• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • মঙ্গলবার, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

অ্যাসিডে ঝলসে যাওয়া জেসমিন এখন অনুপ্রেরণার নাম

প্রকাশ:  ০৮ মার্চ ২০২২, ১৪:১৭ | আপডেট : ০৮ মার্চ ২০২২, ১৪:২০
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

২০০০ সালের অক্টোবরের ঘটনা। এসএসসির প্রস্তুতির জন্য স্কুলে প্রি-টেস্ট পরীক্ষা চলছিল। এর মধ্যে দুটি বিষয়ে পরীক্ষা হয়েছিল। পরের দিন (২৫ অক্টোবর) ছিল তৃতীয় পরীক্ষা। তবে সেদিন পরীক্ষার হলে যেতে পারেননি জেসমিন আক্তার। ওই রাতে অ্যাসিডে ঝলসে গিয়েছিল তার শরীর। ভেবেছিলেন আর কখন বেঁচে ফেরা হবে না। প্রথমে শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে রাজধানীর বনানীতে অবস্থিত অ্যাসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশনে নেওয়া হয়। সেখানে টানা দুই বছর চিকিৎসার পরে ফেরেন বরিশালে। তবে ফেরেনি বাম চোখের দৃষ্টিশক্তি। 

২২ বছর ধরে নিয়মিত চিকিৎসা আর সামাজিক তিরস্কারের শিকার হতে হয়েছে জেসমিনকে। তার ভাষায়, ফুল ফোটার আগেই যদি ছিড়ে ফেলা হয়, তাহলে তো সেই ফুল কখনোই সৌরভ ছড়ায় না। আমার জীবনটাও তেমন। তিন মাসে ছয়বার অস্ত্রোপচার আর দুই বছরের চিকিৎসার পর যখন বরিশাল ফিরলাম, তখন হাতেগোনা কিছু লোক ছাড়া সকলেই আড় চোখে তাকাতেন। উপহাস করতেন নষ্ট মেয়ে বলে। ঝলসে যাওয়া শরীরের বিভৎসতা দেখে নিজেই আঁতকে উঠতাম। অসহনীয় কষ্ট, অপমানবোধ আর উপহাসের গ্লানি থেকে বাঁচতে সিদ্ধান্ত নিই আত্মহত্যার। তবে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের নির্মোহ ভালোবাসা আর মায়া বাধ্য করে সেই চিন্তা থেকে সরে আসতে।

সিদ্ধান্ত নিই চারপাশের সমাজ আর জীবনের সঙ্গে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার। সব কিছু শেষ হয়ে যাওয়া থেকে আবার ঘুরে দাঁড়ানোর যুদ্ধে নামি। তিলে তিলে নিজেকে গড়ে তুলি সমাজের অবহেলিত আর সহিংসতার শিকার নারীদের স্বজন হিসেবে।

২২ বছরের ব্যবধানে ঝলসে যাওয়া জেসমিন এখন এগিয়ে চলার উৎসাহ, অনুপ্রেরণার নাম। নির্যাতনের শিকার জেসমিনকে মঙ্গলবার (০৮ মার্চ ২০২২) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে শ্রেষ্ঠ সাহসী নারী হিসেবে জাতীয় পুরস্কার তুলে দেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দিপু মনি।

কিন্তু কী এমন কারণ ছিল জেসমিনকে অ্যাসিডে ঝলসে দেওয়ার? প্রশ্ন করতেই কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে তার। ফিরে যান ২২ বছর আগে। তিনি বলেন, বড় ভাই জসিম খানের সঙ্গে একটি মোটরসাইকেল নিয়ে বিরোধ ছিল সোহেল প্যাদার। জসিমের সঙ্গে না পেরে ২০০০ সালের ২৫ অক্টোবর রাত ৩টার দিকে ঘরের জানালা থেকে অ্যাসিড ছুড়ে মারে আমার দিকে।

জেসমিন বলেন, প্রথমে বুঝতে পারিনি কী পড়েছে আমার গায়ে। আমি চিৎকার করতে করতে আব্বার রুমে যাই। পরে হাসপাতালে যখন আমাকে নেওয়া হলো তখন জানতে পারি অ্যাসিড নিক্ষেপ করা হয়েছে। ঘটনার পরে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারব এমন চিন্তা করতেই পারিনি। আমি ভেবেছি জীবন শেষ।

এই ঘটনার পর সোহেল প্যাদার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় আদালত। তবে জেসমিন মনে করেন, বিচার তিনি এখনো পাননি। কারণ টাকা দিয়ে মামলার তদন্ত ঘুরিয়ে দিয়েছিল আসামিরা। প্রতিবেদনে ছয়জন আসামির মধ্যে প্রধান অভিযুক্ত তিনজনকে করা হয়েছে সহযোগী আর সহযোগীদের করা হয়েছিল প্রধান অভিযুক্ত।

কান্নায় ভেঙে পড়ে জেসমিন বলেন, আমার মতো অনেক নারী আছেন যারা বিচার পান না। বাংলাদেশের বিচার সর্ম্পকে সবাই জানেন। এটি নতুন করে বলার কিছু নেই।

দেশে নারীদের নির্যাতন করার পরে অপরাধী আসলে অভিযুক্ত হন না, উল্টো সমাজের লোক বলে মেয়েটা খারাপ ছিল। এজন্য তার সঙ্গে এমন করা হয়েছে। নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বলেন, ২০০০ সালে মানুষ অনেক ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে থাকত। এখন কিছুটা কমেছে, কিন্তু সমাজ থেকে সেইসব ভ্রান্ত ধারণা আজও যায়নি। তখন ক্লাসে যেতে পারতাম না, বাইরে বের হতে পারতাম না। সবাই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলত, ওই মেয়েটাকে অ্যাসিড মারা হয়েছে। মেয়েটি খারাপ না হলে এমন করত না। হাজার প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। সেই মানসিক যন্ত্রনা আসলে স্বাভাবিক মানুষ বুঝবে না। 

ওই বছর আর পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ ছিল না। পরের বছর পুনরায় লেখাপড়ায় ফিরি। তবে স্কুলে ফিরে আর আগের পরিবেশ পাইনি। সবাই আমার দিকে করুণার দৃষ্টিতে তাকাত, খারাপ মেয়ে বলে মনে করত। 

সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি বদল হওয়া উচিত উল্লেখ করে বলেন, একজন মেয়ে যখন নির্যাতনের শিকার হন, তখন তাকেই দোষী সাব্যস্ত করার চেষ্টা করে আমাদের সমাজ। অথচ উচিত নির্যাতনের শিকার নারীকে সহায়তার হাত বাড়ানো।

অ্যাসিড নিক্ষেপের বিভীষিকার পরে যখন আমি বিধ্বস্ত তখন পরিবার থেকে অনেক উৎসাহ পেয়েছি। আমি আবার লেখাপড়া শুরু করি। প্রথমে পড়তে অনেক কষ্ট হতো। এক চোখে অনেকক্ষণ তাকানো যেত না। তারপরও কষ্ট করে ২০০৩ সালে এসএসসি, ২০০৫ সালে এইচএসসি পাস করি। ২০০৬ সালে পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়। তারপরও থেমে থাকিনি। অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে টিউশনি করে অর্থ উপার্জন শুরু করি। 

২০০৭ সালে একটি বেসরকারি ব্যাংক সেলাই ও লক মেশিন প্রদান করে। সেই মেশিন দিয়ে বাবার বাসার ছাদে একটি রুমে কাজ শুরু করি। এখন পর্যন্ত প্রশিক্ষণ নিয়ে ১৫ জন নারী স্বাবলম্বী হয়েছেন। প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন মোট ৩৫ জন। ২০১৭ সালে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশে কর্মজীবনের শুরু হয়। ২০১৮ সালে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) ওয়ার্ডের দায়িত্ব পালন করি। ২০১৯ সালে যুক্ত হই অ্যাসিড সারভাইভার্স সর্ম্পকিত সংগঠন সেতুবন্ধন নেটওয়ার্ক গড়তে। ঢাকা, বরিশাল, সাতক্ষীরা, সিরাজগঞ্জ, পটুয়াখালী ও দিনাজপুর জেলার সভাপতির দায়িত্ব পালন করি। 

শুধু তাই নয়, জেসমিন আক্তার প্রথ্যাত ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেলের তত্ত্বাবধায়নে ইংল্যান্ডে অনুষ্ঠিত বিউটি রেডিফিউশন প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে তৃতীয় স্থান অধিকার করেন। তিনি স্বামীর সঙ্গে বরিশাল নদীবন্দর এলাকায় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালু করেন। সেখানে দুজন কর্মচারী কাজ করেন।

জেসমিন আক্তার বলেন, আপ্রাণ চেষ্টায় আমি এখন ভালো আছি। এক ছেলে এক মেয়ে আর স্বামী নিয়ে আমার সংসার। তবে আমার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার ২২ বছর পরও মেয়েকে নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় আছি। সব সময়ে আতঙ্কে থাকি। কারণ সমাজ পাল্টায়নি আর মানুষগুলোও বদলায়নি। 

তিনি জানান, বিয়ের আগে-পরে কখনো আমার স্বামী আমাকে কটু কথা শোনাননি। আসলে সব পুরুষ খারাপ না। আমার বাবাও তো পুরুষ। পুরুষ আর হিংস্র পুরুষ এক নয়। আমার লড়াইটা হিংস্র পুরুষের বিরুদ্ধে।

বরিশালের জেলা প্রশাসক জসীম উদ্দিন হায়দার বলেন, জেসমিন আক্তার নানা প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। আজ তিনি একজন সফল মানুষ। তিনি সমাজের জন্য অনুপ্রেরণা। ১৩ ফেব্রুয়ারি মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের আয়োজনে অনুষ্ঠিত জয়িতা অন্বেষণে বাংলাদেশ অনুষ্ঠানে শ্রেষ্ঠ জয়িতা পদে পুরস্কৃত করা হয়েছে তাকে। বিভাগীয় কমিশনার স্যার এই পদক তুলে দেন।

সর্বাধিক পঠিত