আন্তর্জাতিক সংস্থায় চিঠি রোহিঙ্গাদের শরণার্থী বলা যাবে না
রোহিঙ্গারা শরণার্থী নয় বাস্তুচ্যুত। নিজ দেশে হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তারা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও উগ্র মগরা তাদের সহায়-সম্পদ লুটে নিয়ে বাস্তুচ্যুত করেছে। এ অবস্থায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় নেয়নি। বাস্তুচ্যুত হয়ে প্রাণ বাঁচাতে সীমান্ত ডিঙ্গিয়ে বাংলাদেশে এসেছে। বাংলাদেশ সরকারও মানবিকতার চূড়ান্ত শিখরে পৌঁছে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে স্ব-ইচ্ছায় অনেকেই আশ্রয় নিয়েছে। যারা শরণার্থী। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ক্ষেত্রে বিষয়টি সম্পূর্ণ উল্টো। তাদের রাখাইন ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে।
রক্তগঙ্গা পেরিয়ে মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে দেশত্যাগ করতে হয়েছে। অথচ তাদের জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা শরণার্থী হিসাবে উল্লেখ করছে। বিষয়টি বাংলাদেশ সরকারের নজরে আসায় জাতিসংঘসহ ওইসব আন্তর্জাতিক সংস্থাকে চিঠি দিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। চিঠিতে রোহিঙ্গাদের ‘বাস্তুচ্যুত’ উল্লেখ করতে বলা হয়েছে। একইসঙ্গে কেন তারা শরণার্থী নয় তারও ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গেল সপ্তাহে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে তারা আলাদাভাবে নোট ভারবাল (অনানুষ্ঠানিক পত্র) পাঠিয়েছে। ওই নোট ভারবালে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ‘শরণার্থী’ শব্দের বদলে ‘জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিক’ বলার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে সব আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে পররাষ্ট্র সচিবের ডিও লেটার পৌঁছে দেয়া হয়েছে। এদিকে গত ২রা অক্টোবর মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিবসহ কয়েক জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে আধা সরকারি পত্র (ডিও লেটার) দিয়েছে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক। ওই ডিও লেটারে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থায় পাঠানো চিঠির বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবগত করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ‘ভলান্টারি রিপ্রেট্টিয়েশন’ ছাড়া শরণার্থীদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করার সুযোগ নেই। এছাড়া শরণার্থীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে উৎস রাষ্ট্রে তাদের পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আবশ্যক। এসব দিক বিবেচনা করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭২তম অধিবেশনে দেয়া ভাষণে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ‘জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিক’ (ফোর্সিবলি ডিসপ্লেলসড মিয়ানমার ন্যাশনালস) হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, পর্যাপ্ত হিসাবনিকাশ ও গবেষণা করেই বাংলাদেশ এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। মিয়ানমার থেকে আসা এসব মানুষকে শরণার্থী মর্যাদা দেয়া হচ্ছে না। কারণ এ মর্যাদা দিলে জাতিসংঘের গাইডলাইন অনুযায়ী বেশকিছু সুযোগ-সুবিধা দেয়ার বিষয় রয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য অতিরিক্ত চাপ হবে। আর ‘জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত’ মিয়ানমারের নাগরিক বলার মাধ্যমে এ জাতিটিকে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্য বা জাতিগতভাবে নির্মূল করার জন্য সেখানকার আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যে অত্যাচার চালিয়েছে, তা প্রতীয়মান হয়। একই সঙ্গে জাতিগত নির্মূল অভিযানে জড়িত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের আন্তর্জাতিক আদালতে গণহত্যার মতো স্পর্শকাতর মামলায় বিচারের সুযোগও রয়েছে। ফলে সবদিক বিবেচনা করে এ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে।
মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের শরণার্থী হিসেবে চিহ্নিত করছে জানিয়ে তিনি আরো বলেন, মিয়ানমার এখন তাদের শরণার্থী হিসেবে চিহ্নিত করতে চাইছে। ভবিষ্যৎ বিচারের সম্ভাবনাকে ঠেকাতে তারা রোহিঙ্গাদের এ পরিচয় দেয়ার চেষ্টা করছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের পরিচিতি শনাক্তে অবস্থান পরিবর্তন করা হয়েছে। সেপ্টেম্বর মাসে রোহিঙ্গাদের ‘অনিবন্ধিত মিয়ানমারের নাগরিক’ বলা হলেও ২৫শে আগস্টের পর থেকে আসা রোহিঙ্গাদের ‘জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক’ হিসেবে চিহ্নিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
এদিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বার্তা পেয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, একই মন্ত্রণালয়ের সচিব শাহ কামালসহ সরকারের দায়িত্বশীল মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সচিবসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা রোহিঙ্গাদের বলছেন ‘জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিক’।