ভারতের সঙ্গে ৩৬ হাজার কোটি টাকার ঋণচুক্তি বুধবার
বাংলাদেশকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩৬ হাজার কোটি টাকা) ঋণ দেবে ভারত। এটি ভারতের লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) নামে পরিচিত। এর আগেও এলওসির আওতায় দুইবার ঋণ দিয়েছে ভারত। এটি হবে তৃতীয় ঋণ। এ অর্থ দিয়ে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, তথ্যপ্রযুক্তি, অবকাঠামোসহ ১৭টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ভারতের অর্থমন্ত্রী অরুণ জেটলি তিনদিনের সরকারি সফরে মঙ্গলবার বাংলাদেশে আসছেন। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, এর পরদিন বুধবার সকাল ১০টায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে এ চুক্তি অনুষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ইআরডির সচিব কাজী শফিকুল আযম ও ভারতের সংশ্নিষ্ট দফতরের কর্মকর্তারা নিজ নিজ পক্ষে এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করবেন। অনুষ্ঠানে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং অরুণ জেটলির উপস্থিতে দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট আলোচনা হবে। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গেও তার সাক্ষাতের কথা রয়েছে। এরপর ৫ অক্টোবর যৌথ সংবাদ সম্মেলন হবে। ওইদিনই ঢাকা ছাড়বেন তিনি।
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, চুক্তি সই হওয়ার পর পর্যায়ক্রমে প্রকল্পভিত্তিক ঋণ চুক্তি হবে। অর্থছাড় হবে এর পর। তৃতীয় ধাপের ঋণের শর্ত আগের দুটির মতোই হবে। প্রস্তাবিত ঋণের সুদ হার হবে ১ শতাংশ। পাঁচ বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ (শুধু আসল পরিশোধ) ২০ বছরে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে। প্রস্তাবিত ঋণের অর্থে প্রকল্পের শতকরা ৭৫ ভাগ কেনাকাটা করতে হবে ভারত থেকে। বাকি ২৫ ভাগ জোগান দেবে বাংলাদেশ সরকার। প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে ভারতের মনোনীত ঠিকাদারি কোম্পানি। ভারত সরকারের পক্ষে ঋণ দেবে সে দেশের এক্সিম ব্যাংক।
তবে ঋণের সুদহার কম হলেও প্রকল্পের শতকরা ৭৫ ভাগ কেনাকাটা ভারত থেকে করতে হবে এমন কঠিন শর্তের ঋণ নেয়াকে নিরুৎসাহিত করছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, টেন্ডার ছাড়া ভারত থেকে ৭৫ ভাগ জিনিসপত্র কেনাকাটায় প্রকল্পের ব্যয় বেড়ে যাবে। তাই তারা সরকারকে পাইপলাইনে আটকে পড়া সহজ শর্তের প্রায় তিন হাজার ২০০ কোটি ডলার ঋণ ছাড়ে উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা ড. মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, আমি সবসময় বলছি এগুলো তো হচ্ছে মোটামুটি সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট। এসব ঋণে আপাতত দৃষ্টিতে দেখা যাবে সুদের হার হয়তো খুব একটা বেশি না। কিন্তু ভারত থেকে অধিকাংশ জিনিসপত্র কিনতে হবে। কেনার সময় কোনো টেন্ডার হবে না এর ফলে তো জিনিসের দাম বেশি হবে। এতে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যাবে। এর মানে হচ্ছে, আমি সুদের হার কম নেব কিন্তু জিনিসপত্রে দাম বেশি নিয়ে সুদের হারের বিষয়টি পুষিয়ে নেব।
তিনি আরও বলেন, এ ধরনের ঋণ নেয়ার ক্ষেত্রে আমি খুব একটা পক্ষপাতি না। এ চুক্তি করে আমাদের তেমন লাভ হবে না। পাইপলাইনে আটকেপড়া সহজ শর্তের প্রায় তিন হাজার ২০০ কোটি ডলার পড়ে আছে, আমরা ব্যবহার করতে পারি না। এসব সহজ শর্তের ছাড় করা গেলে এবং যথাযথভাবে ব্যয় করতে পারলে এ ধরনের ঋণ নেওয়ার দরকার নেই। তাছাড়া ভারতের এটা তৃতীয় ঋণ চুক্তি হতে যাচ্ছে। প্রথমটাই মনে হয় এখন পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি। দ্বিতীয়টাও খুব সামান্য ব্যবহার হয়েছে। কাজেই খামাখা একটার পর একটা চুক্তি করে দায়বদ্ধতা বাড়ানোর তো কোনো অর্থ হয় না।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশকে এলওসির মাধ্যমে ঋণ দিতে শুরু করে ভারত। প্রথমে ১০০ কোটি ডলার ঋণচুক্তি হয়। পরে ওই ঋণের ২০ কোটি ডলার অনুদান হিসেবে দেয় ভারত। ২০১৫ সালের দ্বিতীয় এলওসিতে ঋণচুক্তি হয় ২০০ কোটি ডলারের। চলতি বছরের এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরের সময় ৫০০ কোটি ডলারের তৃতীয় এলওসির ঘোষণা দেয় ভারত। প্রথম দুটি এলওসির ২৯ প্রকল্পের মধ্যে বাস, ট্রাক, ট্রেনের ইঞ্জিন, বগি, ড্রেজারসহ বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি কেনার প্রকল্পই বেশি। এ ছাড়া রেলসেতু ও রেললাইন নির্মাণ সংক্রান্ত কয়েকটি প্রকল্প রয়েছে। তৃতীয় এলওসিতে বড় অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প বেশি।
ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, ভারতের প্রথম এলওসির ১৫ প্রকল্পের মধ্যে বারোটির কাজ শেষ হয়েছে। গত সাত বছরে এসব প্রকল্পের বিপরীতে ৩৭ কোটি ৬০ লাখ ডলার ছাড় করেছে ভারতীয় এক্সিম ব্যাংক। প্রথম এলওসির আওতায় ৮৬ কোটি ২০ লাখ ডলার ঋণ দেয়ার কথা। ওই এলওসির তিনটি প্রকল্পের কাজ এখনও চলমান। প্রথম এলওসির পর এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে আরও দুটি এলওসি চুক্তি করেছে বাংলাদেশ। দ্বিতীয় এলওসির ১৪ প্রকল্পের বারোটিতে চূড়ান্ত অনুমোদন দিয়েছে ভারত। তবে প্রকল্পগুলোর মাঠ পর্যায়ের কাজ এখনও শুরু হয়নি। অন্যদিকে শেষ বা তৃতীয় এলওসির জন্য বাংলাদেশের তরফে ১৭ প্রকল্প বাছাই করা হয়েছে। এসব প্রকল্প যাচাই-বাছাই করতে সম্প্রতি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ‘নেগোসিয়েশন মিটিং’ করে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)।
ওই বৈঠকে যেসব প্রকল্প নেয়া হয়েছে সেগুলোর অন্যতম হচ্ছে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ অন্য স্থানে নেয়ার অবকাঠামো উন্নয়ন, বুড়িগঙ্গা রিভার রেস্টোরেশন প্রজেক্ট, চট্টগ্রাম বন্দরে কন্টেইনার টার্মিনাল নির্মাণ, পায়রা বন্দরের টার্মিনাল নির্মাণ, বগুড়া থেকে সিরাজগঞ্জ পর্যন্ত দ্বৈতগেজ রেলপথ নির্মাণ, সৈয়দপুর বিমানবন্দর উন্নত করা, ফরিদপুরের ভাঙ্গা থেকে বেনাপোল পর্যন্ত মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করা, চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ের বারইয়ারহাট থেকে খাগড়াছড়ির রামগড় পর্যন্ত সড়ক চার লেনে উন্নীত করা, মীরসরাইয়ে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে এক লাখ এলইডি বাল্ব সরবরাহ, ঈশ্বরদীতে রেল ও সড়ক পথের জন্য আইসিডি নির্মাণ, মংলায় ১০০ মেগাওয়াট সৌরবিদ্যুত প্রকল্প, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের তরল বর্জ্য শোধনাগারের যন্ত্রপাতি ক্রয় এবং কুমিল্লা থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহর হয়ে সরাইল পর্যন্ত চার লেন সড়ক নির্মাণ প্রকল্প।