ডাকাতনামা
একটা সময় ছিলো বাংলার মায়েরা তার অবুঝ শিশু সন্তানকে ঘুম পাড়াতেন নানা কল্পকাহিনী শুনিয়ে। কুজো বুড়ির গল্প, চাঁদ মামার গল্প এবং ডাকাতের ভয় দেখিয়ে। দেশে এখন সে সময়ের পুনরাবৃত্তি ঘটছে। এখন হয়তো মায়েরা তাদের শিশু সন্তানদের সেভাবেই ঘুম পাড়াতে হবে। কারণ বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে দেশের অনেক তরুণ তাজা রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করেছে। এতে দেশের শিক্ষার্থীসহ সাধারণ মানুষের মনে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছে গত ১৫-২০ দিনে। ছাত্রদের এক দফা দাবির প্রেক্ষিতে ৫ আগস্ট ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ আওয়ামী সরকারের পতন এবং শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ আন্দোলনের সমাপ্তির পূর্ণতা দিয়েছে। জেনারেশন জেড এবং তরুণ ছাত্র জনতার এক দফা দাবি বাস্তবায়ন এবং দেশের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের চলছে অব্যাহতি ও পদত্যাগের হিড়িক। দায়িত্ব নিয়েছেন নোবেল জয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ দেশের সুশীল ও প্রগতিশীল অনেকে। অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং আরো সতের জন উপদেষ্টা শপথ নেয়ার পরে। অন্তবর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কঠোর হাতে দেশ গঠনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। ৫ আগস্টের পর বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী কর্মবিরতীতে যাওয়ার পর দেশে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খুব একটা স্বাভাবিক নেই।
এমতাবস্থায় দেশে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর পাশাপাশি আপামর জনতা নিজেদের সুরক্ষার জন্য প্রতিরোধ করে তুলেন। পাড়া-মহল্লা সম্প্রীতি ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থেকে বাঁচতে দিন-রাত পাহাড়ায় ব্যস্ত। তারপরও গুজবের কোনো কমতি নেই। কারণ এই গুজবের মূল কাজ জনমনে আবেগ ও আতঙ্ক তৈরি করা। আতঙ্ক ও আবেগের বশবর্তী হয়ে বেশির ভাগ মানুষ যাচাই-বাছাই না করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই শেয়ার বাটনটি চেপে ধরে বলছেন ডাকাত ডাকাত আবার কেউ কেউ পোস্ট করছেন অমুক এলাকায় ডাকাত ঢুকেছে সবাই সাবধান হোনে। এতে কেউ কেউ মনে করে, গুজবের পোস্টটি শেয়ার দিয়ে অন্যদের গুজবটি সম্পর্কে সতর্ক করবে আর এতেই এটি আরও বেশি ছড়িয়ে পরে। কিন্তু বাস্তবে প্রতিরোধ না হয়ে আসলে হয় তার উল্টো, পোস্টটিই বেশির ভাগ মানুষ দেখবে, আবেগের কাছে ক্যাপশন পড়ার ধৈর্য হারিয়ে যায় দ্রুতই। দেখে দেখে তিনিও লিখে দেন অমুক এলাকায় ডাকাত পড়েছে, সবাই সাবধান হোন।
একটা স্বাধীন দেশে এক দিনে এত প্রাণহানি মানা যায় না। যাঁরা ক্ষমতায় আছেন, তাঁরা রক্তগঙ্গার ওপর কত দিন থাকবেন? তাঁরা ব্লেম গেম (দোষারোপের খেলা) আর কত দিন খেলবেন?
সরকার ভুলের পর ভুল করে যাচ্ছে। বর্তমান পরিস্থিতি সরকারের ভুলের কারণে হয়েছে, এটা তাদের স্বীকার করতে হবে। শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ-ছাত্রলীগকে লেলিয়ে দেওয়া হলো।
এখন বলা হচ্ছে দাবি মেনে নিয়েছি, গণভবন খুলে দিয়েছি। বিশ্বের সব দেশেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঐক্য থাকে। তাদের এত লোক, এত ভাই মারা গেছে। সরকার ক্ষমতায় থাকলেও পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে, সেটি তাদের চিন্তা করতে হবে। আবার কেউ কেউ ছোটবেলার সেই কবিতার মতো শুরু করে দেন--
সন্ধে হল,সূর্য নামে পাটে
এলেম যেন জোড়াদিঘির মাঠে ।
ধূ ধূ করে যে দিক পানে চাই
কোনোখানে জনমানব নাই,
তুমি যেন আপনমনে তাই
ভয় পেয়েছ; ভাবছ, এলেম কোথা?
আমি বলছি, ‘ভয় পেয়ো না মা গো,
ঐ দেখা যায় মরা নদীর সোঁতা ।’
চোরকাঁটাতে মাঠ রয়েছে ঢেকে,
মাঝখানেতে পথ গিয়েছে বেঁকে ।
গোরু বাছুর নেইকো কোনোখানে,
সন্ধে হতেই গেছে গাঁয়ের পানে,
আমরা কোথায় যাচ্ছি কে তা জানে,
অন্ধকারে দেখা যায় না ভালো ।
তুমি যেন বললে আমায় ডেকে,
‘দিঘির ধারে ঐ যে কিসের আলো!’
এমন সময় 'হাঁরে রে রে রে রে’
আর এভাবেই তখন পাড়া-মহল্লার মানুষ শুরু করে দেন ডাকাত খোজার কাজে। কোনো কোনো এলাকায় রাত ১০টা থেকে শুরু করে দেন ডাকাত ঢুকেছে সবাই সাবধান হোন। এটিও ছড়াতে থাকে বিদ্যুৎ গতিতে চলতে থাকে রাত ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত। কিন্তু কেউ ডাকাত খুঁজে পেলে না। এরপর অনেকে উৎেকণ্ঠার মধ্যে পড়ে শুরু করে চারদিকে ফোন দেওয়া। এছাড়াও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেন কোথায় ডাকাত পরেছে। বেশ কিছু এলাকার মসজিদের মাইকে ইমাম সাহেবরা ঘোষণা দিতে থাকেন-প্রিয় এলাকাবাসী, সবাই সাবধান হোন, এলাকায় ডাকাত ঢুকেছে, এলাকায় ডাকাত ঢুকেছে সকলে সাবধান হোন, কেউ ঘরের লাইট বন্ধ করবেন না। আপনারা জেগে থাকুন। মুহূর্তেই এ ঘোষণায় পুরো এলাকার মধ্যে তোলপাড় চলতে থাকে। নিকটাত্মীয় যারা আছেন তাদেরকেও ফোন করে কেউ সহায়তা চান আবার সাবধান করেন। বিষয়টি নিয়ে চলতে থাকে জল্পনা-কল্পনা। পরিবারের কোমলমতি শিশুদের মনে চলে অজানা আতঙ্ক--কোমলমতি শিশুরা আবার জিজ্ঞেস করে বাবা-মাকে ডাকাত দেখতে কেমন---সচেতন মা-বাবা হয়ত বলবেন, ডাকাত আমাদের মতোই, ওসব নিয়ে টেনশন করো না। আর কিছু বাবা-মা হয়তো ছোটবেলার সেই কবিতার মতো ডাকাতের বর্ণনা দিবেন---এভাবেই
হাতে লাঠি, মাথায় ঝাকড়া চুল
কানে তাদের গোঁজা জবার ফুল।
আমি বলি, ‘দাঁড়া, খবরদার!
এক পা আগে আসিস যদি আর -
এই চেয়ে দেখ আমার তলোয়ার,
টুকরো করে দেব তোদের সেরে ।
শুনে তারা লম্ফ দিয়ে উঠে
চেঁচিয়ে উঠল, ‘হাঁরে রে রে রে রে।
এভাবেই শিশুদের কোমল মনও ভয়ে কেঁপে উঠবে। তারা হয়ত বিশ্বাস করে বসবে সত্যিই ডাকাত এসেছিলো। আবার কেউ কেউ ডাকাতের কথা জেনে বাসা-বাড়িতে দাঁড়ালো দা-বটি প্রস্তুতও করে রাখেন। স্বামী-স্ত্রী মিলে ফন্দি করেন কিভাবে ডাকাত সামলাবেন। তবে শহর কিংবা গ্রাম বা পাড়া-মহল্লার কোথাও গত কদিনে ডাকাতের সন্ধান কেউ দিতে পারেনি। কিন্তু ডাকাত আতঙ্ক দিন দিন বেড়েই চলছে। পাড়া-মহলা, অফিস ও বাসা-বাড়িতে এখন একটাই আলোচনা কোন এলাকায় ডাকাত এলো কিভাবে ডাকাত দাওয়া করলো এ সব বিষয়। চায়ের স্টল কিংবা রাজনীতি যে কোনো জায়গাতেই এখন একটাই আলোচনা ডাকাত। আসলে বাস্তবে এই ডাকাতের দেখা এখন পর্যন্ত কারো সাথে মেলেনি।
তাছাড়া আমাদের ভাবতে হবে যে, একটা দেশে গণঅভ্যুত্থানের পরে অনেক শান্তিতে আছে। সাধারণ এ ধরণের গণঅভ্যুত্থানের পরে যে ধরণের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি হওয়ার কথা সেটি হয়নি। একজন গণঅভ্যুত্থানের পরে পতনের পর রাষ্ট্রব্যবস্থা ও সমাজে যে ধরনের পরিবর্তন আশা করা হয়, তা তাৎক্ষণিকভাবে অনেকে কিছু পরিবর্তন হতে পারে। আবার একটা অস্থিতিশীল পরিবেশের পর স্থিতিশীল পরিবেশ শতভাগ কার্যকর হবে, এমনটা ঘটুক। সমাজ তথা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় পরিবর্তনগুলো যদি পরিকল্পিত হয়, তাহলে তার বাস্তবায়ন আরো সহজ হয় এবং দ্রুতই সেগুলো দৃশ্যমান হয়। কিন্তু সে রকম কোনো পরিকল্পনা না থাকা যে সমস্যা, সেটা এখন প্রকটভাবে অনুভূত হতে শুরু করেছে তবে সরকার ব্যবস্থায় দৃশ্যমান পরিবর্তন সাধারণ মানুষ যতো দ্রুত আশা করছে সেটাও হয়ত হতে পারে। তবে সমসাময়িক বিষয় মানুষের মাঝে আতঙ্ক, গুজব দূর করে এগুতে কবে।
তবে আমাদের এটা ভুলে গেলে চলবে না সেই মিথ্যুক বালকের কথা--সেই বালক প্রায় বলত বাঘ এসেছে বাঘ এসেছে-তাকে উদ্ধার করতে যখন গ্রামবাসী এগিয়ে আসতো তখন সে বলতো এটা একটি ফান ছিলো। কিন্তু বাস্তবে যে দিন বাঘ এলো সেদিন শত কান্না ও চিৎকার করে আর কারো সাহায্য পেলো না। আমরা এখন সেই কথা ভাবছি ডাকাত এসেছে, ডাকাত এসেছে কিন্তু ডাকাত আসেনি। কিন্তু বাস্তবে যেদিন ডাকাত আসবে তখন সচেতন সবাইকে মনে রাখতে হবে যেনো তা প্রতিহত করা যায়।
পরিশেষে বাংলাদেশের মানুষ, রাষ্ট্রীয় সম্পদ, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সকল স্থাপনা দুষ্কৃতিকারীদের হাত থেকে মুক্তি পাক--দেশ হোক শোষণ ও বঞ্চনা মুক্ত। ডাকাত এসেছে, ডাকাত এসেছে সেটা কল্পনাতেই থাকুক, সেটা যেনো বাস্তব না হয়-এই প্রত্যাশা করছি।
লেখক : উজ্জ্বল হোসাইন, লেখক ও সংগঠক, চাঁদপুর।