• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • রোববার, ১৮ মে ২০২৫, ৪ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
  • ||
  • আর্কাইভ

চাঁদপুরে দুর্গম চর থেকে পাচার হচ্ছে বিপুল পরিমাণ জাটকা!

প্রকাশ:  ৩১ মার্চ ২০২১, ০৯:০১
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

 এবার প্রজনন মৌসুমে চাঁদপুরের মেঘনা-পদ্মায় প্রচুর পরিমাণে মা ইলিশ নিরাপদে ডিম ছাড়তে পারায় ব্যাপক হারে জাটকা বৃদ্ধি পেয়েছে। হাইমচরের চর মণিপুর ও মাঝের চরকে বলা হয় জাটকার খনি। প্রকৃত ইলিশ জেলেরা জানিয়েছেন, নদীতে ব্যাপক জাটকা বিচরণ করছে। জাল ফেললেই জালে মিলছে ঝাঁকে ঝাঁকে জাটকা। কিন্তু ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধিতে সেই জাটকা রক্ষা পাচ্ছে না।
সরকার ১ মার্চ থেকে ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত এই দুই মাস নদীতে জাটকা ইলিশসহ সকল প্রকার মাছ ধরা নিষিদ্ধ করেছে। এবারও প্রশাসনের জাটকা রক্ষা অভিযান যেমন চলমান রয়েছে তেমনি দুষ্কৃতকারী জেলেদেরও জাটকা ধরা থেমে নেই।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, প্রতিদিনই বিপুল পরিমাণ জাটকা নিধন হচ্ছে। এই জাটকা একত্রিত করে চাঁদপুর থেকে সড়ক ও নদীপথে দেশের বিভিন্নস্থানে পাচারও হচ্ছে বেশ। পর্যবেক্ষক মহলের মতে, তাহলে সরকারের আইন করে লাভ কী আর প্রশাসনের অভিযানেরই দরকার কী?
গত কয়েক দিনের পর্যালোচনায় দেখা যায়, চাঁদপুর থেকে সড়কপথে ৬/৭টি জাটকার চালান পাচারকালে জব্দ হয়েছে। গাড়িসহ লোকজনও আটক হয়েছে। সড়কপথের কিছু চালান ধরা পড়লেও নদীতে স্পীডবোট ও ইঞ্জিন নৌকায় জাটকা পাচারের চালান অনেকটাই অধরায় থেকে যাচ্ছে। মুন্সীগঞ্জে বিপুল পরিমাণ জাটকার চালান ধরা পড়ায় বেরিয়ে আসে জাটকা পাচারের রুটের খবর।
মেঘনা নদীর পুরাণবাজার হরিসভা, রনাগোয়াল, দোকানঘর রামদাসদী খাল, বহরিয়া লোধের পাড়, লক্ষ্মীপুর নন্দেশ খার খাল, গোবিন্দিয়া আখনেরহাট পুরাতন বেড়িবাঁধ ও হাইমচরের কিছু এলাকা থেকে পিকআপ গাড়িতে করে প্রচুর জাটকা পাচার করা হয়।
হরিনা নৌ ফাঁড়ি পুলিশ সোর্সের মাধ্যমে লক্ষ্মীপুর ইউনিয়ন থেকে পাচারকারী একটি চক্রের বড় একটি জাটকার চালান পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে। এরপর পুরাণবাজার ফাঁড়ি পুলিশ একে একে তিনটি জাটকার চালান পাচারকালে জব্দ করতে সক্ষম হয়। মতলব থানা পুলিশও সড়কে একটি জাটকার চালান ধরেছে। কিন্তু নদী পথে পাচার হওয়া কোনো জাটকার চালান এখনো ধরা পড়েনি।
চাঁদপুর থেকে পাচারকৃত জাটকার একটি বড় চালান মুন্সিগঞ্জ প্রশাসনের হাতে ধরা পড়ায় জাটকা পাচার রুটের খবর বেরিয়ে আসে। পাচারকালে আটক যানবাহনের লোকজন স্বীকার করেছে, চাঁদপুরের নদীর পাড়ের নির্জন স্থানে গোপনে জাটকা একত্রিত করা হয় এবং সেখানে জাটকার ক্রয় বিক্রয় হয়। এছাড়া মেঘনার পশ্চিম পাড়ে হাইমচর ও রাজরাজেশ্বর দুর্গম চরে জাটকার আড়তদারি হচ্ছে।
চাঁদপুর সদর উপজেলার বালিয়া-কমলাপুর সংযোগ রাস্তা, লক্ষ্মীপুর-দোকানঘর-রঘুনাথপুর, হরিনা-চান্দ্রা- ভাটিয়ালপুর-বাগাদি-ওয়্যারলেস, বাবুরহাট-মতলব-পেন্নাই সড়ক জাটকা পাচারের রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। অনেক সময় প্রশাসনের চোখ আড়াল করতে হাজীগঞ্জ দিয়েও পাচার হয় জাটকা। আর নদী পথে স্পীডবোট ও ট্রলার যোগে রাজরাজেশ্বর থেকে মাওয়া এবং মুন্সিগঞ্জে প্রথমে নিয়ে যাওয়া হয় জাটকার চালান, সেখান থেকে সড়কযোগে গন্তব্যে নেওয়া হয়।
নদীর পাড়ে জাটকা নেওয়ার জন্য একশ্রেণীর হকার থাকে বসে। জাটকার নৌকা আসলে মুহূর্তের মধ্যে সেখানে দাঁড়িপাল্লায় ওজন দেওয়ার পর তারা সিলভারের পাত্র এবং প্লাস্টিকের পাত্রে জাটকা বহন করে চলে যায়। গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঢুকে ফেরিওয়ালার মত জাটকা বিক্রি করছে প্রতিদিন সকালে। চাঁদপুর শহরের চিহ্নিত কিছু পাড়া মহল্লাতেও ১০০/১২০ টাকা কেজিতে ফেরি করে জাটকা বিক্রি হয়।
গোপন সংবাদ পেয়ে চাঁদপুরের পদ্মা ও মেঘনা নদীবেষ্টিত রাজরাজেশ্বরে দুর্গমচরে অভিযান চালিয়ে পাইকারিতে জাটকা বিক্রয় হচ্ছে এমন অভিযোগে বেশ কয়েকটি আড়ত উচ্ছেদ করেছে নৌ-পুলিশ।
রোববার ২৮ মার্চ দুপুরে চাঁদপুর নৌ থানা এবং হরিণাঘাট নৌ পুলিশ ফাঁড়ি যৌথভাবে জেলা শহর থেকে ২৫ কিলোমিটার দূরের দুর্গম এক চরে অভিযান পরিচালনা করে। অভিযানের সময় তারা নদীতে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাছ ধরার অপরাধে ১৪ জেলেকে আটক করে। এছাড়া মাছ ধরার ইঞ্জিনচালিত পাঁচটি নৌকা ও বিপুল পরিমাণ জাল জব্দ করে।
চাঁদপুর নৌথানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জহিরুল হক সংবাদ কর্মীদের জানান, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ ও রাজধানী ঢাকায় যেসব জাটকা বিক্রি হয় ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের হাতে ধরা পড়ে তার প্রায় চালানগুলো মূলত এই রাজরাজেশ্বর থেকে যায়। তাই জাটকা নিধন ও তার চালান বন্ধ করতে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে এখানে অভিযান চালানো হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েকদিন ধরে রাজধানী ঢাকা ও তার আশপাশের জেলাগুলোতে বেশ ক’টি জাটকার চালান ধরা পড়েছে। এর সঙ্গে জড়িতরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছে স্বীকার করেছে, এসব জাটকার চালান চাঁদপুর থেকেই সেখানে যাচ্ছে। শুধু রাজরাজেশ^রই নয়, বহরিয়া, মোহনপুর এবং হাইমচরের বেশকিছু এলাকায় সুযোগ বুঝে একশ্রেণির জেলে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে জাটকা নিধন করছে। আর সেই সব জাটকা পদ্মা ও মেঘনাপাড়ের দুর্গমচরের আড়তে বেচাকেনা চলে। পরে নৌপথে ও সড়কযোগে জাটকার চালান পৌঁছে দেয়া হয় রাজধানী ঢাকায়।
গত ১ মার্চ থেকে ২৮ মার্চ রোববার পর্যন্ত ২৮ দিনে চাঁদপুরে সাড়ে ১২ মেট্রিক টন জাটকা, দুই শতাধিক মাছ ধরার নৌকা এবং প্রায় ৫০ লাখ মিটার কারেন্ট জাল জব্দ করা হয়েছে। একই সঙ্গে জাটকা নিধনের দায়ে ১৭০ জন জেলেকে আটকের পর কারাগারে পাঠিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।
একদিকে অভিযান অন্যদিকে জাটকা নিধন এবং পাচার এভাবেই চলতে থাকলে ইলিশের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ছাড়া নতুন সম্ভাবনা দেখছে না পর্যবেক্ষক মহল। তারা মনে করেন, জাতীয় মাছ ইলিশ সম্পদ রক্ষার স্বার্থে ক্ষতিকারক দিকগুলো অনুসন্ধান করে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে তা না হলে ইলিশ উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হবে।

 

সর্বাধিক পঠিত