• পরীক্ষামূলক সম্প্রচার
  • বৃহস্পতিবার, ১৬ মে ২০২৪, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
  • ||
  • আর্কাইভ

করোনায় শহর ছেড়ে গ্রামমুখী মানুষ

বাসা ও দোকান ভাড়ার সাইনবোর্ডই ঝুলছে শুধু

প্রকাশ:  ১৫ জুলাই ২০২০, ১২:৩৪
নিজস্ব প্রতিবেদক
প্রিন্ট

সন্তানদের শিক্ষার আলোয় সুশিক্ষিত করার লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নিয়েই লোকজন মফস্বল থেকে শহরমুখী হয়। গ্রামের পরিবেশ পরিস্থিতি আর শহরের পরিবেশের মধ্যে একটা পার্থক্য বিদ্যমান আছে। সার্বিক দিক মিলিয়ে সন্তানদের উন্নত শিক্ষায় শিক্ষিত করে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্যই জেলা শহরে বসবাস করে অনেকে। তবে করোনার ভয়ঙ্কর প্রভাবের কারণে এমন উদ্দেশ্য নিয়ে জেলা শহরে আসা অনেকেই এখন ফিরে যাচ্ছেন নিজেদের গাঁও-গ্রামে। বিলাসবহুল ভবনগুলোর দেওয়ালে ঝুলছে বাসা ভাড়ার টু-লেট।


জানা যায়, চলতি বছরের শুরুর দিকেও চাঁদপুর জেলা সদরে বাসা ভাড়া খুঁজতে লোকজনের ভিড় দেখা গেছে। ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দেয়ার জন্য অনেকেই দোকানের খোঁজে শহরে অবস্থান করতো। কিন্তু আজ কালের বিবর্তনে নয়, অদৃশ্য করোনাভাইরাসের ছোবলে এক মহামারীর ভয়াল থাবায় সব কিছু চূর্ণ বিচূর্ণ। বসতি স্থাপনের জন্য তৈরি করা বিশাল আকারের ভবনগুলোর ফটকের সামনে ঝুলছে বাসা ভাড়ার টু-লেট। ক্রেতাসাধারণের ভিড় লেগে থাকা দোকানগুলোর শাটারে ঝুলছে দোকান ভাড়ার সাইনবোর্ড। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষক-কর্মচারীদের মানবেতর জীবন-যাপন করতে হচ্ছে। সংসারের ঘানি টানার জন্য অনেকেই শিক্ষকতার পাশাপাশি কোচিং করাতো, প্রাইভেট পড়াতো। করোনার প্রভাবে সব কিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারাও আজ দিশেহারা।

 


ফরিদগঞ্জ উপজেলার বাসিন্দা আবু সালেহ জানান, ছেলে-মেয়েদের ভালো মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর উদ্দেশ্য নিয়েই চলতি বছরের শুরুর দিকে অনেক যুদ্ধ করে জেলা শহরে বাসা ভাড়া নিয়েছি। উদ্দেশ্য অনুযায়ী আমার ২ মেয়েকে শহরের দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করিয়েছিলাম। সন্তানদের ভালো মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করানোর জন্যই আমাকে প্রবাস জীবন কাটাতে হয়। প্রথম দিকে বাসা ভাড়া নিয়ে ভালোই কেটেছে আমার পরিবারের জীবন যাপন। দীর্ঘ সময় ধরে লেগে থাকা করোনার কারণে আমার অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো যাচ্ছে না। এছাড়াও চারিদিকে আতঙ্কিত অবস্থা দেখে আমার স্ত্রী সন্তানদের নিয়ে শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরে গেছে। জেলা সদরের বাসিন্দা ঠিকাদারি ব্যবসায়ী সেলিম জানান, চাঁদপুর শহরে চলতি বছরের প্রথম দিকেও লোকজনকে বাসা ভাড়া, দোকান ভাড়া নেয়ার জন্য ভিড় করতে দেখা যেতো। করোনার আতঙ্কে আজ জেলা শহরের অনেক ফ্লাটেই বাসা ভাড়ার টু-লেট ঝুলছে। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দিলেও তেমন জনসমাগম দেখা যাচ্ছে না। সকাল ১০টা থেকে শুরু, সন্ধা ৭টার মধ্যে দোকানপাট বন্ধ করার কথা থাকলেও অর্থনৈতিক চাপের কারণে পড়ে অনেকেই মানছেন না নিয়ম। এছাড়াও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয় না হলে আমরা বাসা থেকে বের হই না। আমাদের মাঝে এক ধরনের ভয়ের প্রতিচ্ছবি বিরাজমান। চাইলেও আমরা উন্মুক্ত হতে পারি না। কেমন যেনো অজানা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি।

জেলা সদরে ভাড়া থাকেন, নাম জানাতে অনিচ্ছুক এক গৃহবধূ বলেন, বাচ্চাদের লেখাপড়া করানোর জন্য অনেক ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে বাসা ভাড়া নিয়েছি। উদ্দেশ্য ভালো ছিলো, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার ফলাফল মনের মতই ছিলো। বরাবরই ভালো ফলাফল করে যাচ্ছিল তারা। করোনার কারণে হঠাৎ সব কিছু এলোমেলো হয়ে গেলো। অনেকদিন ধরে লেগে থাকা করোনাভাইরাস আমাদের অর্থনৈতিক গতিকে দমিয়ে দিলো। একদিকে করোনার আতঙ্ক, অন্যদিকে অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় আমাদের গ্রামে ফিরে যেতে হবে।

চাঁদপুর সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অসিত বরণ দাশ বলেন, দীর্ঘ প্রায় ৪ মাস ধরে লেগে থাকা মহামারী করোনার প্রভাব সমগ্র দেশের ন্যায় চাঁদপুরবাসীকেও গ্রাস করছে। জেলা সদরে অনেকেই আছেন প্রবাসী পরিবারের, যারা দীর্ঘদিন যাবত এই শহরে সন্তানদের ভালো মানের শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য বাসা ভাড়া নিয়ে থাকেন। প্রবাসীদের অর্থনৈতিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় এবং করোনার ভয়াবহ বিস্তারের কারণে এমন অনেকেই শহর থেকে গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে এসে জেলা সদরে যারাই বসবাস করে আসছেন, তারাসহ সমগ্র জেলাবাসীকে আতঙ্কিত না হয়ে সচেতন হতে হবে। বুঝতে হবে এটা একটা মাহামারী দুর্যোগ। যতক্ষণ পর্যন্ত কোভিড-১৯-এর ভ্যাকসিন বা টিকা বের না হবে, ততদিন পর্যন্ত আতঙ্কিত আর হতাশ না হয়ে সচেতনভাবে জীবনযাপন করাটাই হবে সঠিক কাজ।

জেলার বিশিষ্ট নাগরিকদের অন্যতম রোটারিয়ান কাজী শাহাদাত মনে করেন, চলমান করোনার ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সমগ্র দেশের ন্যায় চাঁদপুর জেলাবাসীর জনজীবন স্থবির হয়ে পড়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের জন্য ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দিলেও ব্যবসায়ীদের কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন বাস্তবায়িত হচ্ছে না। যারা সরকারি চাকুরি করছেন, তারা অনেকটাই চাপমুক্ত অবস্থায় আছেন। মাস শেষে অন্তত তারা তাদের পারিশ্রমিকটুকুন পেয়ে যাচ্ছেন। মধ্যবিত্ত নাগরিকদের মাঝে দুশ্চিন্তার প্রতিচ্ছবি লক্ষ্য করা যায়। এমতাবস্থায় জেলা শহরে সন্তানদের লেখাপড়া করানোর উদ্দেশ্য নিয়ে যারা এসেছেন, তারা আতঙ্কিত না হয়ে ধৈর্য ধরে করোনা প্রতিরোধ করাটাই হবে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। অর্থনৈতিক গতি যেহেতু সবার বেলায় দুর্বল হয়ে পড়েছে, তাই বাড়িওয়ালা আর ভাড়াটিয়াদের মধ্যে এক ধরনের মানবিকতার বিকাশ ঘটানো সময়ের দাবি।

চাঁদপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব ওচমান গনি পাটোয়ারী বলেন, বর্তমান সরকার শিক্ষা বান্ধব সরকার। শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে পেঁৗছানের জন্য বিরতিহীনভাবে কাজ করে যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উন্নতমানের শিক্ষার সাথে সাথে সন্তানদের ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার জন্যই মূলত মফস্বল থেকে লোকজন শহরে বাসা ভাড়া নিয়ে বসবাস করেন। চলমান করোনার ভয়াল পরিস্থিতিতে এসে হয়তো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সাময়িকভাবে বন্ধ রয়েছে। এতে হতাশা না হয়ে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়াটাই হবে মানবকল্যাণকর কাজ। এমন পরিস্থিতিতে এসে জেলার প্রত্যেক নাগরিককে আতঙ্কিত আর হতাশ না হয়ে বাধ্যতামূলক মাস্ক এবং স্যানিটাইজার পণ্য সামগ্রী ব্যবহার করাটাই হবে উত্তম পন্থা। তিনি বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে যখন যেখানে যা প্রয়োজন হয়েছে, জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে যতটুকু সম্ভব করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক মাজেদুর রহমান খান বলেন, চলমান করোনা নিয়ে আতঙ্কিত আর হতাশ না হয়ে জেলাবাসীকে সচেতন থাকতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এমন পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্যে সব ধরনের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ওয়ার্ড থেকে ইউনিয়ন পর্যায়ে ত্রাণ সামগ্রীর ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। সন্তানদের ভালো মানের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করানোর জন্যে লোকজন গ্রাম থেকে শহরে আসেন। এখন যেহেতু একটা দুর্যোগ চলছে, এছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে, তাই অনেকেই হয়তো গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন।

সর্বাধিক পঠিত