কীভাবে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের পথশিশুরা?
আমি তখন আরো ছোট ছিলাম। আমার বাবা নেই। মা আরেক জায়গায় বিয়ে করেন। তাই আমাদের পাঁচ ভাইবোনের দেখার কেউ ছিল না। একটা মেয়ে শিশু বলছিল কীভাবে সে পথ-শিশুতে পরিণত হল - সেই গল্পটা।
সে বলছিল, "আমার মা আমার মামার কাছে দিয়ে যায় আমাদেরকে। মামা আমার এক ভাইকে দত্তক দিয়ে দেয়। আর আমাদের বাকি চারজনের আর ভরন-পোষণ করতে পারেনি। আমরা একবেলা খেতে পেতাম আরেক বেলা পেতাম না। এভাবেই আমরা একসময় ক্ষুধার জালায় রাস্তায় নামছি।"
আর কথা বলতে পারছিলো না মেয়েটি। কান্না আটকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো সে। শুধু এই শিশুটি একা নয়। এরকম কয়েক লক্ষ শিশু এখন ঢাকা শহরের বিভিন্ন রাস্তায় দিন কাটাচ্ছে।
তাদেরকে দেখতে পাওয়া যায় লঞ্চ-টার্মিনাল,রেলওয়ে-স্টেশন, বাস-স্ট্যান্ড, ওভারব্রিজ এবং শহরের নানা সড়কে। এসব শিশুদের দেখলে প্রথমেই প্রশ্ন জাগে কীভাবে হয় তাদের খাদ্যের যোগান?
এর একটা দৃশ্যমান উত্তর - বেশিরভাগ শিশুই ভিক্ষাবৃত্তির সাথে জড়িত। কিন্তু সারাদিন যদি ভিক্ষাও করে সেটার পুরোটা কি তারা পায়? একটি শিশু বলছিলো সে ভিক্ষা করে কিন্তু নিজের ইচ্ছায় না, তাকে বাধ্য করা হয়।
সে বলছিলো, "আমারে বড় ভাইয়েরা বলে তুই ভিক্ষা কর, তো যা লাগে বাকিটা রেখে আমারে দিয়ে দিবি। এখন আমি সারাদিন সকাল থেকে ভিক্ষা করি। কিন্তু দিন শেষে আমাকে কিছুই দেয় না। আমি একটা টাকাও রাখতে পারি না। আমি তো জানি না এইটা খারাপ কাজ।"
এতো গেলো ভিক্ষাবৃত্তির কথা। এইসব পথ-শিশুরা জড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে।
বেসরকারি সংগঠন অ্যাকশন এইড সম্প্রতি একটি প্রতিবেদনে বলছে, ঢাকায় আড়াই লাখের মত পথ শিশু রয়েছে।
সংগঠনটির কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির বলছিলেন, ভিক্ষা ছাড়াও চুরি, ছিনতাই এবং মাদকের ব্যবসা এদের দিয়ে করানো হচ্ছে।
তিনি বলছিলেন "ভিক্ষা করানোর পিছনে একটা মাফিয়া কাজ করছে। এবং এটা একটা ব্যবসা। তারা এই শিশুদেরকে বিভিন্নভাবে এক্সপ্লয়েট করছে। এদের দিয়েই চুরি, ছিনতাই, ইয়াবার মত মাদক বিক্রি করাচ্ছে।"
"আমাদের একবার শাসানো হলো (আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে) পথ-শিশুদের নিয়ে যেন আমরা কাজ না করি। আপনার কাছে নাটক, সিনেমার মত মনে হবে কিন্তু আমরা কাজ করতে যেয়ে দেখেছি যে কিভাবে এই শিশুদের অব্যবহার করা হচ্ছে। এসব শিশুরা একটা সহজ টার্গেট এসব অপরাধী চক্র গুলোর জন্য।"
তিনি বলেন, "তবে মেয়ে শিশুরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে। তাদের উপর যে শারীরিক এবং যৌন নির্যাতন হয় সেটা নিয়ে আমরা বেশি আতঙ্কগ্রস্ত।"
জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ ২০১৪ সালের এক হিসেবে বলছে ৬,৭৯,৭৫৪জন পথ-শিশু রয়েছে সারা দেশে। শিশুদের পথ-শিশু হওয়ার কারণ মূলত কয়েকটি রয়েছে।
অ্যাকশন এইড বলছে এর একটি গ্রামে দরিদ্রতা বেড়ে যাওয়া, গ্রাম থেকে শহরে মানুষ চলে আসছে কাজের খোঁজে। অনেক শিশু পরিবারের সাথে ঢাকায় এসেছে তারপর পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে।
'যৌনকর্মী হতে বাধ্য হচ্ছে পথ শিশুরা'
"কাজ না করলে কেও টাকা দিবে না। মন না চাইলেও এই কাজ করতে বাধ্য হয়েছি বা তাদের সাথে গিয়েছি," বিবিসি বাংলাকে এমনটাই বলছিল আরেক শিশু।
সে জানাচ্ছিল, "যখন ঐ জিনিসটা হয়ে যেত আমি বুঝতেও পারতাম না আমার সাথে কি হয়ে গেল। তারপরে আমি বুঝতে পারতাম আমার সাথে আসলে কি হয়েছে,তখন আমার খুব খারাপ লাগে।"
"একটা লোক আমার চারপাশে ঘোরাফেরা করছে আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আমি যে আরেকজনের কাছে আশ্রয় নেব সেই আশ্রয় দেয়ার কেউ নেই।"
কিভাবে অনেক সময় এমন কাজে বাধ্য হতে হয় সে বিষযে বলছিল, "এটা এমন একটা ব্যাপার যেটা কাওকে বলা যায় না, তাই অনেক সময় জোরপূর্বক রাজি হয়ে যায় বা আমার করার কিছু থাকে না।"
'চুরি-ছিনতাই, মাদক বিক্রি'
ছেলে শিশুদের দিয়ে চুরি, ছিনতাই এবং মাদক বিক্রির মত কাজ করানো হচ্ছে। একটা শিশু বলছিল তাকে দিয়ে চুরি করানোর কাজ করা হয়।
এসব বিক্রির আগে ইয়াবাসহ অন্যান্য নেশা দ্রব্য খাইয়ে দেয় তার ভাষায় তার 'বড় ভাইয়েরা'।
সে বলছিল, "আমারে দিয়ে চুরি করায়। বলে ঐখান থেকে মোবাইল চুরি করবি, ওখান থেকে পকেট-মারবি, ঐ বাসার স্যান্ডেল চুরি করবি এইসব।"
প্রশ্ন:কখনো ধরা পড়েছো?
উত্তর:পড়ছি ,অনেক মাইর খাইছি কিন্তু আলাপ(টের)পাইনি
প্রশ্ন:কেন?
উত্তর:আমারে যেসব খাওয়াইয়া দেই এরপর মাইর দিলে আলাপ পাই না। আমি দেখা গেছে দুই/তিন দিন এরপর ঘুমিয়ে থাকি।
আরেকজন শিশু বলছিল কিভাবে তাকে দিয়ে ইয়াবা বিক্রি করানো হয়।
শিশুটি বলছি, "আমারে বাবা(ইয়াবা),গাঁজা আরো সব খারাপ জিনিস খাওয়াইয়া দেয়। আমার পকেটে ৫/৬টা ইয়াবা দিয়ে বলে এগুলো বিক্রি করবি তাহলে কিছু টাকা পাবি। ২০০ টাকা করে বিক্রি করি প্রতি পিস। ৫টা বিক্রি করলে ১০০০ টাকা হয়। আমারে দুই/তিনশ টাকা দেয়। বাকিটা তারা নিয়ে নেয়।"
সরকারি-বেসরকারি প্রকল্প
বাংলাদেশে পথ-শিশুদের দেখা-শোনা করার জন্য সরকারি-বেসরকারি ভাবে বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে।
কয়েক স্থানে তৈরি করা হয়েছে পথ-শিশুদের জন্য হোম বা আশ্রয়কেন্দ্র। ঢাকার কারওয়ানবাজারে এবং কমলাপুরে দুটি সরকারি হোম রয়েছে শিশুদের জন্য। যেখানে তাদের থাকা এবং খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়।
কারওয়ানবাজারে পথ-শিশুদের জন্যে একটি হোমে গিয়ে এই প্রতিবেদক দেখতে পান সেখানে ছোট একটা স্থানে গাদাগাদি করে প্রায় একশোর মত শিশু রয়েছে।
দুপুরের সময়- খাবার দেয়া হবে তাদের। তাই তাদের সংখ্যাটাও একটু বেশি। এসব শিশুরা রাতে ঘুমাতে আসে, আর খাওয়ার সময় আসে। বাকি সময়টা তারা বাইরে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করে।
কামরুননাহার রতœা এই সেন্টারের চাইল্ড প্রটেকশন কলসালটেন্ট হিসেবে কাজ করছেন।
এই হোম শিশুদের কতটা নিরাপদ আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে পারছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলছিলেন, "শিশুদের নিয়ে বিভিন্ন স্থানে কাজ করছে এনজিও, সরকার-এসব তথ্য অপরাধ চক্রগুলো জানে। তারা খুব স্ট্রংলি তাদের মোটিভেট করে যে শেল্টারে গেলে রগ কেটে দেয়, রক্ত নেয় এমন অদ্ভুত সব কথা।
কারণ হিসেবে তিনি বলেন, "শিশুরা যদি শেল্টারে আসে তাহলে তাদের ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা অনেক শিশুর কাছে এমনটা শুনেছি। যারা এসব কথা বলে এবং আসতে চায় না।"
"শিশুদের বাইরে বের করে নেয়ার বহু চেষ্টা তারা করে আর নানা ধরণের অবৈধ কাজে যুক্ত করায় আর এই হোম গুলো উন্মুক্ত।" সেখানে কাউকে সারাক্ষণ থাকতে বাধ্য করা হয় না বলে তিনি জানান।
বাংলাদেশের সরকারের মহিলা এবং শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় এর রয়েছে পথ-শিশু পুনর্বাসন কার্যক্রম ।
সেখানে রয়েছে পথ-শিশুদের জন্য দুটি সেন্টার। যা শুধুমাত্র ঢাকায়। কিন্তু সারাদেশে আরো কয়েক লাখ যে পথ-শিশু রয়েছে তাদের জন্য কি ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার। আমি কথা বলেছিলাম এই কার্যক্রমের পরিচালক ড.আবুল হোসেনের সাথে।
মি. হোসেন বলছিলেন, "৫ বছর মেয়াদি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। সারাদেশে ১৯টি শেল্টার হোম তৈরি করা হবে। তবে তারা যে অপরাধে জরিয়ে যাচ্ছে সেটা আমাদের দেখার বিষয় না। আমাদের কাজ তাদের মোটিভেট করা। আমরা সেটা করছি। আমাদের মোবাইল টিম আছে যারা বিভিন্ন স্থানে যেয়ে শিশুদের মধ্যে সেই কাজটি করছি"।
বাংলাদেশ পুলিশের মুখপাত্র সহেলী ফেরদৌসে বলছিলেন, "পথ-শিশুদের ব্যাপারে আমরা অত্যান্ত সচেতন। তাদেরকে কারা অপরাধে জরাচ্ছে এটার জন্য আমরা নিজস্ব সোর্স ব্যবহার করছি"।
বাংলাদেশে লাখ লাখ পথ শিশুদের নিরাপদ থাকার স্থানের যেমন অভাব রয়েছে তেমনি রয়েছে অপরাধে জড়িয়ে পরার সম্ভাবনা।
যদিও পুলিশ বলছে তারা নিজেদের সোর্স ব্যবহার করছে অপরাধী চক্রকে ধরার ব্যাপারে। কিন্তু শিশুরা যে প্রতিনিয়ত বাধ্য হয়ে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে সেটার ব্যাপারে ব্যবস্থা নেয়ার দায় কারো মধ্যে দেখা যায়নি। সূত্র: বিবিসি বাংলা।