আইসোলেশনে রোগীদের চিকিৎসার সুযোগ সুবিধা না বাড়ালে করোনায় মৃত্যুর মিছিল থামানো যাবে না


আড়াই শ' শয্যা বিশিষ্ট চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে গত ক'দিন যাবত মানুষ মারা যাচ্ছে। গড়ে প্রতিদিন ৩/৪ জন করে মানুষ এই ওয়ার্ডে মৃত্যুবরণ করছে। মানুষগুলো করোনাভাইরাসের উপসর্গ জ্বর, শ্বাসকষ্ট ও কাশিসহ আরো কিছু উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে এসে ভর্তি হয়। কিন্তু হাসপাতালটিতে উন্নত চিকিৎসা সেবা দেয়ার সুযোগ-সুবিধা না থাকায় অর্থাৎ করোনা রোগীদের একেবারে শেষ সময়ে যে ধরনের সাপোর্ট দেয়া খুবই জরুরি, সে ধরনের ব্যবস্থা না থাকায় মানুষগুলোকে বাঁচানো যাচ্ছে না। রোগীগুলো যে মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে আসে, তখন তাদেরকে যে ধরনের সাপোর্ট বা চিকিৎসা সেবা দেয়া সম্ভব হয় না প্রয়োজনীয় সুবিধা না থাকায়। সে সময় ডাক্তাররা হাসপাতালে বিদ্যমান সুযোগ সুবিধা অনুযায়ীই চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন। তখন ওই চিকিৎসা ব্যবস্থা হয়ত খুবই খারাপ অবস্থার রোগীদের বেলায় মোটেই যথেষ্ট নয়। আর ওই সময়ে প্রাণপণ চেষ্টার পরও চিকিৎসকদের পক্ষে সেসব রোগীকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। অথচ চিকিৎসকদের চেষ্টা বা আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। চিকিৎসকদের ব্যাপারে এমনই মন্তব্য শোনা গেলো এ হাসপাতালেরই আইসোলেশনে করোনা পজিটিভ নিয়ে ভর্তি হওয়ার পর এখানকার চিকিৎসায় পূর্ণ সুস্থ হওয়া রোগীদের নিকট থেকে।
চাঁদপুর জেলায় করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার আগেই জেলা সদর হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসার জন্যে ২৫ বেডের একটি আইসোলেশন ইউনিট প্রস্তুত করা হয়। হাসপাতালের মূল ভবনের সাথেই পৃথক দোতলা এ ভবনটি সংক্রামক ব্যাধি ওয়ার্ডের জন্যে আগেই নির্ধারিত ছিল। তবে এটাতে সংক্রামক ব্যাধি রোগীর কোনো বেড ছিল না। এখানে হাসপাতালের ডাক্তাররাই চেম্বার করতেন এবং রোগী দেখতেন।
রোনা ভাইরাস রোগটি যখন দেখা দেয়, তখন এ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্যে সংক্রামক ব্যাধির জন্য নির্ধারিত পৃথক এ ভবনটি আইসোলেশন ইউনিট হিসেবে প্রস্তুত করা হয়।
হাসপাতাল সূত্র থেকে জানা যায়, ২৭ মার্চ থেকে আইসোলেশন ইউনিটে রোগী ভর্তি হতে শুরু করে। কখনো করোনা পজিটিভ নিয়ে আবার কখনো করোনার উপসর্গ নিয়ে রোগী ভর্তি হতে থাকে। এপ্রিল থেকে যখন চাঁদপুরে এ রোগটির প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে থাকে এবং সংক্রমণ বাড়তে থাকে, তখন আইসোলেশনে রোগীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে রোগী সামাল দিতে ডাক্তারদের হিমশিম খেতে হয়। এদিকে ওই আইসোলেশন ইউনিটটির স্পেস তুলনামূলক কম হওয়ায় সেখানে ডাক্তার ও নার্সদের পর্যায়ক্রমে ২৪ ঘণ্টা অবস্থান করে চিকিৎসা সেবা কার্যক্রম চালাতে ব্যাহত হচ্ছিল। যে কারণে গত ক'দিন আগে আইসোলেশন ইউনিটটি স্থানান্তর করে হাসপাতালের মূল ভবনের দ্বিতীয় তলায় নিয়ে আসা হয়। এখানে ৫০ বেডের মতো ব্যবস্থা রয়েছে। ডাক্তার এবং নার্সরাও এখানে পালাক্রমে ২৪ ঘণ্টা থাকতে পারছেন। কিন্তু তারপরও দেখা যাচ্ছে যে, মৃত্যুর সংখ্যা কমছে না। বরং গত দুদিন তিনজন করে ছয়জন মারা গেছেন নতুন আইসোলেশন ইউনিটে। রোগীগুলো শেষ মুহূর্তে তথা মুমূর্ষু অবস্থায় আসার পরও কেনো ১ থেকে ২ ঘণ্টার ব্যবধানে রোগীগুলো মারা যাচ্ছে তার কারণ অনুসন্ধানে হাসপাতালের দায়িত্বশীল সিনিয়র কয়েকজন চিকিৎসকের সাথে কথা হয়।
হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডাঃ একেএম মাহবুবুর রহমানের কাছে জানতে চাওয়া হয়, এ হাসপাতালের আইসোলেশন ইউনিটে যে সুযোগ সুবিধা রয়েছে তা করোনা পজিটিভ অথবা উপসর্গ নিয়ে ভর্তি হওয়া রোগীদের চিকিৎসার জন্য যথেষ্ট কি না। জবাবে তিনি যা বুঝাতে চেয়েছেন তা এক বাক্যে বললে বলতে হয়, মোটেই যথেষ্ট নয়। কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে আসা রোগীর যদি শারীরিক তেমন কোনো সমস্যা না থাকে তাহলে সে রোগীর ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হয় না। এমন বেশ কিছু রোগী আমাদের এখান থেকে চিকিৎসা সেবা নিয়ে পূর্ণ সুস্থ হয়ে বাড়িতে চলে গেছেন। কিন্তু তখনই আমাদের খুব বেকায়দায় পড়তে হয় যখন রোগী একেবারে শেষ সময়ে মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে আসে। আর ওই সময়কার প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দেয়ার ব্যবস্থা না থাকে, তখন রোগী মৃত্যুর ঝুঁকিতে পড়ে যায়। সেসব রোগীকেই দেখা গেছে যে, ১/২ ঘণ্টার মধ্যেই মারা যায়। এমন দুর্ঘটনা কোভিড-১৯ পজিটিভ রোগী খুব খারাপ হলেও হয়ে থাকে, আবার এ ভাইরাসের উপসর্গ নিয়ে মুমূর্ষু অবস্থায় হাসপাতালে আসলেও হয়ে থাকে।
ডাঃ মাহবুবুর রহমানের কাছে এই প্রতিবেদক জানতে চান করোনায় আক্রান্ত হলে অথবা উপসর্গ নিয়ে ভুগলে সে রোগীর প্রাথমিক চিকিৎসা কী? জবাবে তিনি বলেন, রোগীর শরীরে অসুস্থতার লক্ষণ বুঝে চিকিৎসা দেয়া হয়। এ ক্ষেত্রে জাতীয় গাইডলাইন রয়েছে। সে গাইডলাইন অনুসরণ করে চিকিৎসা দেয়া হয়। তারপরও তিনি বলেন, লক্ষণ বুঝে এন্টিবায়োটিক ঔষধ, শ্বাস প্রশ্বাস নিতে কষ্ট হলে নেবুলাইজার, অঙ্েিজন ইত্যাদি সেবা দেয়া হয়। আবার রোগীর হার্টের সমস্যা থাকলে অথবা উচ্চ রক্তচাপ থাকলে সে অনুযায়ী চিকিৎসা চলে। তবে মুমূর্ষু রোগীদের বেলায় যে ধরনের সাপোর্ট দরকার তা এখানে নেই বলে তিনি জানান। সে সাপোর্টগুলোর মধ্যে খুব জরুরি হচ্ছে হাই ফ্লো অঙ্েিজন। যেটি সেন্ট্রাল অঙ্েিজন প্লান্ট-এর দ্বারা হয়ে থাকে। এটি এ মুহূর্তে অর্থাৎ এই হসপিটালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়ার জন্যে খুবই জরুরি। এছাড়া আরো যা প্রয়োজন তা হচ্ছে আইসিইউ সুবিধা, মেডিকেল গ্যাস সরবরাহ এবং একটি ল্যাব স্থাপন। তবে জরুরি ভিত্তিতে অন্তত করোনা ওয়ার্ডের জন্যে সেন্ট্রাল অঙ্েিজন প্লান্ট খুবই প্রয়োজন। তখন হয়ত মুমূর্ষু রোগীর বেলায় অন্তত শ্বাস প্রশ্বাসে কষ্ট হবে না। আর এ সময়টাতে ডাক্তাররা সে রোগীর প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা দেয়ার সুযোগ পাবে। তাছাড়া মুমূর্ষু রোগীর ক্ষেত্রে শুধু সিলিন্ডার অঙ্েিজনে কাজ হয় না।
ডাঃ মাহবুবুর রহমান আরো জানান, আমরা আমাদের মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ের ভাইয়ের সাথে কথা বলেছি। আরো বিভিন্ন জায়গায় কথা বলেছি সেন্ট্রাল অঙ্েিজন প্লান্টের জন্যে। সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। এছাড়া মন্ত্রণালয়ে এ সব চাহিদা উল্লেখ করে চিঠি দেয়া হচ্ছে। আশা করি সহসা একটা কিছু হবে। সবশেষে তিনি বলেন, সকল সুযোগ সুবিধা থাকার পরও কিছু মানুষ মারা যাবে এটাই স্বাভাবিক। এটি উন্নত সব রাষ্ট্রে হচ্ছে।