয়ে আলোচনা হয় এবং সিদ্ধান্ত হয় এটি নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও কাজ করবে এবং একটি কৌশলপত্র তৈরি করে কেবিনেটে উপস্থাপন করবে।
২০১৩ এর সেপ্টেম্বরে আমরা কৌশলপত্র তৈরি করে মন্ত্রিসভায় জমা দেওয়ার পরে এটি নিয়ে আলোচনার পর তা গৃহীত হয় এবং গেজেট প্রকাশিত হয়।২০১৩ সালে করা এই কৌশলপত্রে পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান আছে।এর মধ্যে প্রথমে আছে বাংলাদেশে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের জরিপ করা হবে, তাদের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে হবে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত ব্যবস্থাপনা জোরদার, মিয়ানমার সরকারের সঙ্গে আলোচনা এবং জাতীয় পর্যায়ে সমন্বয় কমিটি গঠন।
তিনি বলেন, এই কৌশলপত্র অনুযায়ী এরইমধ্যে ২০১৬ সালের আগে আসা রোহিঙ্গাদের জরিপ শেষ হয়ে গেছে এবং জাতীয় এবং জেলা পর্যায়ের সমন্বয় কমিটি ২০১৩ সাল থেকে কাজ করে যাচ্ছে।
নতুন সমস্যা নয়
তিনি বলেন,রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্য নতুন নয়।এর আগে ১৯৭৮-৭৯, ১৯৯১-৯২, ২০১২ এবং ২০১৬ সালে তাদের ওপর নির্যাতনের কারণে তারা পালিয়ে এসেছে। এ কারণে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দীর্ঘদিন থেকে এ বিষয়ে কাজ করছে।
২০০৮-০৯ সাল থেকে যখন আমরা এ বিষয় নিয়ে কাজ করছিলাম তখন আমরা বিষয়টি দ্বিপক্ষীয়ভাবে সমাধান করতে চেয়েছিলাম।সেই সময়ে আমরা আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে বলেছিলাম,রোহিঙ্গা সমস্যা যেকোনও সময়ে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে।
আমরা এখনও মনে করি, নিরাপত্তা ইস্যুতে এ সমস্যার বিস্ফোরণ হওয়ার সম্ভাবনা আছে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা
গত বছরের শেষদিকে আমাদের বিশ্লেষণ এবং গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বলা হয়,রোহিঙ্গা সমস্যা আরও গুরুতর আকার ধারণ করতে পারে। আমরা দীর্ঘ বিশ্লেষণ করে আমাদের এখন কী করা উচিৎ সে অনুযায়ী একটি প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর বিবেচনার জন্য এ বছরের জানুয়ারিতে পাঠাই।
সেই প্রতিবেদন পড়ে প্রধানমন্ত্রী আমাদের কিছু সুপারিশ গ্রহণ করেছেন এবং কিছু সুপারিশ নাকচ করে বলেছেন,এগুলোর এখনও সময় আসেনি।
প্রধানমন্ত্রী তার নির্দেশনায় নিজ হাতে লিখেছেন, টিক চিহ্ন দেওয়া বিষয়গুলি সতর্কতার সঙ্গে বিবেচনা করা যেতে পারে। বন্ধুত্ব বজায় রেখে সমাধানের পথ খুঁজতে হবে এবং প্রতিবেশী দেশ হিসাবে আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কারণে আমরা যেমন একদিকে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বজায় রাখা এবং অন্যদিকে,রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টা নেওয়ার মধ্যে একটি ভারসাম্য তৈরি করতে পেরেছি।এটি একটি বিশাল কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ।একটি দেশের বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে এবং একইসঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে হবে।
বহুপাক্ষিক যোগাযোগ
পররাষ্ট্র সচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পরে আমরা দ্বিপক্ষীয় প্রচেষ্টার পাশাপাশি গোপনে বহুপাক্ষিক যোগাযোগ শুরু করি। এটা কেউ জানতো না। গত বছরের অক্টোবরের পর ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসার ফলে আমরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি এবং বহুপাক্ষিক যোগাযোগের মাত্রা বাড়িয়ে দেই।
আমরা সেসময় দেখলাম, মিয়ানমার একটি মিথ্যা প্রচারণা চালাচ্ছে যে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশ থেকে সেখানে গিয়েছে।তারা বাংলাদেশি সন্ত্রাসী এবং রাখাইনে সমস্যা তৈরি করছে। সেই প্রচারণার কপি যেকোনও কারণে হোক তারা জাতিসংঘে আমাদের মিশনেও পাঠায়।সেটা দেখে আমরা বুঝতে পারি তারা একটি শক্ত অবস্থান নিতে যাচ্ছে।
বর্তমান সময়ে (গত ২৫ আগস্ট থেকে) রোহিঙ্গাদের নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা শুরু হওয়ার আগেই বিদেশি বন্ধুদের কাছে আমরা আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করে বলেছিলাম এ অঞ্চলটি অস্থিতিশীল হতে পারে। এর ফলে এখানে নতুন করে রোহিঙ্গা নির্যাতন শুরু হওয়ার পর বিদেশি বন্ধুদের গোটা বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হয়েছে।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে অবস্থান
এবারের জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁ প্রথমবারের মতো রাখাইনের ঘটনাটিকে ‘গণহত্যা’ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।এটি থেকে ইউরোপীয়দের ধ্যান-ধারণারও প্রতিফলন পাওয়া যায়। আগামী ১৬ অক্টোবর ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে মিয়ানমার বিষয়ে একটি শক্ত রেজ্যুলেশন আসবে বলে আমরা আশা করি। এরমধ্যে ইইউ তাদের বাণিজ্য প্রতিনিধিদলের মিয়ানমার সফর এবং ওই দেশের সঙ্গে জিএসপি প্লাস দরকষাকষি স্থগিত করেছে। এটি একটি বিরাট বড় ঘটনা।
জাতিসংঘ সাধারণ অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণ শুরু করেছেন রোহিঙ্গা ইস্যু দিয়ে। শুধু তাই নয়,সেখানে তিনি পাঁচ দফা প্রস্তাব করেছেন।আমরা প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব জাতিসংঘে জমা দিয়েছি।
আমরা থেমে যাইনি
রোহিঙ্গা ইস্যুতে পররাষ্ট্রনীতির ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক আরও বলেন, আমরা এখানে থেমে যাইনি। আমরা জাতিসংঘে আমাদের যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছি। গতকাল সোমবার জাতিসংঘে আমাদের স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন রোহিঙ্গা ইস্যুর বর্তমান অবস্থা জানিয়ে জাতিসংঘে মহাসচিব অ্যান্তনিও গুয়েতেরেস ও নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ জন সদস্যকে চিঠি দিয়েছেন। মিয়ানমার বলেছিল ৫ সেপ্টেম্বর থেকে রাখাইনে অভিযান বন্ধ আছে কিন্তু এখনও সেখানে নির্যাতন চলছে এবং এ বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদের দায়িত্ব মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে ওই চিঠিতে।
তিনি বলেন, ‘অনেকে বলেন চীন, ভারত ও রাশিয়ার সঙ্গে অনেক কিছু করা দরকার।
তাদের উদ্দেশে বলতে চাই,আমরা দুই বছর আগে থেকে এসব দেশের সঙ্গে এ বিষয়ে যোগাযোগ রাখছি। দুই বছর আগে আমরা একটি নন-পেপার তৈরি করেছিলাম ব্যাক্সটার রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে।১৯৪০ সালে ব্যাক্সটার কমিশন রোহিঙ্গাদের ওপর একটি রিপোর্ট তৈরি করেছিল যেখানে বলা হয়েছে,রোহিঙ্গারা রাখাইনে যুগের পর যুগ ধরে বাস করছে। এই নন-পেপার আরও অনেক দেশকে দেওয়া হয়েছে। সামনের দিনগুলিতে আরও কিছু দেখতে পাবেন।
পররাষ্ট্র সচিব এই আলোচনার ইতি টানেন সমস্যার সমাধানকে ‘দীর্ঘমেয়াদি’ হিসেবে উল্লেখ করে। তিনি বলেন, ‘এই ধরনের সমস্যার সমাধান দীর্ঘমেয়াদি হয়ে থাকে। আমাদের এখানে গত তিন দশক ধরেই এই প্রক্রিয়া চলে আসছে। আরও সময় লাগবে।’