• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • রোববার, ১৯ মে ২০২৪, ৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

মতলবের ক্ষীর : সুখ্যাতি থাকলেও এখন দুর্মূল্যে দুর্লভ অনেকের কাছেই

প্রকাশ:  ২৬ আগস্ট ২০২০, ১০:২৩
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

মতলবের ক্ষীর, সাচারের পান; একবার যদি না খাইয়া যান! ক্যামনে হয়।' এছাড়াও বগুড়ার দই, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির মিষ্টি যেমন সবার কাছে সমাদৃত, মতলবের ক্ষীরও তা-ই। সেই ব্রিটিশ আমল থেকেই খাঁটি দুধে তৈরি এখানকার ক্ষীর গুণে ও মানে এখনও অটুট। ভোজনরসিকদের প্রিয় রসনা।

বগুড়ার দই, কুমিল্লার রসমালাই, টাঙ্গাইলের পোড়াবাড়ির মিষ্টি, হাতিয়ার মহিষের দই কম-বেশি সব অঞ্চলের মানুষের কাছেই প্রিয়। সুমিষ্ট খাবার। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে এসব মিষ্টি কিংবা দই নিয়ে গেলে সবাই খুশি হন। এমনই একটি বিখ্যাত খাবার মতলবের ক্ষীর। এ ক্ষীরের সুনাম শত বছরের। আজও আছে। প্রসিদ্ধ এ ক্ষীর বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল তথা দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রচুর পরিমাণে রপ্তানি করা হতো, এখনও হচ্ছে। এর চাহিদা অনেক। এক সময় মতলব উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে বিক্রেতারা মতলব বাজারে এনে দুধ বিক্রি করতেন। ওই সময় মতলবের ঘোষপাড়া ছিলো ক্ষীর, দধি ও ঘি তৈরির প্রধানস্থল। সে সুবাদে কয়েকটি ঘোষ পরিবারের সদস্য অল্প দামে দুধ কিনে উন্নতমানের ক্ষীর তৈরি করতেন। ওই সময় থেকেই মতলবের ক্ষীর তৈরির সুনাম চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

মতলব উপজেলা প্রশাসন সম্পাদিত 'মতলবের ইতিবৃত্ত' বইয়ে এই ক্ষীরের উল্লেখ আছে। ২০১৩ সালে প্রকাশিত ওই বইয়ের ৪৪ নম্বর পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে 'মতলবের ক্ষীর খুবই প্রসিদ্ধ। সারাদেশে ক্ষীরের ব্যাপক চাহিদা ও কদরের কারণে একসময় অনেক হিন্দু পরিবার ক্ষীর তৈরি এবং ক্ষীরের পাত্র বানানোর কাজে ব্যস্ত থাকতো। এখনো এই ক্ষীরের চাহিদা সর্বত্র।'

ভারতীয় বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম বিখ্যাত অভিনেতা চিরঞ্জিত চক্রবর্তীর পছন্দের তালিকায় রয়েছে মতলবের ক্ষীর। চাঁদপুর কণ্ঠের প্রধান সম্পাদক কাজী শাহাদাত একবার তাঁর সাথে সাক্ষাতের নির্ধারিত সময় পান বাংলাদেশ থেকে রওনার পূর্বেই। মাধ্যম ছিলেন বাবুরহাটের পলাশ দে। চিরঞ্জিত এই পলাশ দেকে বলেছিলেন, তোমার ভাইটি যেনো সাথে করে ক্ষীর নিয়ে আসেন।

কথা হয় একসময়ের প্রসিদ্ধ ক্ষীর ব্যবসায়ী প্রয়াত গান্ধীচরণ ঘোষের ছেলে কিশোর কুমার ঘোষের সঙ্গে। তিনি বলেন, মতলব হচ্ছে ক্ষীরের জন্যে বিখ্যাত। আজ থেকে ৬০-৭০ বছর আগে মণে মণে ক্ষীর দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রি করতেন আমার প্রয়াত পিতা গান্ধীচরণ ঘোষ। বিশেষ করে দেশের বাইরেও মতলবের ক্ষীরের চাহিদা ছিলো বেশি। এখনও এর চাহিদা অব্যাহত আছে। আমাদের এ পেশাটি এখনও ধরে রেখেছি। আগে দুধের দামও কম ছিলো, আমরা ভালো ক্ষীর তৈরি করতে পারতাম। এখন সবকিছুর দামই বেড়ে যাচ্ছে। তখন আমার কাকা বেনু ঘোষ, হরিপদ ঘোষ, প্রভাত ঘোষসহ অনেকে ক্ষীর বিক্রি করতেন। এখন তো ভালো ক্ষীরের কেজি ৫০০-৬০০ টাকা। দুধের কেজিও ৬০-৭০ টাকা। আগের মতো ব্যবসায়ীরাও বাজারে দুধ নিয়ে আসেন না। এলেও ভালো দুধ পাওয়া যায় না। যার ফলে আমাদেরও বেশি দামে দুধ কিনে ক্ষীর, মিষ্টি তৈরি করতে হচ্ছে। এছাড়া বর্তমানে তেমন গাভীর দুধ না পাওয়ায় এবং ক্ষীর তৈরির অন্য উপকরণ সহজলভ্য না হওয়ায় ক্ষীরের দাম তুলনামূলক একটু বেশি।

 


উপজেলা সদরের কলেজ রোডে অবস্থিত ক্ষীর বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ভাই ভাই হোটেল এন্ড নন্দন কেবিন। দোকানটির মালিক সঞ্চয় ঘোষ বলেন, পাঁচটি কারণে এখানকার ক্ষীর গুণে ও মানে সেরা। প্রথমত, গৃহস্থের কাছ থেকে সংগ্রহ করা খাঁটি দুধ দিয়ে এই ক্ষীর বানানো হয়। দ্বিতীয়ত, দুধ ও চিনি মিশ্রণের অনুপাতে হেরফের হয় না। এক কেজি ক্ষীর বানাতে পাঁচ কেজি দুধ ও ৫০-৬০ গ্রাম চিনি মেশানো হয়। তৃতীয়ত, ক্ষীরে ময়দা বা আটা মেশানো হয় না। চতুর্থত, দুধের ননি ওঠানো হয় না। ননিসহ ক্ষীর বানানো হয়। পঞ্চমত, লাকড়ির চুলায় ক্ষীর তৈরি করা হয়।

উপজেলা সদর বাজারের আনন্দ ক্ষীর-ঘরের মালিক উৎপল ঘোষ বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকেই উপজেলা সদরের ঘোষপাড়া এলাকার গান্ধী ঘোষের পূর্বসূরিরা ক্ষীর তৈরি শুরু করেন। খাঁটি ও স্বাদের কারণে তখন এলাকায় এই ক্ষীরের সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। তাদের দেখাদেখি কলাদী ও বাইশপুর গ্রামের দাসপাড়ার আরও ১৫-২০টি হিন্দু পরিবার এ কাজে নামে। বর্তমানে ঘোষপাড়ার সুনীল ঘোষ, মিলন ঘোষ, গান্ধী ঘোষ, অনিক কুমার ঘোষ, উৎপল ঘোষ এবং দাসপাড়ার মাখনলাল ঘোষ, নির্মল ঘোষসহ কয়েকটি পরিবার ক্ষীরের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।

নন্দ দুলাল ঘোষ জানান, প্রতিদিন সকালে গৃহস্থের কাছ থেকে খাঁটি দুধ সংগ্রহ করে রাখা হয়। দুপুরে এসব দুধ বড় পাত্রে রেখে চুলায় দুই ঘণ্টা জ্বাল দেওয়া হয়। ক্ষীর তৈরি হলে ছোট ছোট পাত্রে আলাদাভাবে রাখা হয়। পরে মাটির পাত্রে ক্ষীর রেখে ফ্যানের বাতাসে কিছুক্ষণ রাখার পর ফ্রিজে সংরক্ষণ করা হয়।

প্রবীণ ক্ষীর ব্যবসায়ী সুনীল ঘোষ বলেন, বর্তমানে এক কেজি দুধের দাম ৬০-৭০ টাকা। চিনিসহ অন্যান্য খরচ মিলে এক কেজি ক্ষীর বানাতে খরচ পড়ে ৪০০ টাকা। প্রতি কেজি ক্ষীরের দাম পড়ে ৪৫০-৪৬০ টাকা।

মতলবের ঘোষপাড়া এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ক্ষীর ব্যবসায়ীদের পরিবারের সদস্যরা ক্ষীর তৈরির কাজে ব্যস্ত। আবার কেউ কেউ এ পেশা ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যাচ্ছেন। একাধিক ক্ষীর ব্যবসায়ী জানান, ক্ষীর মতলবের জন্যে বিখ্যাত। এখন আর প্রকৃত ক্ষীর ইচ্ছা করলেই তৈরি করতে পারি না। কারণ বাজারে দুধের দাম বেশি এবং চাহিদানুযায়ী দুধও পাওয়া যায় না। তারপরও আমার পূর্বপুরুষ বাপ-চাচারা এ ব্যবসা করে আসছেন, আমরাও করছি।

কয়েকজন ক্ষীর ক্রেতা জানান, মতলব থেকে আগে প্রকৃত ক্ষীর কিনতে পারতাম। এখন বেশি মূল্য দিয়েও প্রকৃত ক্ষীর পাওয়া দুর্লভ। এদিকে এখনও দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে ক্রেতারা এসে ক্ষীর কিনছেন। দুধের মূল্য কম হলেই স্বল্প দামে প্রকৃত ক্ষীর পাওয়া যায়। এ প্রসিদ্ধ খাবারটি সবার পছন্দনীয় হলেও হতদরিদ্র মানুষরা অর্থের জন্যে তা কিনে খেতে পারছেন না।