• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • সোমবার, ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫ পৌষ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যাকাণ্ডের নতুন তথ্য প্রকাশ করলো এইচআরডব্লিউ

প্রকাশ:  ০৪ অক্টোবর ২০১৭, ১৮:০০
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
প্রিন্ট

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের মং নু গ্রামে বেশ কিছু রোহিঙ্গা মুসলমানকে দেশটির সেনাবাহিনী পিটিয়ে, ছুরিকাঘাতে হত্যা করেছে। সেইসঙ্গে নারীদের ওপর চালানো হয়েছে যৌন নির্যাতন। তবে ঠিক কতজনকে হত্যা করা হয়েছে তা বলতে পারেনি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। গত ২৭ আগস্ট এই হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

স্থানীয় একটি আবাসিক কম্পাউন্ডে আশ্রয় নিলে তাদের ওপর সেনাবাহিনী ওই হত্যাকাণ্ড চালায় বলে প্রত্যক্ষদর্শীদের বরাত দিয়ে নতুন এ তথ্য উপস্থাপন করেছে এইচআরডব্লিউ। এর দুইদিন আগে দেশটির কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলা চালায় রোহিঙ্গাদের অধিকার নিয়ে কাজ করা আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আমির (আরসা) সদস্যরা। এতে ১২ জন নিরাপত্তা কর্মী নিহত হয় বলে দাবি মিয়ানমারের।

ওইদিন মং নু (স্থানীয় নাম মনু পাড়া) ও পার্শ্ববর্তী হপং থ পিন (স্থানীয় নাম পন্ডু পাড়া) গ্রামে যে নৃশংসতা চালানো হয় স্যাটেলাইট চিত্র বিশ্লেষণ করে তা প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। এতে বোঝা যায়, গ্রাম দুটি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে।

সংস্থাটির এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ফিল রবার্টসন বলেছেন, মং নু গ্রামে বার্মিজ (মিয়ানমারের অপর নাম) আর্মি মানবতা তথা রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে ভয়াবহতা চালিয়েছে তা থেকে গণহত্যার প্রমাণ পাওয়া যায়। মিয়ানমারের চলমান ইস্যুতে যারা উদ্বিগ্ন, ভয়ংকর এই অপরাধের বিরুদ্ধে তাদের আরো সোচ্চার হওয়া দরকার বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

রাখাইনের গণহত্যার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কোনো ব্যবস্থা নিতে বিগত আট বছরের মধ্যে গত ২৮ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ বৈঠকে বসে। কিন্তু কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত ছাড়াই তা শেষ হয়।

কিন্তু হিউম্যান রাইট ওয়াচ তাদের প্রতিবেদনে আবারো নিরাপত্তা পরিষদ ও সংশ্লিষ্ট দেশসমূহকে (যারা এ ব্যাপারে সোচ্চার) মিয়ানমারের সংশ্লিষ্ট সেনা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা কিংবা সম্পদ বাজেয়াপ্তের মতো পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এ ব্যাপারে বেঁচে যাওয়া এবং মং নু ও অবরুদ্ধ চিন থা মার গ্রামের ১৪ জনের সঙ্গে কথা বলেছে

বর্তমানে বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া ওই প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, চেকপোস্টে বিদ্রোহীদের হামলার পরই তাদের মধ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্বিচার হত্যার আতঙ্ক কাজ করতে শুরু করে। আর এই আতঙ্ক থেকেই কয়েকশ রোহিঙ্গা মং নুর ওই আবাসিক কম্পাউন্ডে জড়ো হয়। এরপর বার্মার কিছু সেনা সদস্য ওই এলাকা ঘিরে ফেলে এবং কিছু সেনা ভেতরে ঢুকে পড়ে। এরপর তারা বেশ কিছু রোহিঙ্গা পুরুষ ও বালককে বাইরে নিয়ে যায় এবং গুলি ও ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। এ ছাড়া যারা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তাদেরও হত্যা করা হয়। তারপর সেনারা লাশগুলো, কোনো কোনো প্রত্যক্ষদর্শী বলেছেন একশ বা তার বেশি, তাদের গাড়িতে করে নিয়ে যায়।

প্রসঙ্গত, ২৫ আগস্ট চেকপোস্টে হামলার ঘটনার পর মিয়ানমার সেনাবাহিনী ও স্থানীয় বৌদ্ধদের শুরু হওয়া নৃশংসতার শিকার হয়ে এ পর্যন্দ ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে।

বাহু ও পিঠে গুলি লাগা ১৫ বছর বয়সী রোহিঙ্গা মোহাম্মাদ উসমান বলেন, তীব্র গুলির শব্দে তার ঘুম ভাঙে। যখন তাদের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয় তখন তিনি ও গ্রামের অন্যরা পালাতে শুরু করেন। কিন্তু এতো অন্ধকার ছিল যে, কে গুলি করছে তা বোঝা যায়নি। তিনি বলেন, ‘আমরা পালিয়ে অন্য গ্রামে চলে যাই। এ সময় বৃষ্টির মতো বুলেট পড়ছিল এবং আমার চারপাশে লোকজন লুটিয়ে পড়ছিল। হঠাৎ আমি বুঝতে পারি, আমার বাহু ও পিঠে কিছু আঘাত করেছে। এরপর আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। এরপর জ্ঞান ফিরে দেখি আমি অন্যজনের বাড়িতে।’

মিয়ানমার সরকারের দাবি, তলোয়ার, আগ্নেয়াস্ত্র ও বোমা নিয়ে শতাদিক বিদ্রোহী ওই হামলায় অংশ নেয়। এতে দুইজন পুলিশ অফিসার ও দুই বিদ্রোহী নিহত হয়। এ ছাড়া আরসার সদস্যরা আরো অনেক অপরাধের ঘটনা ঘটিয়েছে বলে দেশটির দাবি। কিন্তু এইচআরডব্লিউ বলেছে, উত্তর রাখাইনে প্রবেশের অনুমতি না থাকায় তারা সরকারের দাবির বিষয়টি খতিয়ে দেখতে পারেনি।

মোহাম্মাদ জুবায়ের নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী ও নৌকার মালিক বলেন, সেনাবাহিনীর গোলাগুলি বন্ধের পর সেনাবাহিনী একটি বড় নৌকা জব্দ করে নিয়ে যায়। ৫৬৪ ব্যাটালিয়নের স্টাফ সার্জেন্ট বাজু নৌকাটি জব্দ করে জানিয়ে তিনি বলেন, এরপর নৌকায় যেসব লাশ তোলা হয় তার বেশিরভাগই রোহিঙ্গা যুবকের।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বাজু নামের ওই সেনা কর্মকর্তা ওই এলাকায় প্রায় ১৫ বছর ধরে থাকে এবং রোহিঙ্গাদের ভাষা আয়ত্ব করে। ঘটনার দিন সে ওই আবাসিক কম্পাউন্ডে প্রবেশ করে রোহিঙ্গা ভাষায় আশ্রয় নেওয়াদের বাইরে আসতে বলে এবং জানায় যে, তারা যদি বাইরে আসে তাহলে তাদের হত্যা করা হবে না।

যারা পালিয়ে আসতে সক্ষম হন বা পাহাড়ের ওপর থেকে ঘটনা প্রত্যক্ষ করেন তারা জানান, রোহিঙ্গা পুরুষ ও যুবকদের কম্পাউন্ড থেকে বের করে এনে তাদের পেছন থেকে হাত বেঁধে ফেলে এবং পিটিয়ে, ছুরিকাঘাত ও গুলি করে হত্যা করে।

আব্দুল জব্বার (৬০) নামের এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, সেনারা তাদের হত্যার আগে উপুর করে বন্দুকের বাট দিয়ে পেটাতে থাকে এবং বার বার লাথি মারতে থাকে। এরপর তাদের গুলি করে হত্যা করে।

মোহাম্মাদ আইয়াস (২৯) বলেন, তিনি দেওয়ালের ফাঁটলে লুকিয়েছিলেন এবং দেখেন, সেনারা গণহত্যা চালাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘তারা এমনভাবে হত্যা করছে যেমন লম্বা ও ধারালো ছুরি দিয়ে জঙ্গল কাটা হয়।’

মুহাম্মেদুল হাসান (১৮) বলেন, স্টাফ সার্জেন্ট বাজুর নেতৃত্বে এক ডজন সেনা তাকে ও তার দুই আত্মীয় মোহাম্মাদ জোবায়ের ও ফয়েজকে ওই কম্পাউন্ডে ধরে নিয়ে যায়। হাসান বলেন, তারা যাওয়ার পর দেখেন, কয়েকশ পুরুষ ও বালককে বেঁধে রাখা হয়েছে। 
তিনি বলেন, ‘চারজন সেনা আমাকে ও আমার দুই আত্মীয়কে একটি কোণায় নিয়ে যায় এবং প্রত্যেককে পেছন থেকে দুটি করে গুলি করে। আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। যখন আমি জ্ঞান ফিরে পাই তখন দেখি, অনেক লোককে বেঁধে রাখা হয়েছে এবং তাদের হত্যা করা হচ্ছে। অনেককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়েছে। আমি পালানোর চেষ্টা করি, কিন্তু আবারো আমার বুকে গুলি করা হয়। তবে আমি পালাতে সক্ষম হই।’ ওইদিন তার অন্তত ৩০ জন আত্মীয়কে হত্যা করা হয়।

প্রত্যক্ষদর্শীরা শিশু হত্যারও বর্ণনা দিয়েছেন। খোতাইয়াজ নামের ২৮ বছর বয়সী এক নারী বলেন, ‘ওই সময় আমার ভাতিজা তোফায়েল (১০) ছিল। বাজু যখন ওই ঘরে প্রবেশ করে তখন তোফায়েলের মাথায় গুলি করে। এতে দ্বিতীয় শ্রেণির ওই শিক্ষার্থীর মাথার খুলি চার ভাগ হয়ে যায়। এরপর সে পড়ে যায়। আমি দেখেছি, তার মস্তিষ্ক ও রক্ত মাটিতে পড়ে আছে।’

মুস্তাফা (২২) বলেন, ‘১২ বছরের মধ্যে ১০ থেকে ১৫টি শিশুর লাশ আমি দেখেছি। আমি তাদের চারজনকে চিনতে পেরেছি। তারা হলো-হাকিম আলি (৯), নাইম (৮), পন্ডু পাড়ার একটি শিশু যার বয়স ১০ এবং চাউ মং (৭)।

এ ছাড়া প্রত্যক্ষদর্শীরা নারীদের যৌন হয়রানির বিষয়ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচকে বলেছেন।

খোতাইয়াজ বলেন, তারা ওই কম্পাউন্ডে প্রবেশ করে নারীদের কাপড়-চোপড় খুলে ফেলে এবং তাদের কাছে যেসব মূল্যবান সম্পদ ছিল তা নিয়ে নেয়।

৩০ বছর বয়সী এক নারী বলেন, এক সেনা তার বুকের ভেতর হাত ধুকিয়ে দেয় এবং মোবাইল ফোন ও টাকা নিয়ে নেয়। এরপর সে তার শরীরের নিচের অংশের কাপড় খুলে ফেলে এবং লুকানো সোনা ও টাকা নিয়ে নেয়।

রবার্টসন বলেন, বিদ্রোহীদের হামলার দোহাই দিয়ে বার্মিজ সেনারা বিচার ও শাস্তির দায় এড়াতে পারে না। জাতিসংঘের উচিত এসব নৃশংসতা এবং যেসব সেনা কর্মকর্তা এসব সহিংসতার নিদের্শ দিয়েছেন বা জড়িতদের বিচারের আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়েছেন তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করা।